শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১০ শাওয়াল ১৪৪৫


তসলিমা নাসরিনের প্রতি এক কিশোরীর খোলাচিঠি

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

কেমন আছেন? ধারনা করছি— ভালো নেই। আপনি কখনো ভালো থাকেন না। আমি খুবই ভালো আছি আলহামদুলিল্লাহ। কাল একটা মৃত্যু দেখে মনটা খুবই খারাপ ছিল কিন্তু এখন ঠিক হয়ে গেছে। মরবে তো সবাই। কী অদ্ভুত একটা ব্যাপার! মৃত্যু এমন এক সত্য যেখানে নাস্তিক-আস্তিকের কোনো ব্যাপার নেই, অদ্ভুত না? সবাই মৃত্যুমুখী!

যা বলতে এই চিঠির আয়োজন—

জানেন আপনার সাথে আমার দুয়েকটা জায়গায় খুব মিল! এ কথা শুনে অনেকে হয়তো চমকে উঠবে। কারণ, আপনি নাস্তিক আর আমি মাদরাসায় পড়েছি। মৌলবাদীদের মাদরাসায়। আপনিও অবাক হচ্ছেন না তো? ভাবছেন— তবে আর আমাদের মিল কীসের?

আছে আছে। সবচেয়ে শক্তিশালী মিলটা হলো আমাদের আত্মা ডেভিলের হোক অথবা এঞ্জেলের; একই শরীরের ভেতর আমাদের আত্মাকে স্থাপন করা হয়েছে। আমাদের শরীর নারীর শরীর।

তারপরের মিল হলো—

এক : পুরুষ সমাজকে আপনি যতটা ঘৃণা করেন আমিও আমাদের সমাজের একশ্রেণীর পুরুষকে ততটাই ঘৃণা করি।

দুই. আপনি ধর্ষণের জন্য ধর্ষককে দায়ী মনে করেন। আমিও তাই মনে করি। ভিন্নতা এটাই যে, আপনি শুধু ধর্ষককে দায়ী মনে করেন, কিন্তু আমি ধর্ষক ছাড়াও আপনি এবং আপনার মতো মানুষদেরও দায়ী মনে করি। যারা পোশাক স্বাধীনতার কথা বলে নারীর শরীরকে পণ্য বানিয়ে বিক্রি করতে চায়!

এবার বলি অমিলের কথা—

'পোশাক নয়, ধর্ষণের জন্য ধর্ষক দায়ী।' এই শিরোনামে বাংলাদেশ প্রতিদিনে আপনার একটা প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। এখানে এ নিয়ে কথা বলার আগে একটি কথা বলে নেই। তা হলো— আপনার মতো মানুষরা এ ধারণা কোথায় পেল যে, মৌলবাদীরা ভাবে ধর্ষণের জন্য ধর্ষক নয় বরং পোশাকই দায়ী?

আমাদের বক্তব্য তো এটা নয় যে 'ধর্ষক দায়ী নয়।' বরং আমাদের বক্তব্য— 'ধর্ষকই দায়ী তবে পোশাকেরও দায় আছে।' কারণ অশালীন পোশাক পরিহিত নারীদের দেখলে ধর্ষকরা প্রলুব্ধ হয় বেশি। তাই আমাদের মতে ধর্ষকের হাত থেকে বাঁচার জন্য শরঈ পর্দা একটা প্রটেকশন।

কিন্তু পোশাকই ধর্ষণের একমাত্র কারণ এটা কখনোই আমাদের মত নয়। কারণ, তাহলে অশালীন পোশাক পরা নারী দেখলেই পৃথিবীর সকল পুরুষই ঝাঁপিয়ে পড়ত। আমরা ধর্ষককেই আসল দোষী মনে করি। আর পর্দাকে নারীর সুরক্ষার জন্য একটি উত্তম ব্যবস্থা বলে মনে করি।

আপনি আপনার প্রতিবেদনে বেলজিয়ামের একটি প্রদর্শনীর কথা উল্লেখ করে ধর্ষণের জন্য পোশাকের যে কোনো দায় নেই তা প্রমাণের চেষ্টা করেছেন। আপনাকে আমি এ ব্যাপারে পরামর্শ দেব, শরঈ আইন মেনে চলে এমন দেশের সাথে অমুসলিম কিছু দেশের ধর্ষণের হার মিলিয়ে দেখতে। তাহলেই আসল প্রমাণ পেয়ে যাবেন।

