বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ ।। ১৪ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৮ রমজান ১৪৪৫


পঞ্চাশ বছর কাছ থেকে যেমন দেখেছি শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ. কে

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

২০১২ সনের ১৯ রমজান পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন উপমহাদেশের অন্যতম শীর্ষ হাদিস বিশারদ শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ.। আজকের এই দিনে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি এই মহান মনীষীকে। শাইখুল হাদিস রহ.এর জীবনের নানা দিক জানতে আজ আমরা কথা বলবো, শাইখুল হাদিস রহ. এর জামাতা প্রফেসর মোঃ নূরুল হক মিয়া এর সঙ্গে। তিনিও একজন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব। অধ্যাপনা করেছেন দেশসেরা প্রতিষ্ঠান সমূহে। দেশের প্রচীনতম বিদ্যাপীঠ ঢাকা কলেজের ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একজন আল্লাহওয়ালা কামেল মুবাল্লেগ। তাবলিগের পাবন্দ অনুসারী। ষাটের দশক থেকেই তিনি পরিবারের সদস্য হয়ে শাইখুল হাদিস রহ, কে কাছ থেকে দেখেছেন। সেই সব পুরানো দিনের কথা আজ আমরা শুনবো এবং সে অনুযায়ী জীবন সাজানোর চেষ্টা করবো। সাক্ষাৎকার গ্রহণ ও গ্রন্থনা করেছেন- তরুণ লেখক সম্পাদক মুহাম্মদ এহসানুল হক


আওয়ার ইসলাম: শাইখুল হাদিস রহ. এর সাথে আপনার প্রথম দেখা-সাক্ষাৎ কবে কিভাবে হয়েছিলো মনে পড়ে?

প্রফেসর মো. নূরুল হক মিয়া: হ্যাঁ মনে পড়ে। ১৯৬৪/৬৫ সনের কথা। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমেস্টির ছাত্র। ফজলুল হক হলে থাকি। আমাদের ডির্পাটমেন্টের পক্ষ থেকে মিলাদ মাহফিলের নামে একটি ইসলামি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। অনুষ্ঠানের আলোচক হিসেবে ঠিক করা হয় লালবাগ শাহি মসজিদের খতিব মাওলানা আমিনুল ইসলাম সাহেবকে।

আমি যেহেতু তাবলিগের সাথে জড়িত ছিলাম এজন্য আমাকে দাওয়াত দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়। আমরা যখন দাওয়াত নিয়ে মাওলানা আমিনুল ইসলাম সাহেবের কাছে গেলাম, তিনি আমাদেরকে বললেন, আপনারা আমাকে না নিয়ে আলোচক হিসেবে শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক সাহেবকে নিন।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রোগ্রাম এজন্য তিনিই বেশি উপযুক্ত। তিনি অনেক ভালো আলোচনা করেন। তিনি হলেই ভালো হয়। তখনই প্রথম শাইখুল হাদীস রহ. এর কথা শুনলাম। এর আগ পর্যন্তু হুজুর সম্পর্কে তেমন কোন ধারণা আমার ছিল না। এরপর আমরা লালবাগ মাদরাসায় গিয়ে হুজুরের সাথে সাক্ষাৎ করলাম। এভাবে হুজুরের সাথে আমার প্রথম দেখা।

আওয়ার ইসলাম: একজন কলেজ শিক্ষক হয়ে শাইখুল হাদীস রহ. এর সাথে আত্মীয়তা কিভাবে হলো? সংক্ষেপে আত্মীয়তার সূত্রটা যদি বলতেন।

প্রফেসর মো. নূরুল হক মিয়া: হুজুরের সাথে আত্মীয়তার তৈরির মাধ্যম হলেন মাওলানা গিয়াসুদ্দীন সাহেব। আমার পোস্টিং তখন লক্ষীপুর। আমাদের সাথের কেমেস্ট্রির লেকচারার ছিলেন মুর্তজা সাহেব। তিনি গিয়াসুদ্দীন সাহেবের পরিচিত ছিলেন। এই দুইজনই ছিল মাধ্যম। তারাই কথা শুরু করলেন, কিন্তু তখন কথাটা আর বেশি আগে বারেনি। আমি চলে গেলাম সিলেট এমসি কলেজে। পরবর্তীতে কথাটা আবার শুরু হয়। শাইখুল হাদীস রহ. এর সাথে যখন প্রথম দেখা করতে আসি তখন তিনি লালবাগ কেল্লার মসজিদে ইতিকাফে বসা। আমাকে বললেন, তুমিও আজকে থেকে যাও।

