বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ ।। ১৪ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৮ রমজান ১৪৪৫


বইকে ভালোবেসে ভুল করিনি ।। মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আমি বইকে বাঁধতে চেয়েছি সুন্দর একটি বিশেষণে। একজন বাদশাহ শাহজাহান যেমন বাঁধতে চেয়েছেন প্রিয়সী মমতাজকে তাজমহলের শ্বেত পাথরে- হয়তো তেমনি। মনের সিন্ধু সেঁচে তুলে এনেছি কতো মনোহর মনি মুক্তা-মানুষ যাকে শব্দ বলে। দেখেছি, আমার বইকে আঁকতে পারে না কেউ তার একক আরশিতে।

আমি বোকার মতো ভাবি আর অবাক হই। তিন দশক ধরে হৃদয়ের জারিত রসে হৃদয়ে পুষেছি যে বই- কখনো তো ভাঙতে চাইনি-কী তার গহন পরিচয়? কোন সখ্যে তারে ধরে রেখেছি পাঁজরের ভেতর? আজ যখন ভাঙতে গেছি বাঁধনের রহস্য- দেখি আমার সবটাই তার অধিকারে। আল্লাহর কালাম কোরআনকে যদি বই ধরি, প্রাণের শাহানশাহ প্রিয়তম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিস ভাণ্ডারকে যদি ধরি গ্রন্থিত ময়ূখরেখা- তাহলে তো বই ছাড়া আমি অন্ধ। বাবার মতো নিঃস্বার্থ রাখাল; মায়ের মতো মমতাময়ী পালিকা; শিক্ষকের মতো স্বাপ্নিক কৃষক; ভায়ের মতো আস্থাভাজন শুভার্থী; বোনের মতো কল্যাণ-বিলানে আকুল এবং প্রিয়সীর মতো বিজয় প্রত্যাশায় উন্মাদিনী- সে তো কেবল বই। পরম আস্থায় নিঃশঙ্ক উদারতায় নিজের ভেতরকার সবটুকু সুন্দর উপুর করে ঢেলে দেয়- এমন হিতৈষী বান্ধব জগতে আর কে? কী আশ্চর্য, শুধু দিতেই জানে। নিজের মধ্যে এইটুকু জমিয়ে রাখবার কোনো বিদ্যাই তার জানা নেই। যতই ভাবি, বইপোকা বইপাগল আর বইপ্রেমিক গোত্রের শব্দগুলো যেন সোনার পায়রা হয়ে চেতনায় পাক খেতে থাকে। মনে হতে থাকে- বইকে ভালোবেসে ভুল করিনি!

দুই.
স্বীকার না করে উপায় নেই, বইকে আমি ভালোই বেসেছি নাদানের মতো- ধারণ করতে পারিনি। কোনো ভালো মাখনমাখা গ্রন্থের নাম শুনেছি তো বরাবর ছুঁয়ে দেখার জন্য আকুল হয়েছি। আমার সৌভাগ্য- বইকে ভালোবেসে আমি ক্লান্ত হইনি! অবশ্য কৃষকের মতো আমারও স্বপ্ন আছে। ফলনের অভাবে মাঝেমধ্যে আমিও চুপসে যাই। আবার হতাশার বরফ থেকে আমাকে তুলে আনে আমার সেই আকৈশোর বান্ধব বই। তুলে এনে আবার বসিয়ে দেয় স্বপ্নের টেবিলে।

ভাষা ও বইয়ের মাস এই ফেব্রুয়ারিতে- বাংলা ভাষায়- আমার কিছু প্রিয় গ্রন্থের কথা বলতে চাই। নব্বইয়ের দশক আমার জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই দশকে আমি ভাবতে শুরু করি। জীবন স্বপ্ন গন্তব্য শপথ- এই কথাগুলো আমাকে আমার চলমান স্রোতের ভেতরই আলাদা করে তুলে। ক’জন বন্ধুর অনুগ্রহের কথা আমি ভুলব না। তারপরও আমাকে স্বপ্নহীন উদার স্রোতের মতো প্রচণ্ড কলরবে ছুটে চলা কাফেলা থেকে স্বযত্নে আলাদা করে দিয়েছিল সে আমার জীবনসারথী ‘বই’।

