শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৭ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১১ শাওয়াল ১৪৪৫


আব্বার স্বপ্ন ছিল একটাই, সবাই যেন দীনের ওপর থাকে: শাইখুল হাদিসের মেয়ে

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাওলানা আজিজুল হক থেকে শাইখুল হাদিস নামের হিমালয়সম কিংবদন্তি হয়ে ওঠা যারা কাছ থেকে দেখেছেন, হজরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী ও হাফেজ্জী হুজুরের মতো বুজুর্গদের স্নেহ ছায়ায় যাদের শৈশব কেটেছে, যৌবন থেকে জীবন সায়াহ্ন পযর্ন্ত শাইখুল হাদীস রহ. যাদের আগলে রেখে জীবন কাটিয়েছেন, তাদেরই একজন লুৎফুন্নেছা বিনতে শাইখুল হাদিস। জামিয়া রাহমানিয়ার মুহাদ্দিস মাওলানা এনামুল হকের সম্মানিত মাতা। শাইখুল হাদীস রহ. এর দ্বিতীয় কন্যা। প্রথম জীবনের সন্তান হওয়ায় অনেক কিছুর সাক্ষী তিনি। যুবক শাইখুল হাদীস কেমন ছিলেন, ব্যক্তিগত জীবনের নানা ঘটনাবলী, আদর্শ পরিবার গঠনে শাইখুল হাদীস রহ. এর ভূমিকা ও স্বপ্নের কথা জানতে তার সঙ্গে কথা বলেন মুহাম্মাদ এহসানুল হক। আলোচনায় উঠে আসে অনেক অজানা কথা। পাঠকদের জন্য থাকছে আলোচনার চুম্বকাংশ।


এহসানুল হক: শাইখুল হাদিস রহ. সম্পর্কে কিছু কথা জানতে চাই। তার ব্যক্তিগত জীবনের কিছু শিক্ষণীয় ঘটনা, তার পরিবার গঠনের পদ্ধতি ইত্যাদি কেমন ছিল?

বিনতে শাইখুল হাদীস: আব্বার ব্যাপারে কী বলবো! আব্বার ব্যাপারে যথার্থ কথা সেটাই যা আমিন মামা [প্রখ্যাত মুফাসসিরে কুরআন মাওলানা আমিনুল ইসলাম রহ.] বলতেন। আমিন মামা প্রায়ই বলতেন, ভাইসাবের মতো মানুষ আল্লাহ পাক দুনিয়াতে পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছেন। ভাইসাব, আল্লাহর ওলি। এমন মানুষ আর দুনিয়াতে নাই। আমি মনে করি, আব্বার ব্যাপারে এই কথাটাই যথেষ্ট। এর চেয়ে দামি কোনো কথা আমি বলতে পারবো না।

এহসানুল হক: তবুও কিছু কথা জানতে চাই। পরিবার গঠনের ক্ষেত্রে শিক্ষাদান অনেক গুরুত্বপূর্ণ, ছোটকালে আপনাদের শিক্ষাদান পদ্ধতি কী ছিল?

বিনতে শাইখুল হাদীস : আব্বার পড়ানো শুরু করার পদ্ধতি ছিল অনেক সুন্দর। আরবি হরফগুলো আলাদা করে কাগজে লিখতেন। আমাদের হাতে একটা করে দিতেন, একটা হরফ শিখতাম। মাদরাসা থেকে এসে খেতে বসার সময় হরফ লেখাগুলো নিয়ে বসতেন। আমাদেরকে একটা একটা করে দিতেন, কখনো সবগুলো আমাদের সামনে রেখে বলতেন, বলো কোনটা কোন হরফ, আমরা খুঁজে খুঁজে বের করতাম। এভাবেই আমরা আরবি বর্ণমালাগুলো শিখেছ্রে।

এহসানুল হক : খাবার খাওয়ার সময়টাও কাজে লাগাতেন?

বিনতে শাইখুল হাদীস : খাবার খেতে বসে শুধু আমাদেরই পড়াতেন না, লালবাগ থেকে ছাত্ররাও আসতো। আমিনী [মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহ.], আব্দুল হাই [মাওলানা আব্দুল হাই দা.বা.], আব্দুর রউফ [মাওলানা আব্দর রউফ দা.বা.] এর কথা মনে পড়ে। তারা এসে ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতো। আব্বা কখন খেতে বসবেন, সেই অপেক্ষা করতো। আমরা আব্বার কাছে খবর দিতে চাইলে মানা করতো, বলতো, হুজুর খেতে বসুক, তারপর যাবো। আব্বা খেতে বসলে তারা গিয়ে কিতাব পড়তো। পড়া শুনাতো, আব্বা ভুল ধরতেন, কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিতেন। এভাবে খাবারের সময়টাও আব্বাকে কাজে লাগাতে দেখেছি।

এহসানুল হক : আপনাদের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা কী ছিল?

