বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ ।। ১৪ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৮ রমজান ১৪৪৫


তিনি তো আরেকটু বেশি পেতে পারতেন!

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আতাউর রহমান খসরু ।।

শৈশব ও কৈশোরে যে কয়েকজন ইসলামি রাজনীতিক আমাকে দারুণভাবে মুগ্ধ ও মোহিত করেছিলেন অধ্যাপক হাফেজ মাওলানা এটিএম হেমায়েত উদ্দীন রহ. ছিলেন তাদের একজন। মুগ্ধতার প্রধান কারণ ছিল তার তেজস্বী ও প্রদীপ্ত বক্তৃতা। মঞ্চে দাঁড়ানোর পর ধীর তলে তার বক্তৃতা শুরু হতো এবং ক্রমেই গতিশীল হতো তা। শ্রোতার মনোযোগও চুম্বকের মতো টানতে থাকতো তার শব্দমালা। মুহূর্তের মধ্যে বারুদ ছড়িয়ে পড়তো উপস্থিত ছাত্র-জনতার ভেতর। মুহূর্মুহু শ্লোগানের ভেতর শেষ হতো সেই বক্তৃতা।

মিছিলে ময়দানে তেজস্বী এই ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী, হাসিমুখ ও অনুচ্চ কণ্ঠ। আমার সঙ্গে তার শ্রদ্ধ ও স্নেহের একটি সম্পর্ক ছিল। আমার নানা মাওলানা সুজাউদ্দিন রহ.-এর সূত্রেই তিনি প্রধানত আমাকে স্নেহ করতেন। দেখা হলেই জিজ্ঞেস করতেন, তুমি সুজাউদ্দিন ভাইয়ের নাতী না? ভালো আছো? এছাড়াও চাকরির সুবাদে আমার বাবা দীর্ঘদিন পশ্চিম রাজা বাজার থাকায় তাদের এক সঙ্গে বহু কাজ করার সুযোগ হয়েছে। বাবার পরিচয়েও তিনি আমাকে স্নেহ করতেন।

দুই.

অধ্যাপক এটিএম হেমায়েত উদ্দীন রহ.-এর প্রতি আমার মুগ্ধতার আরেকটি কারণ ছিল তিনি হাফেজ মাওলানা এবং ‘অধ্যাপক’। আমাদের শৈশব ও কৈশোরে এমন হাফেজ মাওলানা অধ্যাপকের সংখ্যা ছিল খুবই কম। বিশেষত ইসলামি রাজনীতিতে উভয় ধারায় শিক্ষিত মানুষ ছিলেন হাতে গোনা কয়েকজন। আমার মনে হতো, তাদের অংশগ্রহণে ইসলামি রাজনীতির গ্রহণযোগ্যতা ও ওজন বৃদ্ধি পেয়েছে। বন্ধু-আড্ডার বিতর্কে আমি তাকে বারবার দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থিত করেছি।

অধ্যাপক হেমায়েত উদ্দীনের যে বক্তৃতার প্রতি আমার প্রবল আকর্ষণ অনুভব করতাম, তাতেও শিক্ষার প্রচ্ছন্ন প্রভাব ছিল। তা ছিল খুবই গোছালো ও পরিশীলিত। শব্দ-বাক্যের ভারসাম্য নষ্ট হতো খুব সামান্যই। বক্তৃতায় এলোমেলো কথা তিনি বলতেন না। তবে হ্যাঁ, ২০০৪-৫ সালের পর তার বক্তৃতা শোনার সুযোগ আমার হয়নি। ভালো ছাত্র হওয়ার ‘কথিত’ তাড়না এরপর আমাকে আর মিছিলমুখী হতে দেয়নি।

তিন.

২০০২ সালের ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে তিনি মেয়র পদপ্রার্থী ছিলেন। তখন আমি জামিয়া ইসলামিয়া লালমাটিয়া মাদরাসার ছাত্র। নির্বাচনের আগ মুহূর্তে মাদরাসায় পরীক্ষার খেয়ার (ক্লাস বিরতি) চলছিল। পরের দিন পরীক্ষা। দুপুর ১২টার দিকে একটি মাইক্রোবাসে অধ্যাপক হাফেজ মাওলানা এটিএম হেমায়েত উদ্দীন রহ. দলীয় নেতাকর্মীসহ উপস্থিত হলেন।

অফিসে দায়িত্বশীল শিক্ষকদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে তিনি চাইলেন রুমে রুমে গিয়ে ছাত্রদের কাছে ভোট চাইবেন। কিন্তু মাদরাসার একজন দায়িত্বশীল শিক্ষক -যিনি তখন একটি ইসলামী দলের সক্রীয় নেতা- তাদের ওপরে যেতে বাধা দিলেন। এক প্রকার অসৌজন্যমূলক আচরণে বাধ্য করলেন মাদরাসার সীমানা ছেড়ে যেতে।

এরপর জোহর বা আসরের নামাজের সময় তিনি আবার এলেন এবং মসজিদের সিড়িতে দাঁড়িয়ে ছাত্র ও সাধারণ মুসল্লিদের কাছে ভোট চাইলেন। সেই ‘নেতা শিক্ষক’কে সালাম দিয়ে সম্মানও দেখালেন। তার কর্মীরা হ্যান্ডবিল বিতরণ করলো।

পরের দিন পরীক্ষার হলে সেই শিক্ষক ছাত্রদের সাবধান করলেন কোনোভাবেই যেন ‘মাওলানা হেমায়েত’কে ভোট দেওয়া না হয়। ছাত্ররাও তার কথা রাখলো। তারা বিপুল উৎসাহে বিএনপির মেয়র প্রার্থী সাদেক হোসেন খোকা ও ওয়ার্ড কমিশনার প্রার্থী আতিকুল ইসলাম আতিকের পক্ষে ভোট ও ‘জাল ভোট’ দিলো। আমাদের ক্লাসের এক বড় ভাই একাই সাদেক হোসেনকে ‘পাঁচ’ ভোট দিয়ে কতিপয় শিক্ষকের বাহবাহ কুড়ালেন।

চার.

