বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ ।। ১৪ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৮ রমজান ১৪৪৫


ছন্দপতনের আরেক নাম ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

পলাশ রহমান
ইতালি থেকে

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের বয়স এখন ৩২। ১৯৮৭ সালের ১৩ মার্চ দলটির জন্ম হয়েছিল ঢাকায়। দল গঠনের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন বর্তমান জামায়াতে ইসলামির নেতা দেলোয়ার হুসাইন সাইদী। নানা সন্দেহ সংশয় জন্ম দিয়ে শেষ মুহুর্তে তিনি সরে দাঁড়িয়েছিলেন দল ঘোষণা না করেই।

তখন বেকায়দায় পড়া দেশের বর্ষিয়ান আলেমগণ দলটির নেতৃত্ব তুলে দেন সৈয়দ ফজলুল করিম রহ. এর হাতে। তিনি হন দলটির প্রতিষ্ঠতা মূখপাত্র।

জন্মলগ্নে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নাম ছিল ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন। তখন এ দলের নেতারা বলতেন, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন কোনো প্রচলিত রাজনৈতিক দল নয়। ইসলামি শাসনতন্ত্র আন্দোলন একটি আন্দোলন, সংগ্রামের নাম। রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েমের আন্দোলন।

যেমন বায়ান্নতে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল, একাত্তরে মুক্তির আন্দোলন হয়েছিল, তেমনই ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যই এই আন্দোলনের সূচনা করা হয়েছে। দেশে ইসলামী শাসন কায়েম হয়ে গেলে এ আন্দোলনের আর কোনো প্রয়োজন থাকবে না।

আজ এতগুলো বছর পরেও ইসলামী আন্দোলন সেই অর্থে কোনো রাজনৈতিক দল হয়ে উঠতে পারেনি। দেশজুড়ে চরমোনাই তরিকার ভক্ত মুরিদদের সমর্থন পেয়ে দলটি গোড়া থেকেই ইস্যু ভিত্তিক আন্দোলন সংগ্রামে জনশক্তি দেখাতে পারলেও কখনোই কোনো আন্দোলনের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারেনি।

রাজনৈতিক কর্মকান্ডেও দলটির কোনো ধারাবাহিকতা নেই। দলটি ইস্যুভিত্তিক হঠাৎ জ্বলে ওঠে, আবার নিমিষেই নিভে যায়। মনে হয় কোনো এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা দলটির নীতিনির্ধারক কমিটি।

একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলন ২৯৯ আসনে প্রার্থী দিয়ে আলোচনায় আসে। সংবাদ মাধ্যমগুলোর দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়, কিন্তু ভোটের ফসল (ভোটের ফসল বলতে ভোটে পাশ করা বোঝানো হয়নি) তারা ঘরে তুলতে পারেনি। দেশের মানুষের মনোযোগ ধরে রাখার মতো ধারাবাহিকতা দেখাতে পারেনি।

জোট রাজনীতির গণ্ডি ভেঙ্গে এককভাবে ২৯৯ আসনে নির্বাচন করার সক্ষমতা দেখাতে পারা দলটি ভোট ইস্যুতে জ্বলে উঠা প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখতে পারেনি। ভোটের মাঠে দেশের মানুষ তাদের যে শক্তি দেখেছিল, ভোটের পরেও সেই শক্তির দৃশ্যমান অবস্থান প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু তেমন কিছুই দেখা যায়নি, দলটি দেখাতে চেষ্টাও করেনি।

সরকারি দমন নিপীড়নের মুখে একাদশ জাতীয় নির্বাচন জালিয়াতির বিরুদ্ধে দেশের কোনো দল রাজপথে নামেনি, ইসলামী আন্দোলনও নামার চেষ্টা করেনি। দেশের মানুষ প্রত্যাশা করেছিল দলটি অন্তত কর্মসূচি ঘোষণা করবে।

সংঘাত এড়িয়ে নিয়মতান্ত্রিকভাবে রাজপথে নামার চেষ্টা করবে। প্রতিবাদ করবে। নেতাকর্মীদের ভোটকেন্দ্রিক গতি ধরে রাখার চেষ্টা করবে। দলটি তা করেনি, কখনো করে না।