কিন্তু আমার বাবা অসুস্থ ছিলেন। আমি বললাম, আমার বাবাকে এমন অসুস্থ রেখে আমার জন্য এখানে কঠিন। আমি চলে এলাম। পরবর্তীতে কথা আগালো। তিনি আমাকে গ্রহণ করলেন। আসলে তখন আমার তেমন কিছু ছিল না। কলেজে শিক্ষকতা করেও পরিপূর্ণ দ্বীনের উপর থাকার কারণেই তিনি আমাকে গ্রহণ করেছিলেন।

আওয়ার ইসলাম: পরবর্তী সময়ে তো হুজুরের সাথে ইতিকাফ করেছেন?

প্রফেসর মো. নূরুল হক মিয়া: আব্বার সাথে দীর্ঘদিন ইতিকাফে বসার সুযোগ হয়েছে। লালবাগ কেল্লার মসজিদে তিনি এক সময় খতিব ছিলেন। আজিমপুর ছাপড়া মসজিদের আগে তিনি সেখানে জুমা পড়াতেন। ঐ মসজিদেই তিনি নিয়মিত প্রতি বছর রমজানের শেষ দশদিন এতেকাফে বসতেন। বহুবছর আব্বার সাথে ইতিকাফে বসেছি। অনেক সময় দেখা যেত যে তিনি নিয়মতান্ত্রিকভাবে বসতে পারছেন না।

মাদরাসার কাজে বাইরে যেতে হচ্ছে কিন্তু তারপরও কাজ শেষ করে আবার মসজিদে চলে আসতেন। বাসায় যেতেন না। এভাবেই ইতিকাফ করতেন। আব্বা ছোট সন্তানরা মাঝে মধ্যে আসতো পড়তে। মাহফুজকে তখন আব্বা পড়াতেন এটা মনে আছে। বাকি সময়টাতে তিনি প্রচুর এবাদত করতেন। নামাজে তিলাওয়াত করতেন অনেক। তিনি যে কত বড় বুযুর্গ ছিলেন তা আমরা অনুধাবন করতে পারিনি।

আওয়ার ইসলাম: প্রথম জীবনের কথা যদি একটু শুনাতেন?

প্রফেসর মো. নূরুল হক মিয়া: স্বাধীনতার পরপর আমরা সূত্রপুর বাসা নিলাম। আর গিয়াসুদ্দীস সাহেব বাসা নিলেন লালবাগ নূরফাতাহ লেন। এই দুই বাসায় আব্বা থাকতেন। তখনকার অনেক ঘটনা আছে। ছয় সাত মাস ছিলেন। এরপর চলে গেছেন বরিশাল মাহমুদিয়ায়। কিছুদিন পর আবার লালবাগে ফিরে এসেছেন। এর কিছুদিন পর আমরা আজিমপুর শেখ সাহেব বাজারে এক সাথে বাড়ি করলাম।

আওয়ার ইসলাম: এই এক সাথে বাড়ি করার উদ্দেশ্য কি ছিল?

প্রফেসর মো. নূরুল হক মিয়া: উদ্দেশ্য ছিল একটাই সন্তানদের দ্বীনের উপর রাখা। আব্বা চিন্তা করলেন আমাদের সন্তানরা যদি অন্য মানুষদের সাথে থাকে তাহলে তারা দ্বীনের উপর থাকতে পারবে না। অন্যদের সাথে মেলামেশা করলে তাদের মত হবে। আমাদের সন্তানরা যেন নিজেরা নিজেরাই থাকতে পারে, বাইরের বন্ধু বান্ধবের সাথে মিশতে না হয় এজন্যই মূলত এক সাথে বাসা করা হয়েছে।