নাম করে বলি- বইয়ের নাম ‘আলোর পরশ।’ বয়সটা প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়ানোর। কৈশোর পার করছি। মেঘ-বিধৌত নির্মল আকাশের মতো স্ফটিক শুভ্র একটি মন নিয়ে ঢাকা এসেছি। মনটা যতটা না সাদা তারচে’ বেশি সবুজ। এই বিচিত্র নগরের সবকিছুই ভালো লাগে। আছে বিপুল বন্ধু এবং ঘুরে বেড়াবার আমন্ত্রণ। আমার সৌভাগ্য, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আমি ওই আমন্ত্রণকে উপেক্ষা করতে পেরেছিলাম। যে চিরশুভার্থী আমাকে দুই হাত ধরে ওই উদ্দেশ্যহীন দল থেকে তুলে এনেছিল, সে ‘আলোর পরশ।’ এখন হয়তো আমি সাহিত্য-বিচারে আলোর পরশকে মাথায় তুলতে পারব না। তারপরও বিনীতভাবে স্বীকার করি- এই বই আমাকে-

এক. পাঠক বানিয়েছে। দুই. শব্দের স্বাদ পেতে শিখেছি আমি এই বই থেকে এবং তিন. আমার সামান্য লেখক জীবনের অনুপেক্ষ উপাত্ত- শব্দভাণ্ডার- এর সঞ্চয়নের যাত্রাও এই বই থেকে। আমার লেখালেখি সাধনার অঙ্কুর কালে এই বই আষাঢ়ের বর্ষণের মতো শব্দে শব্দে পূর্ণ করে দিয়েছিল আমার ক্ষুদ্র আঁজলা। আমি তার সামান্যই যতনে তুলে রাখতে পেরেছি! এই বইয়ের সূচনা পৃষ্ঠা থেকে একটি প্যারা উদ্ধৃত করি- যারা পড়েননি- তাদের হয়তো ভালো লাগবে!

‘প্রায় চৌদ্দশত বৎসর পূর্বে এক কুরাইশ নওজোয়ান, অপরাহ্নে সেই গ্রামের অদূরে এক কাঁটাগুল্ময় প্রান্তরে মেষ চরাইতেছিলেন। যুবক সৈনিক পুরুষ- বয়স পঞ্চবিংশতির অনধিক, দীর্ঘায়ত দেহ, বলিষ্ঠ গড়ন- সুন্দর সুপুরুষ। মেষগুলিকে পাহাড়ের উপর হইতে নিম্নদেশে শ্যামল প্রান্তরের একাংশে তাড়াইয়া আনিয়া তিনি এক পাথরের উপরে বিশ্রাম করিতে বসিলেন। বসিয়া হস্তস্থির খর্জুর স্তবক হইতে এক একটি সুপক্ক খর্জুর বাছিয়া খাইতে লাগিলেন। যুবক অন্যমনস্ক, কি যেন চিন্তায় বিভোর। ঠিক সেই সময় পার্শ্বস্থিত খর্জুর ভীথিকায় বৃক্ষের আড়ালে দণ্ডায়মান এক অনিন্দ্য সুন্দরী যুবতী যুবকের খর্জুর ভক্ষণ দৃশ্য দেখিয়া মনে মনে হাতিসেছেন। উপরে শাখা প্রশাখার পত্রাবরণ ভেদ করিয়া এক ঝলক প্রখর রৌদ্র্র তরুণীর কুসুম দলবৎ গ-দ্বয়ে বিচিত্র রঙিন আভা ফুটাইয়া তুলিয়াছে। যুবকের মন অন্য দিকে। কাজেই তরুণীর আগমন তিনি বুঝিতে পারেন নাই।’ (আবুল হাশিম, আলোর পরশ : পৃ. ১১)