বরিশাল সিটি নির্বাচনের কথা স্বরণ করতে পারি, অনিয়মের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার চারদিন পরে তারা ঢাকায় বিক্ষোভ ঘোষণা করেছিল। যা রাজনীতির নূন্যতম ধারাবাহিকতার মধ্যে পড়ে বলে কেউ মনে করে না।

এমন বহু উদাহরণ দেয়া যাবে- দলটি ইস্যু ভিত্তিক জ্বলে ওঠে টিউবলাইটের মতো। পরক্ষণে আর কোনো খোঁজ থাকে না। জনস্বার্থে কথা বলতে দেখা যায় না। রাজনীতিতে ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে না পারলেও শতভাগ চারিত্রিক ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পেরেছে দলটির ছাত্রশাখা।

ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন বেশ গোছালোভাবে ৮ম ডাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। তাদের প্যানেলে, ইশতেহারে বিচক্ষণতা ছিল। কিন্তু ভোটে যে জালিয়াতি হতে পারে, ভোটের পরে জালিয়াতির প্রতিবাদে, প্রতিরোধে তাদের যে কর্মসূচি থাকা উচিৎ, রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা থাকা উচিত তেমন কিছুই তারা দেখাতে পারেনি, চেষ্টাও করেনি। নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর মধ্যেই তাদের সব কার্যক্রম, শক্তি, শ্রম, মেধা গুটিয়ে যায়।

প্রতিবাদ, প্রতিরোধ মানেই তো সংঘাত সংঘর্ষ নয়। এগুলো এড়িয়েও নিয়মতান্ত্রিকভাবে রাজপথে থাকা যায়। প্রতিবাদ বিক্ষোভ করা যায়, রাজনীতির ধারাবাহিকতা ধরে রাখা যায়। নেতাকর্মীদের চাঙ্গা রাখা যায়। তাদের সময় শ্রম মেধা ব্যয়ের ফসল ঘরে তোলা যায়। কেনো যেনো দলটি বুঝতেই চায় না।

ডাকসু নির্বাচন থেকে ইশা ছাত্র আনোলন সরে দাঁড়িয়েছে দুপুরে। বিকেলে তারা যদি জালিয়াতির প্রতিবাদে প্রেসক্লাবের সামনে থেকে একটা বিক্ষোভ মিছিল বের করতো। হাজার খানেক নেতাকর্মী নিয়ে ক্যাম্পাসে যাওয়ার চেষ্টা করতো। পুলিশ বাধা দিলে সংঘর্ষ এড়িয়ে নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদ সমাবেশের মাধ্যমে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করতো, তাতে কী এতদিনের শ্রম মেধার ফসল ঘরে উঠতো না?

নির্বাচনে অংশগ্রহণ বিজয়ের জন্য। কিন্তু বিজয়ই যে একমাত্র সাফল্য নয় তা প্রমাণের জন্য, ধারাবাহিকতা ধরে রাখার জন্য রাজনৈতিক দলের প্রস্তুতি থাকতে হয়, লাগোয়া কর্মসূচি থাকতে হয়।

এই বাস্তবতা বুঝতে না পারলে যেমন রাজনৈতিক দল হয়ে ওঠা যাবে না, তেমন কোনো আন্দোলন সংগ্রামের সাফল্য ধরে রাখা যাবে না। ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের অর্থ অধরাই থেকে যাবে।

ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ যে ধারায় রাজনীতি করে তাকে কোনো সার্বজনিন আন্দোলন, সংগ্রাম বা রাজনীতি বলে চিহ্নিত করা যায় না। এটাকে বড় জোর বলা যেতে পারে ইস্যুভিত্তিক শ্রেণীসংগ্রাম।

৩২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকির প্রত্যাশা- দলটি গণমানুষের দল হয়ে উঠুক। নেতাকর্মীদের ত্যাগের ফসল ঘরে তুলতে শিখুক।

লেখক: ইসলামী রাজনীতি বিশ্লেষক


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