শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


ফোন পেলে প্রয়োজনে রাতের আঁধারে খাবার পৌঁছাবো: গাজী ইয়াকুব

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মহামারি করোনা ভাইরাসে আজ সারা বিশ্ব প্রায় অচল। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে এখন পর্যন্ত ৩৫ হাজারের বেশি মারা গেছে। আক্রান্ত হয়েছে সাত লাখের বেশি মানুষ। আমাদের বাংলাদেশও এখন প্রায় অচল। এই অবস্থায় অসহায় অবস্থায় দিন পার করছেন খেটে খাওয়া মানুষেরা। এই কঠিন মুহূর্তে অনেকেই এগিয়ে আসছেন এসব মানুষের সহযোগিতায়। দেশের আলেমরাও পিছিয়ে নেই এই সেবামূলক কাজে। রাজধানী ঢাকায় অসহায় মানুষদের জন্য যেসব আলেম রাতদিন এক করছেন, তাদের একজন মাওলানা গাজী ইয়াকুব। সেবামূলক এই কাজের নানা দিক নিয়ে তিনি কথা বলেছেন আওয়ার ইসলামের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আওয়ার ইসলামের ডেপুটি এডিটর আবদুল্লাহ তামিম।


আওয়ার ইসলাম: সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে, দেশ মানবতা ও দেশের কল্যাণে এ কঠিন পরিস্থিতিতে আলেমদের কী ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিৎ।

গাজী মাওলানা ইয়াকুব: আলেমরা জাতির রাহবার, তারা নায়েবে রাসুল সা. হিসেবে পরিচিত। নবিওয়ালা কাজে সবার আগে তাদের এগিয়ে আসা উচিত। তারা এগিয়ে আসছেও, দেশ জাতি ও সমাজে আলেমদের কাজ সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। বাংলাদেশ মসজিদ মাদরাসার দেশ। এখানে মিম্বার মেহরাব থেকে যে আওয়াজ তুলে সফলতা দেখাতে পারবে, মিডিয়াও অতটা সফলতা দেখাতে পারবে না।

সুতরাং আলেমরা এ জাতি ও দেশের জন্য মিম্বার থেকে আওয়াজ তুলতে পারবে। এ আওয়াজ প্রতিটি ঘরে, মহল্লায় পৌঁছে যেতে সময় লাগবে না। আজ আমাদের দেশসহ সারা বিশ্বে মহামারি এক আজাব গজব অবতির্ণ হয়েছে। এ যে করোনার মত মহামারি আমাদের জন্য একটা আজাব বা পরীক্ষা, এটা আলেমগণ জাতিকে ‍বুঝাতে সক্ষম হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের একটা শ্রেণি খুব অসহায় হয়ে পড়ে যখন লকডাউনের মত অবস্থার সৃষ্টি হয়। তাদের আয় ইনকাম যখন বন্ধ হয়ে যায় তখন তাদের অসহায়ত্ব আমরা দেখতে পাই না।

এ শ্রেণির মানুষ বাংলাদেশের অনেক অনেক বেশি। এ দেশের খেটে খাওয়া মানুষগুলোর সারাদিন পরিশ্রম শেষে রাতের বেলা অল্প কিছু বাজার নিয়েও বাড়ি ফেরাটা আর হয়ে ওঠে না। দেশের সরকার লকডাউন তো দিয়েছে, কিন্তু এ লকডাউন মানতে হলে তাদের পেটে তো খাবার থাকতে হবে। কথায় আছে ‘পেটে থাকলে পীঠে সয়’, পেটে না থাকলে পীঠে সইবে কী করে। তো সরকারের অনুদান সবার কাছে পৌঁছাতে অনেক সময় লাগে বা অনেক সময় পৌঁছায়ও না। সেজন্য আমরা যদি তাদের সামনে না দাঁড়াই তাহলে আজ মানবতা বিপন্ন হয়ে যাবে।

এজন্য আমরা প্রথমে দায়িত্ব নিলাম মসজিদে মসজিদে এ ভাইরাস থেকে বাঁচার বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করার। সে অনুযায়ী আমরা মসজিদে মসজিদে সচেতনতা তৈরি করি লিফলেট বিতরণ করে। আল্লাহ রাসূল সা. বলে গেছেন তোমরা পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা অবলম্বন কর। ঠিক মত অজু কর। আমরা পরিচ্ছন্নতার কথা চিন্তা করে ঢাকার প্রায় ২০০টি মসজিদে হ্যান্ডওয়াশসহ আরো যাবতীয় অনেক কিছু বিতরণ করি।

এছাড়াও আমরা ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ২৫০ প্রে মেশিন দিয়ে জীবানুনাশক ছিটিয়েছি। এ ক্ষেত্রে স্বেচ্চায় কাজ করেছে আমাদের ২৫০ স্বেচ্চাসেবী। আমরা ঢাকার বিভিন্ন এলকায় জোন জোন ভাগ করে এ স্প্রে এর কাজ করি। মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কেচি গেইটে রিক্সার প্যাডেলে গাড়ির দরজায়, রাস্তায়সহ যেখানে জীবানু থাকার সম্ভাবনা আছে সেখানেই আমরা স্প্রে করেছি।

