মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৩ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ৭ শাওয়াল ১৪৪৫


বইকে ভালোবেসে ভুল করিনি (২য় পর্ব)

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন।।

লেখক বলে নয়- সময়কে জানতে হলে শুধু পক্ষের নয়, বিপক্ষকেও পড়তে হবে। বিশ্বাসের বিচারে যদি বলি তাহলে তো এই তালিকা অনেক দীর্ঘ। একজনের কথা বলি- হুমায়ুন আজাদ। মেধা ছিল, লেখার হাত ছিল। তবে চিন্তার আভিজাত্য এবং মানবিক ভদ্রতা ছিল না এইটুকু। তার ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’ বাংলা ভাষায় কিশোর সাহিত্যে হয়তো সর্বশ্রেষ্ঠ। তার সাক্ষাৎকারটির সুনাম শুনে সংগ্রহ করেছি। আমাদের ঢাকার সাহিত্যাঙ্গনের সবাই জানেন- ছফার সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল বরাবর সাপে নেউলে। তার ভাষায়- আমি এ সময়ের চারজন প্রধান বাঙালির সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম; আরেক জনের সাক্ষাৎকার নেওয়ার ইচ্ছেও ছিল। তার সে প্রধান চার বাঙালি হলেন- তার ভাষায়- আবদুর রাজ্জাক : এই সময়ের জ্ঞানতাপস; আহমদ শরীফ : পণ্ডিত ও বয়স্ক বিদ্রোহী; শওকত ওসমান : কথাসাহিত্যের পথিকৃত এবং শামসুর রাহমান : নিঃসঙ্গ শেরপা। আর যার সাক্ষাৎকার নিতে পারেননি, তিনি হলেন শিল্পী কামরুল হাসান।

আামর কাছে মনে হয়েছে এই সাক্ষাৎকার-গ্রন্থটি আমার পড়া দরকার। প্রথমত এই কারণে- এদেশের কথিত একশ্রেণির বুদ্ধিজীবীর কথাবার্তায় মনে হয়- বাঙালিবাদ একটি স্বতন্ত্র বিশ্বাস-ধর্ম বিশ্বাসের মতোই। পড়ে দেখি, ওই বাঙালিবাদের সেরাদের মত চিন্তা দর্শন ও আদর্শ কী! পড়লাম। পড়ে মনে হয়েছে- হুমায়ুন আজাদ সাক্ষাৎকার শাস্ত্রটাকে সত্যিই একটা নতুন আদল দিয়েছেন।

আমরাও চাইলে আমাদের ধারার মনীষীদেরকে ওইভাবে তুলে ধরতে পারি। অবশ্য তার জন্যে প্রয়োজন হবে- এক. সাক্ষাৎকার দাতা ও গ্রহীতার জ্ঞান চিন্তা ও আদর্শের- সমান সমান না হলেও- কাছাকাছি অবস্থান! দুই. পরস্পরের দীর্ঘ পরিচয় ও সান্নিধ্য। দ্বিতীয়ত তার গদ্য শক্তি। শব্দচয়ন, বাক্যনির্মাণ, যতি চিহ্ন এমন কি বিখ্যাত শব্দের বানানেও তার চোখে পড়ার মতো নিজস্বতা আছে। এই বিচারেও বইটি আমাকে উপকার করেছে। আমার মনে হয়, আমরা যারা সবিশেষ মিডিয়ায় কাজ করি- লেখালেখি, সংবাদপত্র কিংবা ওয়াজ-বক্তৃতা- তাদের মধ্যে পাঠ বৈচিত্র্য থাকা চাই। মানিত ইমাম, মনীষী ও প্রিয়জনদের পাশাপাশি মেধাবী শক্তিমান প্রতিপক্ষকেও পড়া উচিত। নইলে আমরা তুলনা করে কথা বলতে পারব না।

সাক্ষাৎকারটি পড়ার পর আমার কাছে মনে হয়েছে, হুমায়ুন সৎ তো ননই, তিনি খুব সাহসীও নন। আহমদ ছফা তো অনেক ঊর্ধ্বের- নির্মলেন্দু গুণের মতো সাহসও তার নেই। যারা এই সাক্ষাৎকার পড়েছেন এবং পড়েছেন গুণের ‘আমার কণ্ঠস্বর’- তাদের কাছে এর ব্যাখ্যা দেয়ার প্রয়োজন নেই। অথচ হুমায়ুন নিজেকে খুব সাহসী বলে বরাবর প্রচার করতেন।