দুধের সরের মতন গদ্য। শব্দে শব্দে খেজুরের গুড়ের টাটকা ঘ্রাণ। মনে ‘মন’ থাকলে তারচে’ও বেশি কিছু। আমি ক্ষুধিত পান্থের মতো গিলেছি ওই শব্দের পায়েস। জাম্বিল ভরে নিয়েছি পথের সম্বল বলে। ঠিক এই সময়ই কে যেন বলল নজিবর রহমান সাহিত্যরত্নের ‘আনোয়ারা’র কথা। বড় মন দিয়ে পড়েছি। বাংলার বনেদি গল্প। ভাষা শব্দ ও অলঙ্কারের উপচে পড়া প্রাচুর্য। আর মুখ্যত তখন আমি শব্দের পাগল। অচেনা শব্দ যেন অচেনা ফুল। ফুলের সমস্যা হলো টাটকা থেকে বাসি হয়। শব্দের রূপ রস সুবাস কোনোটাই বদলায় না।

কেন যে আমি ওই শব্দকে ফুল ভেবে বিভ্রান্ত হয়েছি বলতে পারব না! মনে পড়ে, শূন্যের দশকের কথা। সমকাল মহাপ্রতাপে বাজারে এসেছে। শুক্রবারের সাহিত্যপাতা ‘কালের খেয়া’ সত্যিই ছিল অসাধারণ। বিষয় লেখা অলঙ্করণ- সব বিচারেই অনন্য। এক শুক্রবারের পাতায় আল মাহমুদের একটা গদ্য ছাপা হলো। বরাবরকার মতোই কবিতা ও সমকালীন সাহিত্যের গল্প। গদ্য সরল প্রাঞ্জল। পড়ছি না ঠিক- বাদাম ছড়ানো কোনো আইসক্রিমের মতো চেটে চেটে খাচ্ছি। হঠাৎ যেন রসনা নেচে উঠল পরম তৃপ্তিতে। ‘হরিণ-প্রেক্ষণ’- এর মতো অনাস্বাদিত শব্দের রসে! আমি জানতাম না- সতর্ক দৃষ্টি বোঝাবার জন্যে এত চমৎকার শব্দ আছে আমাদের ভাষায়! এই একটি শব্দ বন্ধু আমাকে অনেক দিন অধিকার করে রেখেছিল! জানি না এটা কত বড় অপরাধ- এই শব্দের নেশা আমি আজো কাটিয়ে উঠতে পারিনি!

তিন.
সবাই বলেন, সিলেবাস কেবলই হাঁটতে শেখায়। জ্ঞানের রাজ্যে পদার্পণ হয় সিলেবাসের পর থেকে। আমরা ‘মনীষী’ বলে যাদেরকে জানি ও মানি- তাদের ওই অবাককরা মনীষাও কিন্তু নির্মিত হয়েছে বইয়ের পাঠ থেকে। সিলেবাসে তুষ্ট কোনো ব্যক্তি অন্তত শিক্ষা চিন্তা ও রেনেসার আকাশে নক্ষত্র হয়ে পথ দেখিয়েছেন- জানি না এমন কোনো উদাহরণ আছে কিনা। বাইরের উপমা দেব না। বাংলা পড়তে গিয়ে জেনেছি এমন একজন বড় মনীষীর কথা বলি।