এরপর আমরা ভাবলাম, আসলে অসহায় মানুষগুলোর জন্য শুধু জীবানুনাশক ছিটালেই তো হবে না। তাদের পেটেও তো কিছু দিতে হবে। তাই আমরা খাবার রান্না করে করে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার অসহায়কে দিলাম। প্রত্যেকদিন আমরা সাতশ’ থেকে আটশ’ খাবার প্যাকেট বিতরণ করলাম।

আওয়ার ইসলাম: এর আগে রোহিঙ্গাদের কঠিন মুহূর্তে তাদের শিবিরে আপনাকে আমরা বীরের বেশে পেয়েছিলাম। ডেঙ্গু কবলিত ঢাকাবাসীর পাশেও আপনাকে পেয়েছে ঢাকাবাসী। মিরপুরের মাদরাসার পুড়ে যাওয়ার ঘটনায় পাশে ছিলেন, মিরপুরের বস্তিতে আগুন লাগায় সেখানও আপনাকে দেখেছে ঢাকাবাসী। এখন করোনার এ কঠিন পরিস্থিতিতে আপনি ঢাকায় কী ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।

গাজী মাওলানা ইয়াকুব: করোনার এ কঠিন পরিস্থিতিতে আমরা ঢাকা শহরে বিভিন্ন ধরণের সেবামূলক কাজ করেছি। এখন আমরা প্রতিদিন প্রায় ২০০ পরিবারকে এক সপ্তাহ খাবারের জন্য চাউল, ডাউল ইত্যাদির খাবারের প্যাকেট দেয়ার কাজ হাতে নিয়েছি। এগুলো এরমধ্যে প্যাকেট করা শুরু করেছি। বিভিন্ন এলাকায় আমরা যাবো, টুকেন দিয়ে দিবো। আমাদের গাড়ি গেলে তারা টুকেন দেখিয়ে খাবারের প্যাকেট নিয়ে যাবে। আমরা প্রত্যেকদিনেই এ খাবার বিতরণ করবো।

কতদিন ধরে এ বিতরণের কাজ চলবে এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি কোনো মানুষের উপর ভরসা করি না। আমি উপরওয়ালার উপর ভরসা করি। আমি কারো কাছে হাত পাতি না। মানবতার সেবায় আমি যতদিন বাঁচি কাজ করে যাবো ইনশাআল্লাহ। আমার মাধ্যমে যদি কেউ গরীবদের সেবা করতে চায় আমি তাদের অনুদান যথাযথ পৌঁছে দেয়ার কাজ করি। কিন্তু কখনো কারো কাছে হাত পাতি না। আল্লাহ যেনো আমাকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের সেবা করার তাওফিক দেন। আমার জীবনে আমি যত টাকা ইনকাম করবো এর অর্ধেক আমি অসহায়দের জন্য দান করবো। সমাজের মানুষ ভাবে আলেমরা নিতে জানে দিতে জানে না। কিন্তু আজ আলেমরাই এগিয়ে আসছে অসহায়দের জন্য। সেটা জাতি জানুক আমি চাই।

আমরা ঢাকার গাবতলী, সায়দাবাদ, মহাখালী, আবদুল্লাহপুরের ব্রিজের বামপাশ থেকে শুরু করে কমলাপুর রেল স্টেশন, বাস স্টেশনগুলো মিরপুর মাজারের পাশ প্রতিদিন অসহায়দের মাঝে রান্না করা খাবার বিতরণ করছি। প্রতিদিন প্রায় ৭০০ প্যাকেট খাবার বিতরণ হচ্ছে এ স্পটগুলোতে।

আওয়ার ইসলাম: জনসভা কিংবা মিডিয়ায় আলেমদের সেবাগুলো উচ্চারিত হয় না। এর কারণ আপনি কী বলে মনে করেন?

গাজী মাওলানা ইয়াকুব: আসলে আমাদের কাজগুলো আমরা একমাত্র আল্লাহর জন্য করি, এজন্য কোথায় আসলো বা না আসলো সেগুলো আমাদের দেখার বিষয় না। তারপর দেখা যায় আমাদের কাজগুলো কোনো মিডিয়ায় প্রচার করে না। আলেমদের বরাবরের মতেই হেও করে দেখা হয়। তাদের মনোভাবই এমন যে তাদের কোনো কাজই আমরা তুলে ধরবো না। এক্ষেত্রে আমাদেরও ব্যর্থতা আছে। একতো আমাদের নিজস্ব মিডিয়া নেই। তবে সবচেয়ে বড় দুঃখের বিষয় হলো তারা এক প্যাকেট আটা দিয়ে দশ পত্রিকায় প্রচার করে। আর আমরা যদি এক লাখ টাকার জিনিসও বিতরণ করি এটা কোনো মিডিয়ায় আসে না।  আমি কখনো দেখিনি যে তারা আমাদের কাজ নিয়ে কোনো ডকুমেন্টারি তৈরি করছে। আমাদের আক্ষেপ আমাদের মিডিয়া নাই। তবে আমাদের এ কাজগুলো তুলে ধরার জন্য কোনো ভাই যদি এগিয়ে আসে আমরাও তাদের স্বাগত জানাবো।

