বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ ।। ১৪ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৮ রমজান ১৪৪৫


মুফতি আবুল কালাম যাকারিয়া রহ. কেন অন্যন্য, কেন অসাধারণ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুহাম্মদ জামীলুল হক
শিক্ষক

পৃথিবীতে কারো আগমন মানে মহাকালের দিকে তার যাত্রার শুরু মাত্র। এই শুরুর কোনো শেষ নেই। আছে স্থান পরিবর্তন। আরো সরলভাবে বললে মানুষের মৃত্যু মানে তার শেষ নয়। বরং পরকালের যাত্রা শুরু মাত্র। পৃথিবীর এই স্বল্প সময়টুকু তার পরকালের পুঁজি সংগ্রহের সময়। এই সময়টুকুতে যারা সফলতার স্বাক্ষর রাখতে পারে, তারাই পরকালে সফল হয়।

পৃথিবীর ঊষালগ্ন থেকেই মানুষের আসা-যাওয়ার এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু কিছু মানুষের প্রস্থান সমকালীন ভক্ত সুহৃদজনদের কাঁদায়। তাঁর কর্মচঞ্চল বর্ণাঢ্য জীবন মানুষকে স্মৃতিকাতর করে তোলে। তাঁর অবদান জাতিকে সমৃদ্ধ করে। আর তাই মানুষ তাঁকে স্মরণ করে যুগ-যুগান্তর।

শায়খুনা ওয়া সানাদুনা মুফতি আবুল কালাম যাকারিয়া রহ. আমাদের জন্য মহান আল্লাহপাকের এক মহা নেয়ামত ছিলেন। তাঁর যাপিত জীবন আমাদের জন্য একটি আদর্শ ছিলো। সব মানুষের মাঝেই নানামাত্রিক গুণের সমাহার থাকে। তবে তাঁর মাঝে যেসব গুণাবলির সমাহার ঘটেছিলো, তা খুব কম মানুষের ভাগ্যেই জুটে। তাঁর সম্পর্কে লিখার মতো অনেক বিষয় আছে।

বহুমুখি প্রতিভার অনুপম সমন্বয় ঘটেছিল তাঁর বরকতময় জীবনে। যেগুলো বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য আলো ছড়াতে পারে যুগ-যুগান্তর। এখানে সবগুলো লেখার সুযোগ নেই। সংক্ষিপ্ত একটি জীবনচিত্র উপস্থাপানের চেষ্টা করছি মাত্র।

আমাদের সুনামগঞ্জী হুজুর রহ. ১৫ মার্চ ১৯৫৬ ঈ. সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার বাগুয়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষার ভিত রচিত হয় তাঁর স্নেহময়ী মায়ের কাছে। তাঁর মুহতারামা আম্মা ছিলেন একজন ধার্মিক মহিলা, নিয়মিত নামাজ-তিলাওতে অভ্যস্ত ছিলেন।

এ সম্পর্কে হুজুরের বর্ণনা হচ্ছে- আমার আম্মা খুব বেশি তিলাওয়াত করতেন। এমনকি সাংসারিক কাজকর্মের শত ব্যস্থতার ফাঁকেও তিলাওয়াত করতেন। আমি তাঁর মুখে এতো প্রচুর পরিমাণ তিলাওয়াত শুনেছি, যাতে আমার কাছে মনে হতো তিনি কুরআনের হাফেজা। অথচ তিনি নিয়মতান্ত্রিক হাফেজা ছিলেন না। তিলাওয়াতের আধিক্যের কারণে হাফেজার মতো হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর মুখে মুখে তিলাওত শুনে শুনে আমি শিশু বয়সেই অনেক আয়াত মুখস্থ করে ফেলি।

শিশুকাল থেকে হুজুর রহ. ব্যতিক্রমধর্মী ছিলেন। খেলাধুলা, গল্পগুজব ও নিরর্থক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতেন। জামাতের সঙ্গে নামায আদায়ে তখন থেকেই অভ্যস্থ হয়ে ওঠেছিলেন। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষার শুভসূচনা হয় নিজ গ্রামের প্রতিষ্ঠান সাতগাঁও বাগুয়া মাদরাসায়। এখানে তিনি একাধারে ছয় বছর লেখাপড়া করেন।

এরপর সুনামগঞ্জের রামনগর মাদরাসায় ধারাবাহিক পাঁচ বছর শিক্ষার্জন করেন। এরপর চলে আসেন দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় দ্বীনিশিক্ষা প্রতিষ্ঠান, জামেয়া ক্বাসিমুল উলূম দরগাহ হযরত শাহ্জালাল রহ. সিলেটে। এখানে তিনি শরহেজামী ক্লাসে ভর্তি হয়ে দাওরায়ে হাদীস (টাইটেল ক্লাস) পর্যন্ত অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে লেখাপড়া সম্পন্ন করেন। দাওরায়ে হাদীসের কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় তিনি মেধাতালিকায় ১ম স্থান অর্জন করেন।

দাওরায়ে হাদীস সম্পন্নের পরপরই জামেয়া দরগাহ কর্তৃপক্ষ তাঁকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করে। এ সময় তিনি একজন টগবগে তরুণ। কিন্তু এ ভরা তারুণ্যের সময়েও তিনি সমকালীন তরুণ আলেমদের থেকে একটা স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করে নেন। সাধারণত তারুণ্যে যেসব দুনিয়াবী জৌলুস-চাকচিক্য তারুণদেরকে ঝাঁকুনী দেয়, সে সবকিছু তাঁর মাঝে ঘটেনি।