বিনতে শাইখুল হাদীস : এখনকার মতো মেয়েদের নিয়মতান্ত্রিক পড়াশুনার ব্যবস্থা তখন ছিল না। হিফজ করারও প্রচলন ছিল না। এ জন্য প্রথম সময়ে আমরা কিছুদিন স্কুলে পড়েছি। আর হ্যাঁ, পাকিস্তান আমলের স্কুল কিন্তু বর্তমানের মতো ছিল না। স্কুলের পরিবেশ অনেক ভালো ছিল। আমরা বড় দুই বোন শুধু স্কুলে পড়েছি। আমাদের পরে আর কাউকে আব্বা স্কুলে দেন নাই। আব্বা তখন আমাদের স্কুলে দিলেও দিনের শুরুতেই স্কুলে পড়তে যাওয়া আব্বা পছন্দ করতেন না। আব্বা চাইতেন দিন শুরু হবে পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে। এ জন্য ফজরের সময় আমাদের উঠিয়ে লালবাগ মাদরাসায় নিয়ে যেতেন। লালবাগের দফতরে বসে আমরা কুরআন শরিফ পড়তাম। তারপর স্কুলে যেতাম। সেখানে হাফেজ্জী হুজুরের মেয়েদের সাথে দেখা হতো। সদর সাহেব হুজুর, হাফেজ্জী হুজুর, মুহাদ্দেস সাহেব হুজুরকেও দেখতাম।

এহসানুল হক :  মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ. চিনতেন আপনাকে?

বিনতে শাইখুল হাদীস : চিনতো মানে? হুজুরকে দাদা ডাকতাম। হুজুর অনেক স্নেহ করতেন। হুজুরের বাড়িতেও একাধিক বার আমি গিয়েছি। গওহরডাঙ্গা মাদরাসার মাহফিলে যাওয়ার সময় আব্বা আমাদের নিয়ে যেতেন। হুজুরের ছেলে ওমর [মাওলানা ওমর আহমদ রহ.] তখন ছোট। আর রুহুল আমিন [মাওলানা রুহুল আমীন দা.বা.] কে তখন কোলে নিয়েছি। বড় হওয়ার পর হুজুরের বিবি আমার সাথে হজের সফরে ছিলেন। আমাদের বাসায়ও এসেছেন।

এহসানুল হক : মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ. এর আর কোনো স্মৃতি মনে পড়ে?

বিনতে শাইখুল হাদীস : কত স্মৃতিই তো আছে। হুজুরের জন্য আমাদের বাসা থেকে খাবার যেতো। দীর্ঘদিন চলার পর আম্মার অনুপস্থিতিতে খাবার পাঠানো বন্ধ হয়ে যায়। তখন আমি স্বপ্নে দেখি একটা ঘর দেখিয়ে কেউ আমাকে বলছে তোমার আম্মার আমলের ঘরটা তোমরা বিক্রি করো না। আমি তখন অনেক ছোট, কি দেখলাম কিছুই বুঝিনি। ঘুম থেকে ওঠার পর আমি আমার বড় বোনের সাথে স্বপ্নের কথা বলছিলাম, সেটা আব্বার কানে গেল। তখন আব্বা এই স্বপ্নের তাবির নিয়েছিলেন এটাই হুজুরের খেদমত করার সুযোগ যেটা বন্ধ হয়ে গেছে, সেটা আবার চালু করা দরকার। এরপর থেকে নিয়মিত আবার আমাদের বাসা থেকেই হুজুরের খাবার যেত।

এহসানুল হক : আর হাফেজ্জী হুজুর রহ.?