আওয়ার ইসলাম আমাদের দেশের আলেম সমাজের এ শূণ্যতা পূরণের চেষ্টা করছে। আমরা আন্তরিকভাবে আওয়ার ইসলামের এ কাজকে স্বাগত জানাই। এ মিডিয়া আমাদের অঙ্গণকে আরো শক্তিশালী করুক এ কামনা করি।

আওয়ার ইসলাম: মানব কল্যাণমূলক এ কাজে আপনি কাদের কথা বিশেষভাবে স্মরণ করবেন, আপনার প্রেরণা কাকে বলে মনে করেন।

গাজী মাওলানা ইয়াকুব: আমি আমার কাজে প্রেরণা মনে করি রাসূল সা. কে। আর এ কাজের উদ্দিপনা পেয়েছি নিজে ভোক্তভুগী হয়ে। আমার বাবা একটি মাদরাসার মুহতামিম ছিলেন। কঠিন একটি বন্যার সময় আমাদের ঘরে একটি মোমবাতি পর্যন্ত কেউ দেয়নি। অথচ বিভিন্ন দলের কর্মীরা তাদের দলের প্রচারের জন্য মানুষকে দিয়েছে ফটোশুট করেছে। সেদিন থেকে আমি প্রতিজ্ঞা করেছি আমি মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের সেবা করে যাবো। আমি আল্লাহর হাজার শুকরিয়া জ্ঞাপন করি, আমি যতবড় কাজই হাতে নেই আল্লাহ সেটা আমার মাধ্যমে পুরণ করেন। আলহামদুলিল্লাহ।

আওয়ার ইসলাম: ঢাকা ও ঢাকার জনমানুষের সেবা করতে গিয়ে নতুন কী অভিজ্ঞতা চোখে পড়েছে, দুঃখী মানুষের গল্পগুলো আপনার কাছ থেকে শুনতে চাই। যেটা আপনি মানুষকে বলতে চান।

গাজী মাওলানা ইয়াকুব: আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, ঢাকা শহরের মাঝে সবচেয়ে কষ্টে আছে মধ্যবিত্ত মানুষগুলো।  উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্তরা ঠিক আছে। কিন্তু এ মধ্যবিত্ত মানুষগুলো নিজের অসহায়ত্বের কথা কাউকে বলতেও পারে না নিজেরাও সহ্য করতে পারে না। এজন্য তারা খুব কষ্টে দিনাতিপাত করছে।

আমরা তাদের জন্যই কাজ করবো ইনশাআল্লাহ। তাদের জন্য কাজ করতে গিয়ে আমরা কিছু পদ্ধতি অবলম্বন করছি। ব্যাক্তিগতভাবে আমরা খবর নিয়ে রাতের আধারে তাদের বাড়ী বাড়ী গিয়ে আমরা খাবার পৌঁছে দিবো। এক্ষেত্রে কোনভাবেই যেনো তাদের ফটো তোলা না হয় সেটাও খেয়াল করবো।

আমরা একটা প্ল্যান করছি, আল্লাহ তায়ালা যদি তাওফিক দান করেন এটা খুব শিগগিরই চালু করবো। ‘ওয়ান কল ওয়ান সার্ভিস’ আমাদের হটলাইন নম্বর থাকবে। কোনো অসহায় ফোন করলে প্রয়োজনে আমরা রাতের আধারে তাদের কাছে খাবার পৌঁছে দিয়ে আসবো।

আরেকটা প্ল্যান আছে আমার, আমি যেহেতু কওমি মাদরাসায় পড়াশোনা করেছি, আর কওমি মাদরাসাগুলোর অনেক এমন হয়েছে, করোনার ছুটিতে তাদের বেতন হাদিয়া দেয়া সম্ভব হয়নি। আমি যদি তাদের পেতাম তাহলে খামে করে তাদের জন্য হাদিয়ার ব্যবস্থা করতাম। এটা আমার একটা মনের তামান্না। কেউ যদি এমন থেকে থাকে, অবশ্যই বিশ্বস্ত মাধ্যমে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের অনুরোধ রইল।

এ সেবামূলক কাজে আমি একমাত্র আল্লাহ তায়ালাকে রাজি খুশি করার জন্যই করছি। আমার এছাড়া অন্য কোনো মাকসাদ বা উদ্দেশ্য নেই। আল্লাহ তায়ালা আমার এ কাজগুলোকে কবুল করুন। আমিন।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