আব্বার একটা অংশ, আমাদের একটা অংশ, আর গিয়াসুদ্দীন সাহেবের একটা অংশ। আমরা তিনজন মিলে একটা জমি কিনলাম, একসাথে বাড়ি করলাম। প্রথম যখন আমরা এই বাড়িতে উঠি। আব্বা হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. কে আমাদের বাসায় নিয়ে আসেন দোয়ার জন্য। হুজুর আসছেন। দোয়া করে গেছেন।

আমরা যখন এক সাথে বাসা করি তখন বাইরের কেউ কেউ নাকি আব্বার কাছে গিয়ে বলেছিল যে, বোনরা এমন এক বাড়িতে থাকা ঠিক না, মিল মিশ করে থাকা কঠিন। এই কথা শুনে আব্বা বলেছিলেন যে, “দুই বোন যদি এক সাথে থাকতে না পারে তাহলে জঙ্গলে গিয়ে থাকুক” সেই যে এক সাথে থাকা শুরু করলাম, আল্লাহর মেহেরবানিতে আজও আমরা এক সাথে আছি।

আওয়ার ইসলাম:  পারিবারিক জীবনের বিশেষ কোন স্মৃতি কি মনে পড়ে?

প্রফেসর মো. নূরুল হক মিয়া: অনেক ঘটনাই তো ছিল। এখন তো সে সব স্মরণ নেই। আমারও তো বয়স অনেক হয়েছে। একটা ঘটনা মনে পড়ে। আমি তখন টাংগাইল করোটিয়া কলেজের অধ্যাপক। বৃহস্পতিবার আমার টাংগাইল থেকে বাসায় আসার কথা। কিন্তু যে কোন কারণেই হোক আমি টাংগাইল থেকেই তিন দিনের জামাতে যাওয়া ঠিক করলাম। এখন ঢাকায় তো খবর পাঠাতে হবে। কিভাবে খবর দিবো।

তখন টেলিফোনেরও তেমন প্রচলন ঘটেনি। আমাদের ঘরে তখন ফোন ছিল না। কাকি আম্মার (শাইখুল হাদীসের ছোট ভাইয়ের) ঘরে ফোন ছিল। আমি সেখানে ফোন করে বললাম যে, আমি আজকে ঢাকায় আসবো না। তিনদিনের জামাতে যাবে। খবরটা রুমির আম্মাকে দিয়ো।

ঘটনাক্রমে ফোনটা পড়েছিল হাফিজের (শাইখুল হাদীসের ভাতিজা) নতুন বউয়ের হাতে। ও তো কিছুই বুঝেনি। কাউকে খবরটাও দেয়নি। ওদিকে বাসার সবাই পেরেশান হয়ে গেল। রাতও পার হয়ে গেল আমি বাসায় ফিরিনি। বাসায় তখন খাওয়া-দাওয়া বন্ধ এমন অবস্থা। রুমির আম্মা অস্থির হয়ে আব্বার কাছে গেলেন। গিয়ে বললেন, গতকাল থেকে রুমির আব্বার কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না, গতকাল বাসায় ফিরার কথা এখনো আসেনি।

আব্বার তখন কোথায় যেন মাহফিল। কেবল রওনা হচ্ছেন। হুজুরকে নিতে লোকজন এসে গেছে। এমন সময় আসলো এই খবর। আব্বা মাহমুদকে তৎক্ষনাৎ টাংগাইল পাঠিয়ে দিলেন আমার খোজঁ নিতে। আর আব্বা মাহফিলের উদ্দেশ্যে রাওনা হয়ে গেলেন। যেহেতু লোকজন এসে পরছে আব্বাকে নেয়ার জন্য।

মাহফিল স্থলে পৌছে যথারীতি বয়ান করতে স্টেজে উঠলেন। কিন্তু মনের অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে, কোন বয়ান করতে পারলেন না। মাইকের সামনে বসেই বলেন, আমি আজকে বয়ান করতে পারবো না। আমার মেয়েকে যে অবস্থায় দেখে আসছি। আমি আর থাকতে পারতেছি না। একথা বলে তিনি উঠে চলে আসেন।