বিনতে শাইখুল হাদীস : হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর সাথেও আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। তিনিও ছিলেন আব্বার মুরুব্বি। আমাদের পরিবারের যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ আয়োজনেই হুজুর থাকতেন। আমার বড় মেয়ের প্রথম সবক দিতে হুজুর আমার বাসায় এসেছেন। আমার বড় ছেলে এনাম কে প্রথম সবক দেয়ার সময়ও হুজুর এই শেখ সাহেব বাজারের বাসায় এসেছেন। আমরা সবাই হুজুরের হাতে বাইআতও হয়েছিলাম। হুজুর ছিলেন আমাদের পীর ও মুশির্দ।

এহসানুল হক :  দ্বীনদারি শিক্ষাদান পদ্ধতি কেমন ছিল? যেমন নামাজ শিক্ষা ইত্যাদি কেমন ছিল?

বিনতে শাইখুল হাদীস : নামাজ শিখানোর পদ্ধতিটাও সুন্দর ছিল। নামাজ এর রুকনগুলো আব্বা একটা একটা করে শিক্ষা দিয়েছেন, প্রথমে শুধু রুকুর দোয়া শিখালেন, এরপর শুধু সেজদার দোয়া, এভাবে একটা একটা করে যখন পূর্ণাঙ্গ নামাজ শিখেছি, তখন নামাজের আদেশ দিয়েছেন। এরপর যখন একটু বড় হয়েছি, আব্বা আমাদের জন্য আলাদা কাপড় কিনে দিয়েছেন। বলছেন, মা এখন বড় হইছোছ, এই কাপড় পরে নামাজ পড়বি। এখনো চোখে ভাসে প্রথমে সাদা রঙের একটা কাপড় কিনে দিয়েছিলেন।

এহসানুল হক : কথামতো কাজ না করলে কখনো শাস্তি দিতেন?

বিনতে শাইখুল হাদীস : আমরা আব্বার কথার খেলাফ কখনোই করতাম না। কথা না শোনার কারণে কখনই শাস্তি পেতে হতো না। আব্বা আমাদের পড়তে বসিয়ে বলতেন, তোরা পড়তে থাক আমি আসছি, আমরা বসেই থাকতাম, অথচ আব্বা চলে যেতেন মাদরাসায়। আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়া নিয়ে বসে থাকতাম। আমার অভ্যাস ছিল আব্বা যা বলতেন, আমি অক্ষরে অক্ষরে তা মানতাম। কখনই এর খেলাফ করতাম না। আমি সারা জীবনই এভাবে পার করেছি। এজন্য আব্বা আমাকে অনেক বেশি মায়া করতেন। তবে হ্যাঁ, ছোটকালের একটা কথা মনে পড়ে। একবার হাই তোলার সময় মুখে হাত না দেয়াতে শাস্তি দিয়েছিলেন। আরেকবার খাবার শেষে পানি ফেলার সময় দুটি ভাত পড়ে গিয়েছিল। সে জন্য আব্বা শাস্তি দিয়েছিলেন। খাবার অপচয়ের ব্যাপারে আব্বা অনেক কঠোর ছিলেন। কেউ খাবার নষ্ট করলে ভীষণ রাগ হতেন। জীবনে কখনো খাবার নষ্ট করতেন না, অন্যদের নষ্ট করতে দিতেন না।

এহসানুল হক : খাবারের বিষয়ে শোনা যায় তিনি অনেক ভোজন রসিক ছিলেন, কী খেতে পছন্দ করতেন?

বিনতে শাইখুল হাদীস : আব্বা সবসময় তাজা-সরস স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে পছন্দ করতেন। সারা জীবন নিজ হাতে বাজার করতেন। পায়ে হেঁটে চলে যেতেন মৌলভীবাজার। পছন্দমত বাজার করতেন, বাজারের ব্যাগ নিয়ে আবার হেঁটেই চলে আসতেন। বাজার খুব বেশি হলে রিকশা নিতেন। কোন খাবার কী দিয়ে রাঁধতে হবে সেটাও বলে দিতেন। কখনো মুরগি কুটার কাজও করেছেন। কোরবানির সময় এখনকার মতো কসাই আগে পাওয়া যেত না। কোরবানির গরুর গোশত কাটার কাজও আব্বা করতেন। আব্বা সব সময় নিজের কাজ নিজে করতে পছন্দ করতেন। হাদিসের মধ্যে আছে খাবারের দোষ তালাশ করা অনুচিত। আব্বার মধ্যে এই গুণটা ছিল। আব্বা কখনো খাবারের দোষ বর্ণনা করতেন না। খাবার পছন্দ না হলে কম খেতেন। কিন্তু দোষ বর্ণনা করতেন না। আব্বার জীবন ছিল হাদিসে রাসুলের উপমা। সারা জীবন হাদিস পড়িয়েছেন, আর সে অনুযায়ী আমলও করেছেন। শরিয়তের বরখেলাফ কোনো কাজ জীবনে করতে দেখিনি।

এহসানুল হক : ছোটকালের শিক্ষণীয় আরও কিছু বলুন?