ইসলাম টাইমস সম্পাদক মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ মাওলানা হেমায়েত উদ্দীনের স্মৃতিচারণ করে এক লেখায় তাকে ‘সর্বদলীয় ঐক্য-প্রয়াসী’ ও ‘সমন্বয়কামী’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। উঠতি বয়সে যে কয়দিন মিছিল-মিটিংয়ে যাওয়ার এবং মাওলানা হেমায়েত উদ্দীনকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে তাতে আমারও তাকে একজন ঐক্য-প্রয়াসী মানুষ বলেই মনে হয়েছে। সম্মিলিত কর্মসূচীতে তিনি দলের প্রতিনিধিত্ব করতেন।

আমি এমনও দেখেছি, বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটের একটি প্রতিবাদ সভায় তিনি উপস্থিত হয়েছেন, বক্তৃতার সুযোগ তো দূরের কথা তাকে ব্যানারের কাছেও ঘেঁষতে দেওয়া হলো না। পরের সপ্তাহে একই ইস্যুতে, একই স্থানে, একই ব্যানারে মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ। মঞ্চে বক্তৃতা চলছে, তিনি পাশে দাঁড়ানো। তার ভেতর কোনো খেদ নেই। তিনি অম্লান। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালসহ তার জানাযায় উপস্থিত বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীরা তার উদারতার কথাই বিশেষভাবে স্মরণ করেছেন।

অভিযোগ রয়েছে, এই উদারতা ও সমন্বয়-প্রয়াস তাকে নিজ দলেও কিছুটা বঞ্চিত করেছে। নতুবা ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রথম দিন থেকে যে লোকটি দলের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন এবং প্রথম দিন থেকে যিনি নেতা -তিনি কেন যুগ্ম মহাসচিব পদে আটকে থাকবেন? তিনি তো আরেকটু বেশি পেতে পারতেন!

পাঁচ.

সাংবাদিকতায় নিয়মিত হওয়ার পর ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের একাধিক নেতার সঙ্গে আমার কথা বলার সুযোগ হয়েছে। তাদের দৃষ্টিতে অধ্যাপক মাওলানা এটিএম হেমায়েত উদ্দীন রহ. ছিলেন দল ও দলীয় কর্মীদের জন্য একজন দরদী অভিভাবক। দলের যে কোনো স্তরের নেতা-কর্মীর জন্য তিনি ছিলেন আশ্রয়।

ইসলামী আন্দোলনের নেতা মাওলানা শহিদুল ইসলাম কবির তার স্মরণসভায় বলেন, ‘কয়েকদিন আগে যখন আমার হার্টে রিং পরানো হলো, তখন হেমায়েত সাহেব জানতে পারেন আমার টাকা জোগার করতে কষ্ট হচ্ছে। তিনি ফোন করে আমাকে বললেন, আমার ওষুধ কেনা জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা জমা আছে, তুমি এসে নিয়ে যাও। অথচ তার ক্যান্সারের মতো ব্যয় বহুল চিকিৎসা চলছে। টাকার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।’

তাদের ভাষায়, ঢাকা মহানগরের সংগঠনের শক্ত ভিত মাওলানা হেমায়েত উদ্দীনই তৈরি করে রেখে গেছেন। তার মৃত্যুর পর ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি অধ্যক্ষ মাওলানা শেখ ফজলে বারী মাসউদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, একজন অনুজ হিসেবে মাওলানা হেমায়েত উদ্দীনের ব্যাপারে আপনার মূল্যায়ন কী?

তিনি বলেন, দলীয় দায়িত্ব পালনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমি তাকে সহযোগিতাপ্রবণ পেয়েছি। সামগ্রিকভাবে তিনি একজন সফল নেতা। আমাদেরকে তিনি নানাভাবে অনুপ্রাণিত করেছেন। আমার সব সময় মনে হয়েছে, তিনি একজন গণমুখী নেতা। একটি নিছক ইসলামী দল থেকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের একটি গণমুখী রাজনৈতিক দল হয়ে ওঠার পেছনে অন্য অনেকের মতো তার চিন্তা-প্রচেষ্টাও গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রেখেছে বলে আমার বিশ্বাস।

আল্লাহ মরহুমের কবরকে শীতল করুন। তার সারা জীবনের দ্বীনি খেদমতকে কবুল করুন। জান্নাতে তার মর্যাদা বৃদ্ধি করুন। পাশাপাশি তার পরিবার, সহকর্মী ও সহযোদ্ধাদের ধৈর্য ধারণের তাওফিক দিন। আমিন।

লেখক : আলেম ও সাংবাদিক

আরএম/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