ওদিকে মাহমুদ টাংগাইল থেকে খবর পাঠালো আমি তিনদিনের জামাতে আছি। এই ঘটনায় আব্বা আমার উপর ভীষন রাগ হয়েছিলেন। রুমির আম্মাকে আব্বা বলেছিলেন, ‘এই তিনদিনে তোর যে ক্ষতি হইছে এটা পুরা করতে দুই বছর লাগবো, আর আমার যে ক্ষতি হইছে এটা পুরা করতে ছয় মাস লাগবো’ এত ব্যস্ত মানুষ। তারপরও সন্তানের প্রতি কি মুহাব্বত রাখতেন তার কোন তুলনা নেই। এমন আরও ঘটনা আছে।

আওয়ার ইসলাম:  আরও একটি ঘটনা শুনতে চাই।

প্রফেসর মো. নূরুল হক মিয়া: আমার পোস্টিং তখন সিরাজগঞ্জে। রমজানের শেষ দিকের ঘটনা। সামনে ঈদ। ঈদ আমি বাড়িতেই করতে হবে, কারণ বাড়িতে আব্বা অসুস্থ। ঢাকায় এসে ঈদের কিছু কেনাকাটা করে ২৬ রোজায় আমি বাড়িতে চলে গেলাম। বাড়িতে গিয়ে আমি ভীষন অসুস্থ হয়ে পরলাম।

তখন কলেরা হলে কেউ বাচঁতো না। যদি আমার কলেরা হয়নি। কিন্তু তারপরও সবাই খুব ভয় পেয়ে গেল। ঢাকায় সংবাদ দেয়া হলো। রুমির আম্মাকে নিয়ে শাইখুল হাদীস সাহেব শ্রীপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। বাড়ির অবস্থা তখন খারাপ। ঈদের মাত্র দুই দিন বাকি। তিনি নিজের মেয়েকে কেমনে এ অবস্থায় ফেলে যাবেন বা আমাকে এ অবস্থায় ফেলে কেমনে মেয়েকে নিয়ে যাবেন। দোটানায় পরে গেলেন।

অনেক চিন্তাভাবনা করে তিনি সবাইকে বললেন যে, আমি ওরে ঢাকায় নিয়ে যাই। ঢাকায় গিয়ে চিকিৎসা করাই। তখন আমার দাঁড়ানোরও শক্তি নাই। আমাকে ট্রেন পযর্ন্ত শোয়ায়ে নিতে হবে। ভ্যান বা ঠেলাগাড়িতে করে আনতে হবে। ঠেলা গাড়ি কে ঠিক করবে। বাড়ির কেউ ঠিক করে দেয় না। কারণ ঈদের আগের দিন আমি ঢাকায় চলে আসি এটা তারা পছন্দ করছিল না। এজন্য কেউ সহযোগীতা করলো না। তিনি নিজেই ঠেলাগাড়ি ঠিক করলেন। আমাকে নিয়ে ঢাকার পথে রওনা হলেন।

ঢাকায় আসার পর আরেক ঘটনা ঘটলো। ঈদের ঈদের নামাজ পড়ে বাসায় ফিরলাম। যেই মাত্র আমরা সবাই খাবার খেতে বসছি এমন সময় আমার আম্মা শ্রীপুর থেকে হাজির। এসে দেখেন আমি নতুন কাপড় পরে খাবার খেতে বসছি। তিনি খুব রাগি মানুষ ছিলেন। বললেন, ‘ও তুমি শশুর বাড়িতে ঈদ করার জন্য এই ভং ধরছিলা তাই না’ এই কথা বলে সিড়ি থেকেই আবার শ্রীপুরের পথে রওনা হয়ে গেলেন।

আর কোন কথাও বললেন না, ঘরেও ঢুকলেন না। বাসার আনন্দঘন পরিবেশটা মাটি হয়ে গেল। কেউ তখনও খাবার মুখে দেয়নি। তিনি আবারও রুমির মা ও আমাকে শ্রীপুরের পথে রওনা হলেন।

আওয়ার ইসলাম: এছাড়াও কি কখনো আপনাদের বাড়ি গিয়েছেন তিনি?