বিনতে শাইখুল হাদীস : সব মেয়েদের এক সময় সংসার করতে হয়। আর কাজ না জানলে সংসার করা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। এজন্য আব্বা আমাদের কৌশল করে কাজ শিখাতেন। আমরা যখন অনেক ছোট, আমাদেরকে মাঝে মাঝে অল্প কিছু বাজার করে দিয়ে বলতেন, তোরা পিকনিক কর, আমিও তোদের সাথে খাবো। এতে আমরা আরও বেশি উৎসাহি হয়ে রান্না করতাম। আমাদের রান্না যেমনই হোক, আব্বা আমাদের সাথে খেতেন। খাবার স্বাদহীন হলেও কখনো কিছু বলতেন না। এখন বুঝি, সেটা ছিল আনন্দ দেয়ার ফাঁকে কাজ শেখানো। আব্বার শখ ছিল অনেক, স্বাদহীন, শখহীন মানুষ আব্বা ছিলেন না।

এহসানুল হক : কিছু শখের বর্ণনা দিলে ভালো হয়।

বিনতে শাইখুল হাদীস : আব্বার শখ ছিল অনেক। আমাদের সাজিয়ে রাখতে পছন্দ করতেন। খুব অল্প বয়সেই আমাদের স্বর্ণের জিনিস পরাতেন। গলার হার কানের দুল বানিয়ে দিতেন। বড় হলে সেটা আরও বড় ডিজাইন করে বানিয়ে আনতেন। বাইরে যাওয়ার সময় সেগুলো পরিয়ে নিতেন। মানুষ সাধারণত ছেলেদের নিয়ে মসজিদ মাদরাসায় যায়, কিন্তু আব্বা আমাদের নিয়ে মাদরাসায় যেতেন, মসজিদে যেতেন। এমনকি মাহফিলেও যেতেন। সন্তানদের কাছে রাখতে তিনি এতটাই পছন্দ করতেন। একেবারে শেষ জীবনে আব্বা যখন বিছানায় তখনও আমার চোখের চশমাটা পুরানো দেখে আব্বা বলছিলেন, কিরে এই চশমাটা কত দিন ধরে পরোছ? গলায় চেন না দেখলে বলতেন, গলার চেন কই? ছোটকালের ঈদের সময় সমস্ত কেনাকাটা তো আব্বাই করতেন। মেয়েদের সাজগোজ করার জন্য তো কত রকম জিনিস লাগে। আব্বা সব কিছু এনে দিতেন।

এহসানুল হক : ঈদের কোনো স্মৃতি মনে পড়ে?

বিনতে শাইখুল হাদীস : একটা ঘটনা মনে পড়ে। আমাদের দাদার বাড়ি ছিল তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া। ঈদের সময় আমরা সেখানে যেতাম। আমাদের ভালো কাপড় চোপর পরাতেন। স্বর্ণের অলংকারও পরাতেন। যাতায়াত করতাম ট্রেনে। বাসার কাছে যাওয়ার পর আব্বা আমাদের গলা থেকে স্বর্ণের অলংকারগুলো খুলে ফেলতেন। এর কারণ ছিল এই যে, সেখানে আরও যেসব আত্মীয় ছিলো, তাদের সবার কন্যাদের এ ধরনের অলংকার পরানোর স্বামর্থ ছিল না। আমাদের বয়সি চাচাতো বোনরা ছিল। ওদের এমন অলংকার ছিল না। আমাদেরটা দেখে যদি তাদের কষ্ট হয় এ জন্য আব্বা আমাদের গলা থেকে অলংকারগুলো খুলে ফেলতেন। আবার শখ ছিল অনেক। এ জন্য যাত্রাপথের সময়টাতেও অলংকার পরিয়ে রাখতেন।

এহসানুল হক : একটু ভিন্ন বিষয়ে বলি শুনেছি রাজনৈতিক বিভিন্ন সময়ে অস্থিরতার সময়ে শায়েখ আপনাদের বাসায় থাকতেন, সে সময়ের কোনো স্মৃতি মনে পড়ে?

