শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


সমাজে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার প্রথম দায় অভিভাবক ও পরিবারের

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

দিনদিন সমাজে অপরাধ বাড়ছে। বাড়ছে অপরাধীদের সংখ্যা। কিশোর থেকে শুরু করে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সকলেই জড়িয়ে পড়ছেন পাপাচারে। যার ফলে সমাজে বইছে না শান্তির সুবাতাস। মানবতার মহৎগুণ হারিয়ে হিংস্র হয়ে উঠছে মানুষ। রক্তপাত ধর্ষণ-খুন ও দুর্নীতির খবরে ভরে যায় জাতীয় পত্রিকাগুলোর পাতা। মারামারি কাটাকাটির খবর এখন পাঠকের কাছে অপরিচিত কিছু নয়। ‌ বরং তারা পত্রিকা হাতে নেওয়ার সময় এক প্রকার নিশ্চিত থাকেন এই ধরনের কোন একটি খবর তার সামনে আসবে।

কেন বাড়ছে সমাজে অপরাধ? এর জন্য দায়ী কারা? সর্বোপরি এর থেকে উত্তরণের উপায় সম্পর্কে আমরা জানতে চেয়েছি আল্লামা শাহ আহমদ শফীর খলিফা ও দারুল উলুম মাবিয়া ইসলামিয়া মাদরাসার মুহতামিম মুফতি মাহবুবুর রহমান নবাবগঞ্জীর সঙ্গে। সাক্ষাৎকারে তার সঙ্গে ছিলেন আওয়ার ইসলামের বিশেষ প্রতিবেদক মাওলানা সুফিয়ান ফারাবী


আওয়ার ইসলাম: সমাজে অপরাধের পরিমাণ বাড়ছে কেন?

মুফতি মাহবুবুর রহমান নবাবগঞ্জী: হামদ ও সালাতের পর- দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের সমাজে দিন দিন অপরাধের পরিমাণ বাড়ছে। বাড়ছে অপরাধীর সংখ্যা। নতুন নতুন অপরাধ জন্ম নিচ্ছে সমাজে। যার কারণে সমাজে সুখ, শান্তি, রহমত ও বরকত নেই। পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ ও রাষ্ট্র কোথাও শান্তির সু-বাতাস বইছে না।

এর প্রথম এবং প্রধান কারণ হচ্ছে, মানুষের মাঝে সৃষ্টিকর্তার ভয় না থাকা। এটা হচ্ছে মৌলিক এবং প্রধান কারণ। মানুষের মন থেকে যখন আল্লাহর ভয় চলে যায়, তখন সে যা ইচ্ছে করতে পারে। সে যেকোন পাপাচারে লিপ্ত হতে পারে। যিনা-ব্যভিচার, ধর্ষণ, হত্যা, খুন, ঘুষ, দুর্নীতিসহ যেকোন অপরাধে মানুষ জড়িয়ে যেতে পারে একমাত্র আল্লাহর ভয় না থাকার কারণে।

দ্বিতীয় আরেকটি কারণ হলো- অসুস্থ সাংস্কৃতির প্রতিযোগিতা। আমাদের দেশের সাংস্কৃতির অঙ্গনের মানুষগুলোর এদেশে অপরাধের ভিত্তি স্থাপন করে। নাটক, সিনেমা অশ্লীল ভিডিও ও এ জাতীয় বিভিন্ন বিষয়ের মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহ বিমুখ করে দেয়। সৃষ্টিকর্ততার কথা ভুলিয়ে দেয়।

এজন্য আমি বলব, সমাজে অপরাধের প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো অসুস্থ সাংস্কৃতির প্রতিযোগিতা। আজ আমাদের যুব সমাজ এই অসুস্থ সাংস্কৃতির কবলে পড়ে তাদের নীতি-আদর্শ সবকিছু হারিয়ে ফেলছে।

তৃতীয়ত আরেকটি বিষয় যোগ করতে চাই মানুষের মাঝে ধন-সম্পদের অধিক আকাঙ্ক্ষা। অধিক ধন- সম্পদের আকাঙ্ক্ষা অপরাধ প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়। যখন একজন মানুষ অধিক পরিমাণ অর্থের মালিক হতে চায়, তখন সে যেকোন প্রকারের অন্যায় ও অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়তে দ্বিধা করে না। দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, ঘুষ, সুদসহ নানা রকম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। আজকে সমাজে অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া ও সমাজ শান্তির সু-বাতাস বন্ধ হওয়ার এটি একটি অন্যতম কারণ।

আওয়ার ইসলাম: সমাজে অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার জন্য দায়ী কারা?