প্রফেসর মো. নূরুল হক মিয়া: হুম। বেশ কয়েকবার গেছেন। একবার কথা মনে পড়ে। আমাদের পার্শবর্তি গ্রাম লতিফপুরে একটা কওমি মাদরাসা ছিল। মাদরাসাটার অবস্থা ভালো ছিল না। কোনভাবেই দাঁড়াতে পারছিল না। তারা চিন্তা করলো মাদরাসায় একবার শাইখুল হাদীস সাহেবকে নিয়ে আসি তাহলে হয়তো এর বরকতে মাদরাসা চালু হবে। যাইহোক হুজুরকে আনা হলো, তিনি সবাইকে আবার মাদরাসা নতুনভাবে চালু করার পরামর্শ দিলেন। সেমতে তারা মাদরাসা চালু করলো। আল্লাহর মেহেরবানিতে মাদরাসাটা এখনো চলছে।

চকবাজার মসজিদের মুয়াজ্জিন সাহেবের কাছে একটা ঘটনা শুনেছিলাম। এক পুলিশের বাসায় জিনের উপদ্রব ছিল। তারে কে যেন পরামর্শ দিলো আপনি আপনার বাসায় একদিন শাইখুল হাদীস সাহেবকে আনেন।

তিনি একবার আপনার ঘরে এলে এই সমস্যা থাকবে না। কিন্তু এই পুলিশ হুজুরকে তার বাসায় কেমনে নিবে। তো সে এক মাওলানা সাহেবকে গিয়ে ধরলো, যে আপনি হুজুরকে দাওয়াত করেন, তখন হুজুর আমার বাসায় আসবে। আল্লাহর কি কুদরত ঠিকই শাইখুল হাদীস সাহেব যাওয়ার পর থেকে আর কোন সমস্যা হয়নি। সে আমাকেও বলতো যে আপনি আপনার বাড়ির মাদরাসায় একবার হুজুরকে নিয়ে যান। হুজুর শুধু বসে থাকবে কিছু করবে না। তাতেই মাদরাসা চালু হয়ে যাবে। কিন্তু আব্বা তখন অনেক বেশি দুর্বল হয়ে পরেছেন তাই আর নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি।

আওয়ার ইসলাম: আপনার সাথে সর্ম্পক কেমন ছিল?

প্রফেসর মো. নূরুল হক মিয়া: আব্বা আমাকে অনেক স্নে হ করতেন। বাসায় গেলে খাওয়া-দাওয়ার প্রতি খুব খেয়াল রাখতেন। এমন হয়েছে যে, বাসায় গিয়ে দেখি আব্বা অসুস্থ। শোয়া থেকে উঠতে পারছেন না। কিন্তু তারপরও আমার খেয়াল করতেন। আমাকে একটা কথা প্রায়ই বলতেন, আমাকে বলতেন, “তোমার দ্বারা আমার সম্মানের মধ্যে এযাফা (বৃদ্ধি) হইছে” এই কথাটা তিনি আমাকে মাঝে মধ্যেই বলতেন।

আওয়ার ইসলাম: এইকথা বলার কারণ?

প্রফেসর মো. নূরুল হক মিয়া: কেমেস্ট্রি প্রফেসর হিসেবে সারা দেশে আমার সুনাম ছিল। হাজার মানুষের মধ্যে আমার বইটা ছিল সেরা। ২৮ বছর সারা বাংলাদেশে এককভাবে আমার বই চলেছে। ইন্টারের রসায়ন বইটা আমাকে কি পরিমাণ সম্মান এনে দিয়েছিল তা কল্পনাতীত। আমি তাবলিগের সাথে জড়িত।

তিনদিনের জামাতে বা চিল্লায় যেতাম। এই উসিলায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাওয়া হতো। যেখানেই যেতাম মানুষ ভীড় করতো আমাকে দেখার জন্য। মসজিদ থেকে বের হলে দেখতাম কলেজের ছেলে মেয়েরা দাঁিড়য়ে আছে আমাকে এক নজর দেখার জন্য। এক বার পটুয়াখালী গেলাম সেখানকার সাইন্সের ছেলেরা এসে আমাকে নিয়ে গেল তাদেরকে একটা ক্লাস করানোর জন্য।