বিনতে শাইখুল হাদীস : আব্বা বিভিন্ন সময়ই আমাদের বাসায় থাকতেন। স্বাধীনতার পরপর আমরা প্রথম বাসা নিয়ে ছিলাম সূত্রাপুরে। আব্বা তখন প্রায়ই থাকতেন আমাদের বাসায়। মাহফুজ তখন অনেক ছোট। মাহফুজও আব্বার সাথে প্রায় সময়ই আমাদের বাসায় থাকতো। ছোট সন্তানদের সাধারণত মায়ের সাথেই রাখা সুবিধা। কিন্তু মাহফুজ ছোটকাল থেকেই অনেক ভদ্র স্বভাবের ছিল। আব্বাই রাখতে পারতেন। এ ছাড়াও আরও অন্যান্য সময়ও এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে আব্বা আমাদের বাসায় থাকতেন। বাবরি মসজিদ লংমার্চের সময়ও আব্বা আমাদের বাসায় ছিলেন। এখান থেকে সমাবেশে যোগ দিয়েই আব্বা গ্রেফতার হয়েছিলেন।

এহসানুল হক : শায়েখের কারাবরণের কথা চলে আসলো, কারাগারের স্মৃতি কি মনে পড়ে?

বিনতে শাইখুল হাদীস : আব্বা যখন কারাগারে সেই সময়টা আমাদের জন্য ছিল অনেক কঠিন। আব্বা তো তিনবার কারাগারে গিয়েছেন। বিএনপি সরকারের আমলে আব্বাকে যখন কারাগারে নেয়া হয়, তখন পরিস্থিতি মোটামুটি ভালো ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের আমলে আব্বাকে যখন কারাগারে নেয়া তখন পরিস্থিতি খুবই খারাপ ছিল। আব্বাকে হত্যা মামলার আসামী করা হয়েছিল। কারাগারে আব্বার খুব কষ্ট হচ্ছে এমন সংবাদ আমরা পাচ্ছিলাম। আব্বা চার মাস জেলে ছিলেন, এর মধ্যে প্রায় তিন মাসই রোজা থেকেছি। চরম অতংকে আমাদের সময় কাটতো। আব্বার সাথে দেখা করতে জেলখানায় গিয়েছিলাম। সাথে ছিল আম্মা আর মাহবুব। প্রচন্ড ভিড়ের মধ্যে সামান্য একটু কথা হয়েছিল। আব্বাকে বলা হলো আপনার কারা মুক্তির দোয়ার জন্য সৌদির রিয়াদ থেকে প্রায় তিন শত লোকের একটা জামাত ওমরা করতে রওনা হয়েছে। এমন সংবাদ শুনে আব্বা আনন্দে চোখের পানি ছেড়ে দেন।

এহসানুল হক : পরিবার নিয়ে শায়েখের স্বপ্নের কথা শুনতে চাই...

বিনতে শাইখুল হাদীস : পরিবার নিয়ে আব্বার স্বপ্ন ছিল একটাই সবাই যেন দ্বীনের ওপর থাকে। সবাই দ্বীনি শিক্ষা অর্জন করবে, হাফেজ আলেম হবে, এরপর দ্বীনের খেদমত করবে। আব্বা চাইতেন পরিবারের সবাইকে একত্রে রাখতে। এটা আব্বার সবচেয়ে বড় স্বপ্ন ছিল। আমাদের বড় দুই বোনের বিয়ের পর আব্বা আমাদের একত্রে থাকার পরার্মশ দিলেন। সেমতে শেখ সাহেব বাজারে আমরা দুই বোন জমি কিনে বাসা করলাম। আমরা যখন একত্রে বসবাস করবো তখন অনেকেই আমাদেরকে বলতো দুই বোন এমন একত্রে থাকতে হয় না। এই কথা আব্বার কানে যাওয়ার পর আব্বা বললেন, দুই বোন যদি এক সাথে থাকতে না পারে তাহলে যেন জঙ্গলে গিয়ে থাকে। আব্বার উদ্দেশ্য ছিল আমরা একত্রে থাকলে আমাদের সন্তানরাও এক সাথে থাকবে। এক সাথেই বড় হবে। বাইরের মানুষের সাথে মেলামেশা কম হবে। সেই স্বাধীনতার আগ থেকে আমরা এক সাথে থাকা শুরু করেছি, এখনো আল্লাহ পাকের রহমতে সুন্দরভাবে এক সাথে আছি।