আহমদ শরীফের কথা বলি। হুমায়ুন আজাদ তথ্য দিয়েছেন- আহমদ শরীফের আনুষ্ঠানিক পড়াশোনার দ্বিতীয় স্তর পড়েন চট্টগ্রাম পটিয়ার রাহাত আলী হাইস্কুল সংলগ্ন সোবহানিয়া মক্তবে। অবশেষে ১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় শ্রেণিতে চতুর্থ হয়ে এমএ পাশ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার আগে শিক্ষকতা করেছেন লাকশামের পশ্চিম গাঁও নওয়াব ফয়জুন্নেসা ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজে। কথা হলো, দ্বিতীয় শ্রেণিতে চতুর্থ হওয়া আহমদ শরীফ কীভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলেন? এর ইতিহাসও লিখেছেন হুমায়ুন আজাদ। আহমদ শরীফ হলেন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের ভাতিজা। ১৯৫০ সালে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে রেজিস্টারের মাধ্যমে আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের কাছে তার পুথিসমূহ কেনার আবেদন জানান। সাহিত্য বিশারদ বিক্রয়ের বদলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুথি দানকরার সিদ্ধান্ত নেন। তখন তিনি (আহমদ শরীফ) কাকা আব্দুল করীম সাহিত্যবিশারদকে একটি শর্ত দিতে বলেন- তা হচ্ছে আহমদ শরীফকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেয়া হয় এবং তিনি ১৯৫০ এর ডিসেম্বর মাসে ‘রিসার্চ এসিস্টেন’ হিসেব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগ দেন। (সাক্ষাৎকার : পৃ. ৩৭-৩৮)

তারপর ড. আহমদ শরীফ পণ্ডিত হয়ে ওঠার গল্প বলেছেন, বলেছেন বয়স্ক বিদ্রোহী হয়ে উঠার গল্প। ভাষার চাণক্য শব্দের কলতান আর জেদের পাথর- পড়বার সময়- চারদিকে ধুলো ওড়াতে থাকে। এটা হুমায়ুন আজাদের প্রায় সব লেখারই চরিত্র। আমার সৌভাগ্য, আমি জানতাম- ড. আহমদ শরীফ ছফারও শিক্ষক। ছফা তার সম্পর্কে লিখেছেন- ‘বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রফেসর রাজ্জাকের নামে একটি কথা চালু আছে। তিনি বলেছেন, মমতাজুর রহমান তরফদার হাফ স্কলার, আনিসুজ্জামান ফুল স্কলার এবং আহমদ শরীফ নো স্কলার।’ (উপলক্ষের লেখা : ১২৯ পৃ.)

আর আহমদ ছফা নিজের কথা লিখেছেন এইভাবে- ‘শিক্ষক হিসেবে শুরু থেকেই ড. আহমদ শরীফ খুব বিতর্কিত চরিত্রের অধিকারী হিসেবে কুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি আল্লাহ রাসুলের নামে রসিকতা করতেন, ধর্ম নিয়ে ব্যাঙ্গ করতেন। সব ধরনের কর্তৃত্ববাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে নিজেকে দাঁড় করিয়ে আনন্দ পেতেন। আমার ধারণা, ড. শরীফ আগাগোড়া একজন নৈরাজ্যবাদী চরিত্রের মানুষ ছিলেন। ... শরীফ সাহেবদের এই ধর্মবিরোধিতাকে আমি এক ধরনের মধ্যবিত্ত বিলাসিতা মনে করতাম।’ (ঐ : পৃ. ১২৩)