ঢাকার নামকরা মেয়েদের কলেজ হলিক্রসে একবার গেলাম, মেয়েরা লাইন ধরলো আমার অটোগ্রাফ নেয়ার জন্য, নটরডেমে গেলাম সেখানেও একই অবস্থা। যেই কলেজেই যেতাম সেখানেই এই অবস্থা হতো। কি পরিমাণ সম্মান আল্লাহ আমাকে দিয়েছিলেন তা বলে শেষ করা যাবে না। এ জন্যই আব্বা আমাকে ঐ কথাটা বলতেন।

মানুষের কাছেও আব্বা বলতেন, “আমার মেজো জামাই ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপাল” এই বইয়ের টাকা দিয়েই প্রথম হজ্বে গেলাম ১৯৭৭ সনে। হজ্বে সরকারী খরচ ছিল তখন ১৮ হাজার তিনটা। তখন মক্কা মদিনায় এখনকার মত সুযোগ সুবিধা ছিল না। আধুনিক সাজসজ্জা ছিল না। আগের যুগের কিছু নমুনা তখনও অবশিষ্ট ছিল। এখন তো সব মিটে গেছে। যখন দেশে ফিরে আমাকে আনতে ইয়ারপোর্টে আব্বা গিয়েছিলেন।

আওয়ার ইসলাম: ঈদের নামাজের একটা ঘটনা শুনেছিলাম আপনার কাছে। আবার যদি বলতেন।

প্রফেসর মো. নূরুল হক মিয়া: আওয়ামী লীগ সরকারের আগের আমলের কথা। বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় সরকারের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন করছে। আব্বা চারদলীয় জোটের শীর্ষনেতা। মাঠে ময়দানের আওয়ামী লীগ সরকারের ইসলাম বিরোধী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে বক্তৃতা করছেন। এমন সময় এলো কুরবানির ঈদ।

আব্বা ঈদের জামাত পড়াতেন আজিমপুর কলোনির কমিউনিটি সেন্টার মাঠে। ঈদের জামাতে খুতবার আগে যে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হয় সেই আলোচনায় আব্বা সরকার বিরোধি বক্তব্য দেয়া শুরু করলেন। যদ্দুর মনে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শেখ মুজিবের যে প্রতিকৃতি স্থাপন করেছে আওয়ামী লীগ সরকার, এর বিরুদ্ধে শাইখুল হাদীস রহ. তুমুল বক্তব্য শুরু করেন।

শাইখুল হাদীস এ বিষয়ে বক্তব্য শুরু করলে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা কর্মিরা হইচই শুরু করে। আপনি থামেন, আপনি থামেন বলে চিৎকার শুরু করে। কিন্তু কারো কোন বাধাই তিনি মানেননি। আরও সাহসের সাথে বজ্রহুংকারে সরকারের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখেন। স্থানীয় বিএনপি কর্মিরাও কথা বলতে শুরু করে।

পরিস্থিতি তখন নিয়ন্ত্রনের বাইরে। ভয়ংকর কিছু ঘটে যাওয়াও অসম্ভব ছিল না। আব্বা বলছিলেন, আমি খতিব আমার ইসলামের পক্ষে কথা বলতেই হবে। এতসংখ্যক প্রতিপক্ষের সামনে সাহসের সাথে তিনি তার কথা শেষ করেন। যথারীতি নামাজ শেষ করেন। নামাজ শেষ করার পর স্থানীয় ছাত্রদলনেতা প্রয়াত সারওয়ার হোসেন সুমনের নেতৃত্বের ছাত্রদল নেতা কর্মিরা শাইখুল হাদীসকে কর্ডন করে রাখে।

কী পরিমাণ সাহস তিনি বুকে ধারণ করতেন তা শুধু এই একটা ঘটনা থেকেই বুঝা যায়। হক কথা বলতে গিয়ে তিনি পৃথিবীর কাউকেই ভয় করতেন না।

ওআই/আবদুল্লাহ তামিম


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