এহসানুল হক : শায়েখের সাথে হজের সফরের কথা শুনতে চাই

বিনতে শাইখুল হাদীস : আমার জীবনের প্রথম হজ আব্বার সাথে করেছি। ১৯৯৪ সনের কথা। তখন হজে এত মানুষের চাপ ছিল না। এত আগে সব ব্যবস্থা করতে হতো না। হজের অল্প কিছুদিন আগে শুনলাম আব্বা হজে যাবেন। এটা শুনে আমারও আগ্রহ হলো, আমিও প্রস্তুত হলাম। আব্বা শুনে খুশি হলেন, আমাকে বিভিন্ন দোয়া শিক্ষা দিলেন। আমার সম্পূর্ণ হজ আব্বা নিজে শিখিয়ে শিখিয়ে করিয়েছেন। আম্মা ও ছোট বোন মাসুদাও সাথে ছিল। তাওয়াফের সময়ে আমাদের সেন্ডেলগুলো কাঁধে ঝুলিয়ে আমাদের দুই বোনকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে তওয়াফ করিয়েছেন। প্রত্যেকটা তওয়াফ আব্বা এভাবে করিয়েছেন। একদিন আম্মার সাথে গিয়েছিলাম দেখে আব্বা ভীষণ চিন্তিত হয়েছিলেন। অনেক রাগ হয়েছিলেন। কত মায়া আমাদের করতেন তা বলে বুঝানো যাবে না।

এহসানুল হক : মায়া-মমতার কোনো ঘটনা জানতে পারি?

বিনতে শাইখুল হাদীস : আমার সন্তানের বাবা তখন টাংগাইল করোটিয়া কলেজের অধ্যাপক। সেখানে ক্লাসের জন্য থাকতে হতো। একবার তার বাসায় আসার দিন, বাসায় না এসে তাবলিগের জামাতে চলে গেলেন। তখন তো আর বর্তমানের মতো মোবাইল ছিল না। সবার ঘরে টেলিফানও ছিল না। ছোট কাকার ঘরে টেলিফোন ছিল। সেখানে তিনি ফোন দিয়ে বললেন, আমাদের বাসায় সংবাদটা জানানোর জন্য। কিন্তু কোনো কারণে আমাদের বাসায় আর সংবাদটা আসেনি। সময়মত তিনি বাসায় না ফেরায় সবাই চিন্তায় পড়ে গেল।

একদিন গেল, দুইদিন গেলো কোনো খবর নাই। সবাই অস্থির। এমন সময় আব্বাকে মাহফিলে নিয়ে যাওয়ার জন্য লোকজন এসে উপস্থিত। আব্বাকে আমরা কখনো মাহফিল মিস করে দেখিনি। কিন্তু সেদিন আব্বা বলে দিলেন, আমার মেয়েকে এ অবস্থায় রেখে আমার মাহফিলে যাওয়া সম্ভব না। আমি যেতে পারবো না। এমন ঘটনা আরও ঘটেছে।

একবার আমার দাঁতে প্রচন্ড ব্যাথা উঠল। আব্বা খবর পেলেন। কোনো ওষুধে ব্যাথা কমছে না। ব্যাথায় আমি যেন পাগল হয়ে যাই এমন অবস্থা। সেদিনও আব্বার মাহফিল ছিল। আব্বা মাহফিলে গিয়েছিলেনও। কিন্তু গিয়ে আর বয়ান করতে পারেননি। বলেছিলেন, আমার মেয়েকে যে অবস্থায় দেখে এসেছি আমার পক্ষে বয়ান করা সম্ভব না। এই কথা বলে চলে আসেন। এমন আরও কত ঘটনা আছে। কয়টা শুনাবো?

আব্বা আমাদের কেমন মায়া করতেন বলে বুঝানো যাবে না। ছোটবেলায় খালি পায়ে হাঁটলে বকা দিতেন যদি অসুস্থ হয়ে যাই। অসুস্থ হলে সব আব্বাই করতেন। মাথায় পানি দিতেন আব্বা। খাওয়াতেন আব্বা। কোনো ব্যাথা পেলে আম্মা বলে ডাক দেয়ার আগেই আব্বা এসে উপস্থিত হতেন। আব্বা অনেক ব্যস্ত মানুষ ছিলেন। কিন্তু কখনোই পরিবার বিমুখ ছিলেন না। পরিবারই ছিল আব্বার জীবন। আব্বা আমাদের জন্য মা-বাবা উভয়টাই ছিলেন।

মাসিক রাহমানি পায়গামের সৌজন্যে

আরএম/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