প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক। ছিলেন এদেশের জাতীয় অধ্যাপক। তার সম্পর্কে তার জীবদ্দশাতে অনেকেই লিখেছেন- অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক একজন বীজিত উপকথা- কিংবদন্তি। মানুষের মুখে মুখে তার পাণ্ডিত্যের নানা গল্প। শারীরিক সৌন্দর্যে তিনি উপমাময় ছিলেন না। বড় বাগ্মীও ছিলেন না। বইও লিখেননি জীবনে। নিজের নামের সঙ্গে তিন অক্ষরের একটি উপাধিও যুক্ত করেননি। অথচ চলমান বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপীঠসমূহের শ্রেষ্ঠ মনীষীদের অনেকেই একবাক্যে তার মেধা এবং ধী-শক্তির অনন্যতা স্বীকার করে নিয়েছেন। এদেশের তার কালের শ্রেষ্ঠ বিদ্বানজন তাকে চলন্ত বিশ্বকোষ বলেছেন। আমি প্রথমেই বলতে চাই- কিভাবে প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক এমন অবিসংবাদিত জ্ঞানতাপস হলেন? হুমায়ুন আজাদ তার সাক্ষাৎকার গ্রন্থে লিখেছেন- ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রজীবন শুরু হতে না হতেই একজন তাকে ঢুকিয়ে দিয়েছিল জ্ঞানের জগতে। একদিন তিনি পাঠাগারের বাইরের আলমারিগুলোর কাছে ঘুর ঘুর করছিলেন। যেখানে সারি সারি বইভরা আলমারি, সেখানে ঢোকার অধিকার ছিল না ছাত্রদের। তিনি তাকিয়ে দেখছিলেন বইয়ের আলমারিগুলো। বুড়ো লোকটি- যে ভেতর থেকে বই এনে দিত- জ্ঞানার্থী আবদুর রাজ্জাকের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকায়!

কী চাও, তাঁকে জিজ্ঞেস করে বুড়ো লোকটি।
বই পড়তে চাই! উত্তর দেন তরুণ ছাত্র আব্দুর রাজ্জাক।
ভিতরে ঢুইক্কা বই দেখতে চাও? বেশ দয়ালু কণ্ঠে জানতে চায় বুড়ো।
হ, ঢুকতে দিলে তো ভিতরে যাই। উত্তর দেন আব্দুর রাজ্জাক।

বুড়ো লোকটি তাকে নিয়ে যান ভিতরে- যেখানে শুধু বই আর বই। একটা বই দেখতে দেখতে আরেকটার দিকে চোখ পড়ে। সেটা দেখতে দেখতে চোখ পড়ে আরেকটার দিকে। কয়েক ঘণ্টা জ্ঞানের গুপ্ত কক্ষে পাগলের মতো কেটে যায় তার সময়। চারদিকে ছড়িয়ে আছে সোনা। তারপর নিয়মিত ঢুকতেন ওই গুপ্তধনের কক্ষে। পৃথিবী ও পাঠ্যসূচি ভুলে পড়তেন বই আর বই। (সাক্ষাৎকার : পৃ. ১৭)

এই গুপ্তধন অন্তরে ধরে পরিণত হয়েছিলেন তিনি দেশ ও জাতির মহান ও মহা ধনে। আমি বইয়ের কথা বলছি। আহমদ ছফা আমাদের বাংলা সাহিত্যের এক বিরলপ্রজ প্রতিভা। তিনি অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে নিয়ে লিখেছেন- ‘যদ্যপি আমার গুরু!’ ছফা অনেক বই লিখেছেন। তার বিখ্যাত উপন্যাস- ‘পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরান।’ তার এই উপন্যাস সম্পর্কে সমালোচকগণ তাদের অপার মুগ্ধতার কথা বলেছেন। তিনটি মতের কথা বলি। মনসুর মুসা- আমাদের বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক লিখেছেন- ‘বিভূতিভূষণের প্রায় আশি বছর আগে লেখা ‘অরণ্যক’ উপন্যাসের পর এরকম উপন্যাস লেখা হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। বইটির জাপানি অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ... বাংলাদেশের উপন্যাস লেখক ও উপন্যাস পাঠকেরা ছফার ‘পৃষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরান’ এর জন্যে গর্ববোধ করতে পারেন।’

কবি ও কলামিস্ট ফরহাদ মাজহার লিখেছেন- ‘প্রচ্ছদে প্রচারপত্রে লেখা হয়েছে ‘রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রে জীবনবোধের উন্মেষ এবং বিভূতিভূষণের প্রকৃতিনির্ভর রচনাসমূহে জীবনের যে উপলব্ধির বিকাশ- আহমদ ছফার এই লেখাটি একই গোত্রভুক্ত হয়েও স্বাতন্ত্র্যের দাবি করতে পারে। বলা বাহুল্য, ‘একই গোত্র’ জ্ঞান করচার এই মূল্যায়ন ঠিক নয়। এটি সম্পূর্ণ ভিন্নধরনের রচনা।