মুফতি মাহবুবুর রহমান নবাবগঞ্জী: সর্বপ্রথম অভিভাবক ও পরিবারকে দায়ী করতে চাই। একটু স্পষ্ট করে বলি, আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও এটাই সত্য আমাদের শিশুরা ছোটবেলা থেকে ধর্মীয় অনুশাসনে বড় হয় না। পরিবারে ধর্মের চর্চা সেভাবে দেখা যায়না। তারা ছোট থেকেই নানা রকম অপরাধের সাক্ষী হয়ে যায়। যার ফলে তাদের নৈতিক ও আদর্শিক ভিত্তি সেভাবে হয়ে উঠে না।

এজন্য আমি সমাজে অপরাধের প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার জন্য সর্বপ্রথম পরিবারকে দায়ী করবো। কারণ শিশুরা যদি পরিবার থেকে ধর্ম, আদর্শ ও নৈতিকতার শিক্ষা পেত, তাদের পরিবারে ধর্মচর্চা থাকত; কখনোই তারা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর ধর্ম থেকে নৈতিকতা ও আদর্শ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারতো না।

আধুনিক শিক্ষা কারিকুলামকেও আমি দায়ী করতে চাই। কারণ আধুনিক শিক্ষায় পর্যাপ্ত ধর্মীয় শিক্ষার অনুপস্থিতি। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। স্কুলগুলোতে ধর্মীয় শিক্ষক থাকলেও তারা সেভাবে ধর্মীয় সাবজেক্টগুলো গুরুত্ব সহকারে পড়ান না। এ কারণে আধুনিক শিক্ষাকে আমি বিশেষভাবে দায়ী করতে চাই। যদি বিদ্যালয়গুলোতে ধর্মীয় অনুশাসন, আদর্শের কথা ও নীতিবাক্য পড়ানো হতো; সমাজে এত অপরাধীর চেহারা দেখা যেত না।আমাদের দেশে পাশ্চাত্য-শিক্ষা বিকাশের পর থেকেই আমাদের সন্তানেরা ধর্মীয় শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। ধর্ম সম্পর্কে তাদের বিশেষ জ্ঞান থাকে না।

এজন্য আমি বর্তমান শিক্ষাকে ন্যায় বিচারের কাঠগড়ায় দাড় করাতে চাই। প্রশ্ন করতে চাই তোমরা শিক্ষা দিয়েছো, দীক্ষা কেন দাওনি? এবং আমি দায়ী করতে চাই বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থাকেও। কারণ তারা শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় শিক্ষা থেকে বঞ্চিত রেখেছেন। আমি শুরুতেই বলেছি একটা মানুষ পাপাচার থেকে দূরে থাকার জন্য সবচেয়ে বেশি জরুরি খোদাভীতি। আর রাষ্ট্র মানুষের অন্তরে আল্লাহর ভয় ঢুকিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়েছে। সুতরাং আজকের এই অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার জন্য যারা দায়ী তাদের অন্যতম হলো বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থা।

আওয়ার ইসলাম: ওলামায়ে কেরামের কোনরূপ অবহেলা বা দায়িত্বহীনতা আপনার চোখে পড়েছে কিনা? আজকে এই অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার জন্য ওলামায়ে কেরামও দায়ী কিনা?

মুফতি মাহবুবুর রহমান নবাবগঞ্জী: আলহামদুলিল্লাহ ওলামায়ে কেরাম দিনের কাজ করে যাচ্ছেন। এর মধ্যে কোনরূপ ভুলত্রুটি হচ্ছে না, আমি এ কথা বলব না। তবে তারা যথেষ্ট চেষ্টা করছেন। হয়তো তাদের চেষ্টা আরো বেশি হওয়া দরকার, সমাজের অপরাধ প্রবণতা রোধে তাদের ভূমিকা জরুরী। এ নিয়ে তারা মসজিদের মিম্বর, মাহফিলের মঞ্চ, খানকার চারদেয়ালে আলোচনা করছেন। মানুষকে বুঝাচ্ছেন। তবে তাদের কাজের মাঝে কোন ভুল ত্রুটি হচ্ছে না বা নিষ্কলুষভাবে তারা দায়িত্ব পালন করছেন এ কথা আমি বলব না। তাদের দায়িত্বশীলতা আরো বাড়িয়ে দেওয়া দরকার। জাতির পাশে দাঁড়ানো দরকার।

মানুষকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে ধর্মীয় অনুশাসনের আওতায় নিয়ে আসা প্রয়োজন। সুতরাং আমি বলবো ওলামায়ে কেরামের যেভাবে ভূমিকা রাখা দরকার আসলে সেভাবে তারা ভূমিকা রাখছেন না।

আওয়ার ইসলাম: এর থেকে উত্তরণের উপায় কী?

মুফতি মাহবুবুর রহমান নবাবগঞ্জী: এর থেকে উত্তরণের উপায় হচ্ছে, পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ রাষ্ট্র এবং সারা পৃথিবীতে নৈতিকতা ও পর্যাপ্ত ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। মানুষদেরকে কোরআন হাদিসের শিক্ষা সঠিকভাবে দিতে হবে। এবং এই ধর্মীয় শিক্ষার প্রয়োগ ভালো করে শিখিয়ে দিতে হবে।

অর্থাৎ শুধু শিক্ষা দিয়েই নয়, তা প্র্যাকটিক্যালি আমলে পরিণত করতে হবে। শিক্ষার পাশাপাশি আমলের চর্চা এ সমাজ থেকে অপরাধ চিরদিনের জন্য বিদায় করে দিতে পারে। আমি দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে এ কথা বলতে পারি- যদি কোরআন হাদিসের শিক্ষা সমাজের প্রতিটি অঙ্গনে ছড়িয়ে দেয়া যায় এবং আমলে রূপান্তরিত করা যায় তাহলে এই সমাজ সেই সোনালী যুগের মত হতে কালক্ষেপণ করবে না।

আওয়ার ইসলাম: আমাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

মুফতি মাহবুবুর রহমান নবাবগঞ্জী: আপনাকেও ধন্যবাদ


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