আরেকটি উদ্ধৃতি দিই। হয়তো কাজের। ছফা লিখেছেন- ‘স্যারের (ড. আহমদ শরীফ) খোশ মেজাজে আমি প্রসন্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এই জন্মদিনটিতে আপনার কাছে একটি আবেদন রাখতে পারি কি? স্যার বললেন, অবশ্যই পার। আমি বললাম, আপনি মোল্লা মাওলানাদের নিয়ে বকাবকি করবেন না। কারণ ওদের ক্ষ্যাপিয়ে কোনো লাভ নেই। বিশুদ্ধ জ্ঞানের আলো ছাড়া অন্ধকার দিয়ে অন্ধকার তাড়ানো যায় না। জ্বলন্ত আগুনে বাতাস দিলে তার পোড়াবার শক্তি বাড়ে। মোল্লা মাওলানাদের ধর্মান্ধতা আমাদের মৌলিক সংকট নয়। আমাদের মৌলিক সংকট হলো, আধুনিক ভাবনার দাবিদার মানুষদের অজ্ঞতা এবং আত্মপ্রতারণা। তারা এই দেশে নতুন কিছুই করতে পারেননি। নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকা দেয়ার জন্যে মোল্লা মাওলানাদের গালাগাল করার কাজটি করে থাকেন।’ (ঐ : পৃ. ১৩০-১৩১)

সত্যি কথা কি- আমি যদি ‘উপলক্ষের লেখা’ বইটি না পড়তাম তাহলে এদেশে মনীষা বলে পুজ্য অনেক ব্যক্তি সম্পর্কে মজার এবং কাজের অনেক তথ্যই হয়তো কোনো দিনই জানা হতো না। কী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কী কবি জসীমুদ্দীন, কী আল্লামা আবুল হাশিম আর কী শওকত ওসমান- যার সম্পর্কেই লিখেছেন মনের জাম্বিল উপুর করে লিখেছেন।

পাঁচ.
এখনো মনে পড়ে কী নিশ্চিদ্র মনোযোগে পড়েছি আলোর পরশ আর আনোয়ারা। এই সময়টাতেই হাতে পাই কলকাতার কবি আব্দুল আযীয আল আমানের রৌদ্রময় ভূখণ্ডের। ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত নবীজীবনের একগুচ্ছ দ্যুতিময় গল্প। ওই গল্পগুলো পড়ে শব্দের প্রতি মোহটা আরো বেড়েছে। এই সময়টাতেই নজরুল ও রবীন্দ্রনাথের নানা গল্প উপন্যাস কিনে পড়ি ফুটপাত থেকে। শিক্ষাজীবন অতঃপর শিক্ষকজীবনের প্রথম তিন চার বছর পর্যন্ত মৌমাছির নিবিষ্ট সাধনায় আমি ঘুরে বেড়িয়েছি, উড়ে বেড়িয়েছি এইসব ফুলে ফুলে।

১৯৯৫-৯৬ সালের কথা। কাগজে সরাসরি কাজ করবার সুবাদে দৈনিকের সাহিত্য পাতার সঙ্গে একটা নিয়মিত সম্পর্ক গড়ে উঠে। আর তখনই অন্য অনেকের সঙ্গে পরিচিত হই কবি আল মাহমুদ এবং বিদ্রোহী পণ্ডিত আহমদ ছফার সঙ্গে। বলতে গেলে এদের হাত ধরেই বেরিয়ে আসি আমার স্বপ্নের ও সখের তৈরি শব্দ-পুষ্পের কারাগার থেকে। আল মাহমুদের গদ্যগ্রন্থ ‘কবির আত্মবিশ্বাস’-এর কথা তো আমি কোনোদিন ভুলতে পারব না। ওই বইটা পড়ার পর সাহিত্যের গল্পসল্পের ব্যাপারটা যেন রক্তে ঘর পাতে। বাংলা ভাষার রচনা ধনে পাতা পেঁয়াজ ও সরষের তেলে মাখা মুড়ির ভর্তার মতো এমন সরল স্বাদ ও তৃপ্তিকর হতে পারে- কখনো ভাবিনি; আমি গদ্যের নতুন পাটাতনে এসে দাঁড়াই।