আর চার বছরের শিশুর ধর্ষিত হওয়ার ক্ষেত্রে বলবো— ঠিক এ পয়েন্টে আমাদের একদম মিল যে, ধর্ষণের ক্ষেত্রে পোশাক নয় বরং ধর্ষকই দায়ী।

আপনার কথার উত্তরে বলছি— পুরুষেরা শক্তিমান, পুরুষেরা মহান, পুরুষেরা পরিবারের-সমাজের কর্তা; পুরুষকে জন্মের পর এই ধারণা দিয়েছে তার পরিবার, তার কুসংস্কার আচ্ছন্ন বে-দীন সমাজ, তার রাষ্ট্র। কিন্তু এই ধারণা তার ধর্ম দেয়নি, যেমন আপনি বলেছেন।

পুরুষ হোক অথবা নারী, কাউকেই মহান অথবা শক্তিমান বলে ধর্ম ঘোষণা দেয়নি। ধর্মে সমস্ত মহানুভবতা ও শক্তি একমাত্র আল্লাহর। ধর্ম পুরুষকে শেখায়নি মেয়েদের হেয় করতে, অবজ্ঞা করতে, অবহেলা করতে, হেনস্থা করতে, নির্যাতন করতে, ঘৃণা করতে, ধর্ষণ করতে।

ইসলাম ধর্মের আগমনের সময় পৃথিবীর সকল ধর্ম ও জাতিতে নারীদের অবস্থা ও অবস্থান নিয়ে সামান্য গবেষণা করলেই আপনি জেনে যাবেন, ইসলাম এসে নারীকে কী পরিমাণ সম্মানিত করেছে!

ইসলাম শিক্ষা দিয়েছে নারীকে ভালোবাসতে, রক্ষা করতে, সম্মান করতে। ইসলাম নারীর দেখাশোনা করা পুরুষের ওপর ফরজ করে দিয়েছে! সুতরাং ইসলামি আইন নিয়ে পড়াশোনা না করে কথা বললেই তো হলো না। কুসংস্কার আচ্ছন্ন সমাজকে আপনি ধর্ম ভাবলে তার দায় তো ধর্মের নয়, তার দায় আপনার।

দাড়ি টুপি পরে সমাজের কিছু মাতব্বর শ্রেণির লোক অথবা তাসবিহ হাতে নিয়ে আপনার মা কিছু বললেই সেটা ধর্ম হয়ে যাবে না!

ধর্ম নারীকে যেমন বলেছে পুরুষকে সম্মান করতে, পুরুষকেও বলেছে নারীকে সম্মান করতে। যেসব পুরুষ নারীকে অসম্মান করে তারা কিছুতেই ধার্মিক নয়! আপনার পোস্টে যেসব ছেলেরা গালি দেয় তারাও ধার্মিক নয়। ধার্মিকদের চরিত্র ভিন্ন এবং আলেম মানেই যদিও ধার্মিক নয় তারপরও বলবো আপনি ধর্ষকদের দেখলে একশোতে পাঁচজন আলেমও খুঁজে পাবেন না! পঁচানব্বইভাগই দীনহীন বে-আমল মূর্খ পুরুষ!

আর এরা পুরুষ নয় বরং এরা শয়তান। এই শয়তানদের হাত থেকে রক্ষার জন্যই আপনার মা আপনার জন্য উৎকন্ঠিত হতেন। তিনি ধর্মীয় জ্ঞান থাকুক আর না থাকুক নারী বলেই শরীরের জ্ঞান সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞানী ছিলেন।

তাই আপনাকে বুঝিয়ে দিতেন আপনার একটা শরীর আছে। সেই শরীরকে রক্ষা করতে হবে। আপনাকে হাফপ্যান্ট না পরে পাজামা পরতে বলতেন, ওড়না পরতে বলতেন। বলতেন একা একা রাস্তায় বেরোনো নিষেধ। আপনার ভাইদের বলেননি কারণ মেয়েদের তুলনায় ছেলেরা কম নির্যাতিত হয়।

জানেন, আমার মাও নিষেধ করতেন আর আমিও শুনতাম না। দশ-এগারো বছর বয়সে আমি মাদরাসা থেকে ফিরে দুপুরের শেষরোদে আমাদের গোলাপবাগের গলি-ঘুপচিতে একা একা ঘুরতাম। গলিতে একটা দোকান ছিল, আমরা বলতাম শাহেদ চাচার দোকান।