কিন্তু কতটা ভিন্ন ধরনের- সেই কথাটা পরিষ্কার করে বলেছেন কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অরুন সেন। তার ভাষায়- সত্যি মানতেই হয়। বিষয় ও প্রকাশভঙ্গিতে এর (পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরান) সঙ্গে তুলনা করা যায়- এমন বই অন্তত বাংলা ভাষায় নেই।’ আমার সৌভাগ্য- আমার যৌবনেই চিনতে পারি ছফাকে এবং তার সাহিত্যকর্মকে। তার এই অনুপম সৃষ্টিকর্মটিও অনেকবার অনেকভাবে পড়ার সৌভাগ্য হয় আমার। ছফাকে বলা হয়- লেখকের লেখক। তার পুষ্প বৃক্ষ পড়লে তা মানতেই হয়।

এরপরও আমি নির্দ্বিধায় স্বীকার করব- ‘যদ্যপি আমার গুরু’- আমাকে যেভাবে প্রীত মুগ্ধ আলোড়িত ও ভক্ত করেছে আর কোনো বই তা করেনি। এই বই যে উদারতায় পরিচয় করিয়ে দিয়েছে অসংখ্য কাজের বইয়ের সঙ্গে- সে কেবল একজন বিশালপাঠ শিক্ষকের পক্ষেই সম্ভব। তাছাড়া সত্যিকার অর্থে এটা কি মলাটবদ্ধ বইও তো নয়। আবার কথিত অর্থে প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাকের জীবনীও নয়। যে মাখন ভঙ্গিতে জ্ঞানতাপস আবদুর রাজ্জাককে তুলে এনেছেন লেখক- এটাও হয়তো আহমদ ছফার পক্ষেই সম্ভব! তাছাড়া- ‘চুমুক দিতে দিতে বললেন, সব সময় লেবু দিয়া চা খাইবেন, চায়ে যে দোষ আছে বেবাক একে করে কাইট্যা যাইব’- টাইপের ভাষার যে এতটা পাণ্ডিত্যপূর্ণ হতে পারে- তা তো কল্পনা করিনি কোনোদিন। এখান থেকে বুঝেছি, ভাষাটা মুখ্য নয়। বইয়ের তথ্য তত্ত্ব ও নির্দেশনাটাই বড়।

সম্ভবত এই বই পড়ার আগেই আল মাহমুদের একটি সাক্ষাৎকারে পড়েছিলাম- তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনি কার মতো লিখতে চেয়েছিলেন? আল মাহমুদ বলেছিলেন, আমি জসীমুদ্দীনের মতো মিষ্টি গদ্য লিখতে চাইনি; হুমায়ুন কবিরের মতো শক্তিমান গদ্যও লিখতে চাইনি। আমি চেয়েছি- আল মাহমুদের মতো লিখতে। সম্ভবত সেটা আমি পেরেছি।

এই সাক্ষাৎকার পড়ার পর আমি হুমায়ুন কবিরের ‘বাংলার কাব্য’ গদ্যগ্রন্থটি কিনে পড়ি। সত্যিই, শক্তি তার অসামান্য। আমার সাহিত্যবিষয়ক কোনো কোনো লেখায় তার উদ্ধৃতিও আছে। কিন্তু আলাদা করে জসীমুদ্দীন পড়া হয়নি। হয়তো আগে তাকে বিচ্ছিন্নভাবে পড়েছি বলে। কিন্তু ‘যদ্যপি’তে যখন পড়লাম- ‘রাজ্জাক স্যার বলেছেন, আমি জসীমুদ্দীনের লেখা খুব পছন্দ করি। আপনি তার আত্মজীবনী পড়েছেন?