আমি আল মাহমুদের গদ্য এবং ছোটগল্প মন দিয়ে পড়তে থাকি। ওই সময়ে আব্দুল গাফফার চৌধুরী এবং আবেদ খানকেও বেশ পড়েছি। কিন্তু আল মাহমুদের পাশে আমার মন কবুল করেছে নির্মলেন্দু গুণ এবং রফিক আজাদকে। বিপদের কথা, ধীমান সৈয়দ শাসমুল হককে আমি যৎসামান্য পড়তে পেরেছি। কেন যেন বারবার আমার কাছে মনে হয়েছে- তার মধ্যে সাহিত্যিক সরলতা নেই। তার ভাব ও ভাষায় সৃজনশীলতার সঙ্গে কৃত্রিমতা চুইয়ে পড়ে। শব্দের ব্যবহার বাক্যের গড়ন ও অলঙ্কার স্থাপনে স্বভাব সাবলীলতার জায়গায় নিবিষ্ট চেষ্টা দৃশ্যমান। ফলে আমি তার বিচিত্র সৃষ্টি ও বুহমুখী প্রতিভায় বিশ্বাসী হয়েও ভক্ত হতে পারিনি। তার ওই ‘প্রণীত জীবন’ এর চাইতে ‘বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ’ ‘কোনো খেদ নেই’ এবং ‘আমার কণ্ঠস্বর’ আমার কাছে ঢের মধুর। অবশ্য শামসুর রাহমানের ‘কালের ধুলোয় লেখা’ নাগরিক গদ্যের অনন্য উদাহরণ। এখনো যখন অবসরে তার ‘স্মৃতির শহর’ নিয়ে বসি মনে হয় না- নাগরিক কিশোর গদ্যে এরচে’ ভালো রচনা হতে পারে। কবির গদ্যে অলঙ্কার কতটা জোছনা ছড়াতে পারে তার এক রূপস উপমা এই বই।

ছয়.
আমাদের সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ সৈয়দ মুজতবা আলী। শান্তি নিকেতনে রবীন্দ্রনাথের ছাত্র। তারপর পড়েছেন আলীগড়, আল-আজহার এবং বান ইউনিভার্সিটিতে। জ্ঞানের বহুবিচিত্র ধন সঞ্চয় করেছেন দেশে দেশে ঘুরে। সবটা জ্ঞানের তো নয়- তবে বিপুল দেশ ও ইতিহাসের যে সরস বর্ণনা তার ‘দেশে দেশে’ আছে- বাংলা সাহিত্যে তার উপমা আমার জানা নেই। কোনো এক সাহিত্যের আড্ডায় কথা উঠলো এই বইয়ের। কিন্তু খুঁজে পাই না কোথাও। মনে আছে- চট্টগ্রাম ঘুরতে গিয়ে আমি ও বন্ধু ফয়জুল্লাহ পুরনো এক বইয়ের দোকানে খুঁজে পেয়েছিলাম ওই বই। কী যে আবেগ নিয়ে পড়েছিলাম, এখনও পড়ি মন খারাপ হলে। ভাষায় লেখা মনে হয় না। মনে হয় চেনা অচেনা অজস্র ফুলের এক সুবাসিত কাজল। ইতিহাস দর্শন ও সভ্যতার বর্ণিল ওই ক্যানভাসে প্রবেশ করা যার স্বেচ্ছায়; কিন্তু বেরিয়ে আসা যায় না সহজে।

আরেকজন বিদ্বান মানুষ আমাদের দেশের খ্যাতিমান চিকিৎসক এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রফেসর এ কিই এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। পল্টনের ফুটপাত ধরে হাঁটছি। বইয়ের দোকানে উড়াল দৃষ্টিতে খুঁজছি প্রাণের আহার। দেখি কি- বি. চৌধুরীর ‘প্রবাসীর মন’। হাতে নিয়ে বললাম কত?
দশ টাকা!
কত?
দশ টাকা।

বি. চৌধুরী ছোট বাক্যের নিপুন শিল্পী। বলায়- লেখায়- দুটোতেই। এই বই ছোট বাক্য চর্চায় আমাকে হৃদয়বান সদাহাস্য চিকিৎসক বি. চৌধুরীর মতোই সাহায্য করেছে। কথা কি-বই-এই একটি ফুলের জন্যে বেঁচে থাকতে পারি হাজার বছর। ভাষার মধু খুঁজতে গিয়ে বইয়ের পাতায় পাতায়ই তো উড়ে বেড়ালাম বছর বছর। তৃষ্ণা শুধু বেড়েছেই। দীর্ঘ হয়েছে দেনার তালিকা। তারপরও বলি, বুদ্ধদেব বসুর ‘আত্মজৈবনিক’ যদি না পড়তাম তাহলে হয়তো আধুনিক গদ্যের সরটা আমার জিভের বাইরেই থেকে যেত। এই বইয়ের প্রতিটি বাক্যই আমাকে টেনেছে। এর কোনো কোনো প্যারা পড়ে আনন্দে অশ্রুসজল হয়েছি- গদ্য এত স্মার্ট স্বাদু এবং রূপস হয়!


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