সুন্দরমতো এক ভদ্রলোক তিনি। কিন্তু একদিন দেখি ওই লোক একা দোকানে একটা ছোট্ট মেয়েকে চটকাচ্ছে! আমি ভয়ে ভোঁদৌড়! আমার পাড়াতো বান্ধবীকে পেয়ে ব্যাপারটা বললাম। সে বললো উনি একা পেলে অনেকের সাথে এমন করে।

তারপর থেকে মা প্রয়োজনে দোকানে পাঠাতে চাইলেও যেতাম না, মা বুঝতে পারতেন না কেন যেতে চাচ্ছি না। ভাবতেন এমনিতে একা ঘুরি কিন্তু দোকানে যেতে হবে বলে আলসেমি করছি। কত বকা দিতেন! আর আমার কী যে ভয় লাগতো ওই দোকানে যেতে!

পরে যত বড় হয়েছি অন্যান্য বন্ধুদের কাছেও শুনেছি প্রায় অনেকের সাথে এমন হয়েছে। কোথাও না কোথাও কেউ না কেউ অনেকের সাথে এমন করেছে। ছোট বাচ্চাদের উপর এই অত্যাচারের দায় পোশাকের যেমন নয়, তেমনি ধর্মেরও নয়। দায়ী হলো ধর্মহীনতার। ওই পুরুষগুলো ধার্মিক হলে, আল্লাহর ভয় থাকলে কিছুতেই ওমন করত না।

আর এখানেই আপনার কমনসেন্স আমাকে অবাক করেছে। কারণ যতই প্রতিবাদ-প্রতিরোধ হোক, একদল বিকৃত মানুষ সকল যুগে, সকল সমাজে থাকবে। তার সমাধান হলো, অপরাধীকে শাস্তির সম্মুখীন করা। পাথর মেরে তাকে জীবিত হত্যা করা।

তবে আপনি ধর্ষণের সমাধানের কথা বলতে গিয়ে পোশাক খুলে পশুর মতো চলেফেরা করতে বলছেন কেন!! আপনি ধর্ষণের প্রতিবাদ করছেন অথচ বলছেন নারীদেরকে তাদের সম্মান বিসর্জন দিয়ে কাপড় খুলে হাঁটতে!

তবে আপনার কথার এ অংশ শতভাগ ঠিক যে— 'পুরুষের চরিত্র সংশোধন করতে হবে, তা না হলে ধর্ষণ বন্ধ হবে না।' কিন্তু পুরুষদের চরিত্র আপনি কী দিয়ে সংশোধন করবেন?

আপনি তো আল্লাহ বিশ্বাস করেন না। নাস্তিকদের তো আল্লাহর ভয় নেই, পরকালের ভয় নেই, বিচারের ভয় নেই। আপনার অনুসারী পুরুষরা তো যা ইচ্ছা তাই করবে। কারণ তাদের শাস্তির ভয় নেই। তারা আপনার কাপড় ধরে টানাটানি করবে, আপনাকে হেনস্থা করবে, আপনাকে খুনও করতে পারে!

কিন্তু আলেম সমাজের কাছে আল্লাহ আছেন, পরকাল আছে, বিচারসভা আছে। আলেম সমাজ জানেন পরকাল সম্পর্কে অবিশ্বাসীদের আল্লাহ বলেছেন

أَفَنَجْعَلُ الْمُسْلِمِين كَالْمُجْرِمِينَ

‘আমি কি আজ্ঞাবহদেরকে অপরাধীদের ন্যায় গণ্য করব?’

مَا لَكُمْ كَيْفَ تَحْكُمُونَ

‘তোমাদের কী হলো? তোমরা কেমন সিদ্ধান্ত দিচ্ছ?’

আল্লাহ আরো বলেছেন, 'যারা দুষ্কৃতিকারী তারা কি মনে করে যে, আমি তাদেরকে সে লোকদের মতো করে দিব যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, এবং তাদের জীবন ও মৃত্যু কি সমান হবে? তাদের দাবি কত মন্দ!'

আল্লাহ বলছেন পরকাল নেই যারা বলে তাদের দাবি কত মন্দ! তারা মনে করে তারা পাপ করবে অথচ তাদের শাস্তি হবে না। সত্যি কী অদ্ভুত বিচার আপনাদের!

কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি দুনিয়ায় শাস্তির বিধান ব্যতীত পরকালের বিচারসভা আল্লাহ মানুষের জন্য নির্ধারণ করে রেখেছেন এবং শাস্তির বিষয়ে আমরা আল্লাহকে ভয় করি। সুতরাং সংশোধিত চরিত্র মৌলবাদীদের ঠিকই আছে। আপনি বরং আপনার অনুসারীদের চরিত্র সংশোধনের কোনো উপায় খুঁজে বের করুন যাদের আল্লাহর ভয় নেই!

আমি দুঃখবোধ করছি। গভীরভাবে। কারণ, 'সত্য সত্যি নির্বাসনে নয় বরং সত্য সত্যিই নির্যাতিত।' আপনার মতো মানুষদের হাতে নির্যাতিত। আপনি একটা জালিম মানুষ। আমরা আপনার নোংরা অপবাদের আক্রমণ থেকে মুক্তি চাই।

নাস্তিক হয়েছেন বলে সবকিছুতে আপনি মৌলবাদীদের দোষারোপ করবেন কেন! আমরা চাই আপনি বরং আমাদের মতো সত্যিকারের অপরাধীদের কথা বলুন এবং সুন্দর ও সভ্য সমাজ গড়তে চেষ্টা করুন। আপনার মতো মানুষ যে জাতির ভাগ্যে আছে তাদের জীবন অসুন্দর। আপনাদের চরম মিথ্যের মধ্যে বাঁচতে আমাদের গা সত্যি গিনগিন করে!

আপনার আর্টিকেলের নিচে লেখা ছিলো— 'নির্বাসিত লেখিকা।' আপনি নির্বাসিত, তার জন্য আমার দুঃখ হওয়া উচিত। একজন মানুষ এতটা বছর নিজের দেশ ছেড়ে আছে এ কথা ভাবলে মনের কোথাও একটা সফটনেস চলে এলেও যখন মনে পড়ে, আপনি আমার মতো হাজারো মেয়ের বোধ ও বিশ্বাসকে নানাভাবে অপমান করেছেন, করে যাচ্ছেন তখন মনে হয় আপনার শাস্তি এ তো অনেক কম!

সৌদি আরবে বাংলাদেশি গৃহকর্মীরা নির্যাতন থেকে বাঁচতে ঠাঁই নিচ্ছেন আশ্রয় কেন্দ্রে

তাছাড়া আপনাকে নির্বাসনে পাঠিয়েছে আপনারই আচরণ। আপনার নোংরা অপবাদ ও আক্রমণ। নোংরামিগুলোকে নির্বাসনে পাঠান। আপনার জাগতিক মুক্তি মিলতে কতক্ষণ!

আমরা নারী। নারী হয়েছি বলে আমাদের কোনো লজ্জা নেই। আমরা পুরুষের মতো হতে চাই না। আমাদের নারী শরীর নিয়ে আমরা গর্বিত। নোংরা পুরুষের হাত থেকে বাঁচার জন্য পুরুষের মতো চলাফেরা করাকে আমরা সমাধান মনে করি না। বরং আমাদের আশেপাশের পুরুষদের চরিত্র সংশোধনের চেষ্টা করি।

আমাদের পরিবারের পুরুষরা ধর্ষক নয়। আল্লাহ চাইলে আমাদের সন্তানরাও কিছুতেই এমন হবে না। কিন্তু আপনি কাপড় খোলার জন্য নিয়মিত এমন লম্বা লম্বা বক্তব্য দিয়ে আপনার আশেপাশের কয়টা পুরুষের চরিত্র সংশোধন করেছেন খুব জানতে ইচ্ছে করে।

আপনার ইতিহাস যতটুকু জানি, একটা পুরুষও এমন ছিল না যে আপনার মাংস খেতে চায় নি। আপনি ভালো থাকতে পারেননি দুঃখের কথা, কিন্তু এ সমাজের অন্য মেয়েদের ভালো থাকতে দিন। আমার বিশ্বাস, খুব তাড়াতাড়ি আপনি পৌঁছে যাবেন আগুনের জগতে।

তাই বলছি— বয়স হয়েছে এখন যতদিন বেঁচে আছেন ততদিন অন্তত ভালো থাকার চেষ্টা আপনিও করুন।

আল্লাহ আপনাকে হেদায়েত দিন এ কামনায় শেষ করছি।

মাজিদা রিফা
১৫ই চৈত্র, ১৪২৪ বঙ্গাব্দ.

আরো পড়ুন : এমন ভালোবাসাই দূর করতে পারে ঘৃণা


সম্পর্কিত খবর