আমি বললাম, ‘জীবন কথা’র কথা বলছেন স্যার? পড়েছি।
-গদ্যটি কেমন?
-খুব সুন্দর।
রাজ্জাক সাহেব বললেন, এ রকম রচনা সচরাচর দেখা যায় না।’ (যদ্যপি আমার গুরু \ পৃ.২২)

এখন আর দেরি করা যায় না। বইটি অনেক খেটেখুটে সংগ্রহ করি এবং এক পরীক্ষার ছুটিতে খুব মন দিয়ে পড়ি। সত্যিই গদ্য যেমন মেটে সুন্দর তেমনি মিষ্টিও। কোথায় যেন পড়েছিলাম অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছেন, মেটে গদ্য আমার পছন্দ। যদিও আমি জানি, কোনো দিন আমি তা লিখতে পারব না। ‘জীবনকথা’ পড়ার সময় বারবার মনে হয়েছে- এই তো মেটে গদ্য। প্রবাদ প্রতীম অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদও যার স্পর্শে কাতর। মিষ্টি গদ্যের কথা যখন এলো- এই বই থেকে এ বিষয়ে ক্ষুদ্র একটি উদ্ধৃতি দিই! ছফা লিখেছেন- ‘আমি কিন্তু স্যারকে হুমায়ূন আহমেদের প্রথম দিককার রচনার তারিফ করতে শুনেছি। একাধিকবার তিনি আমার কাছে বলেছেন- হুমায়ূনের লেখার হাতটি ভারি মিষ্টি। (ঐ : ৯৭)

হুমায়ূন আমার আগেই পাঠ্য ছিলেন। এই মূল্যায়নটুকু পড়ার পর বিশেষ করে তার আত্মজৈবনিক গদ্যগুলো খুব মন দিয়ে পড়েছি। সত্যিই তার গদ্য মিষ্টি এবং ভারি মিষ্টি।

মনে দুঃখ আছে টলষ্টয়ের ‘ওয়র অ্যান্ড পীস’ সম্পর্কে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের গভীর ভালো লাগার কথা লিখেছেন যত্নসহ। ছফার ভাষায়- ‘এই উপন্যাসে যুদ্ধের দৃশ্য কত নিপুণভাবে বর্ণিত হয়েছে, মানবচরিত্রের গভীরে ডুব দিয়ে টলষ্টয় কত বিশদভাবে ছোট বড় চরিত্র বিকশিত করে তুলেছেন, নিসর্গদৃশ্য, নরনারীর প্রেম- এসব টলষ্টয় যত মুন্সিয়ানাসহকারে এঁকেছেন- জগতের কোনো লেখকের সঙ্গে তার তুলনা চলে না।’ (ঐ : পৃ ৯৬)

এই বইটি আমি মন দিয়ে পড়তে পারিনি এবং সবটাও পড়িনি। যখনই মনে হয় দুঃখ লাগে। এক কথায় ইসলাম খৃষ্টান হিন্দুধর্ম পাকিস্তান আন্দোলন মুক্তিযুদ্ধ সোহরাওয়ার্দী বঙ্গবন্ধু নজরুল রবীন্দ্রনাথ ইশ্বরচন্দ্র বঙ্কিমচন্দ্র স্যাকুলারিজম সমাজতন্ত্র গান্ধী একে ফজলুল হক জিন্নাহ ভাসানী প্লেটো- আমাদেরকে স্পর্শ করে এমন বিপুল বিষয় মনোজ্ঞ ভঙ্গিতে উপস্থাপিত হয়েছে এই গ্রন্থে। এই বই পড়তে পড়তে যেমন বড়মানুষের সান্নিধ্যের স্বাদ পাওয়া যায় তেমিন দেশের এবং বিশ্বের খ্যাতিমান অনেক ব্যক্তি সম্পর্কে পাওয়া যায় নির্মল তীর্যক সব মন্তব্য। সাহিত্য বিশ্বাস মানবতা ভদ্রতা সামাজিকতা সামাজিক দায়বদ্ধতা দেশ-বিদেশের অর্থনীতি অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎসহ উপাদেয় কত তথ্য যে ছড়িয়ে আছে এই ক্ষুদ্র একশ দশ পৃষ্ঠার বইটিতে। (চলবে...)

-এএ


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