তাঁর ধ্যান-জ্ঞান পুরোটাই ছিলো ইলমীসাগরে সাঁতার কাটার মাঝে। তাঁর প্রিয় উস্তায সমকালীন অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলিম মুফতি রহমতুল্লাহ রহ.’র নিবিঢ় তত্ত্বাবধানে তাঁর শিক্ষকজীবনের শুভযাত্রার সূচনা হয়। মাত্র ক’বছরের মাথায় তাঁর পাঠদান পদ্ধতি ও ইলমী গভীরতা প্রকাশ পেতে থাকে।

তৎকালে সাধারণত কওমি মাদরাসার পাঠদানের মাধ্যম ছিলো উর্দূ। কিন্তু তিনি স্রোতের বিপরীতে প্রাঞ্জল সাবলীল বাংলা ভাষায় পাঠদান শুরু করেন। ক্লাসে তাঁর বিশুদ্ধ বাংলায় পাঠদানের কারণে স্বল্পসময়েই তিনি ছাত্রদের মাঝে প্রিয় শিক্ষক হিসেবে সবার হৃদয়ে জায়গা করে নেন।

ক্লাসে পাঠদানের সময়ই তাঁর বিস্তৃত মুতালাআর বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ভরাটকণ্ঠে যে কোনো পাঠের তাত্ত্বিক আলোচনা দারসকে প্রাণবন্ত করে তুলতো। তাঁর জ্ঞানসমুদ্রের মণিমুক্তায় ভরপুর থাকতো পুরোটা দারস। আমরা তিরমিযী ১ম খণ্ডের পাঠ তাঁর কাছে গ্রহণ করি।

সেখানে ইলমুল হাদীসে তাঁর পাণ্ডিত্য প্রতিভাত হয়, হাদীসের রাবীদের নিয়ে বিস্তর পড়াশুনা না থাকলে হাদীস নিয়ে হাদীসভিত্তিক আলোচনা অসম্ভব ব্যাপার। আমি লক্ষ্য করেছি, উসূলে হাদীস নিয়ে তাঁর আলোচনা অত্যন্ত সমৃদ্ধ থাকতো। আর হাদীস সংশ্লিষ্ট ফেকহী মাসআলা, সেখানে তো তিনি নযিরবিহীন এক ফকীহ।

প্রতিটি মাসআলায় অন্তত দশ-পনেরটি কিতাবের নাম ও মুসান্নিফের নাম অবলিলায় বলে ফেলতেন। মনে হতো ফেকাহ শাস্ত্রটি তিনি মুখস্থ করে ফেলেছেন। বিরোধপূর্ণ মাসাইলের ক্ষেত্রে সব মত-পথের দলীল-আদিল্লা উপস্থাপনের পর অধিকতর গ্রহণযোগ্য মতটি অত্যন্ত চমৎকারভাবে উপস্থাপন করতেন।

রুসূখ ফিল ইলম তথা গভীরজ্ঞান বলতে যা বুঝায় তা যথার্থভাবেই তাঁর মাঝে বিদ্যমান ছিলো। নাহু-সরফ, বালাগত, ফেকহ, তাফসীর, হাদীসসহ উলূমে শরইয়্যাহর সবক’টি শাখায়ই তাঁর দক্ষতা ছিলো সমভাবে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে ফিকহ শাস্ত্রে তাঁর গভীরতা ছিলো সত্যিই বিস্ময়কর।

অনেক মাসআলাই তাঁর কাছে জিজ্ঞেস করেছি, সবসময়ই দেখেছি মাসআলাগুলোর প্রশান্তিদায়ক জবাব তিনি সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দিতেন। খুব কম এমন হয়েছে যে, জিজ্ঞেস করার পর বলেছেন, এটা তুমি অমুক অমুক কিতাবে পাবে, পড়লেই পাওয়া যাবে। ফিকহ শাস্ত্রে দক্ষতার কারণেই সব শ্রেণিপেশার মানুষের আনাগুনা থাকতো তাঁর দুয়ারে। তাঁর প্রদত্ত ফাতাওয়া সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আদালতে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিলো।

সহীহ হাদীসে আছে, মহান আল্লাহ যার কল্যাণ কামনা করেন তাঁকে ‘তাফাক্কুহ ফিদ্দীন’ তথা দ্বীনের সমজবুঝ দান করেন। হাদীসটির যথার্থতা আমরা তাঁর মাঝে শতভাগ বিদ্যমান পেয়েছিলাম। এজন্য সমকালীন ওলামায়ে কেরামের মাঝে তাঁর একটা স্বতন্ত্র অবস্থান রচিত হয়েছিল। ইলমুততাফসীরে ছিলো তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য।

কুরআনে করিমের জটিল আয়াতগুলোর সমাধান এমনভাবে দিয়ে দিতে পারতেন যাতে মন ভরে ওঠতো। কুরআনে ব্যবহৃত ফাসাহাত-বালাগতের আলোচনা যখন করতেন, তখন বুঝা যেতো তিনি এ শাস্ত্রের একজন ইমাম। নাহু-সরফ সংক্রান্ত কোনো জটিল কায়দা জিজ্ঞেস করলে তিনি এর এমনসব চমৎকার সমাধান দিতেন; যাতে সহজেই তার পারদর্শীতা হৃদয়ঙ্গম হতো।

আরবি ভাষার শব্দসমূহের একাধিক অর্থ, স্থানোচিত অর্থসহ আরবি ব্যাকরণের সর্ববিষয়ে তাঁর দক্ষতা ছিলো বিস্ময়কর। ফিক্হ শাস্ত্রের পরিভাষাগুলোর যথার্থ ব্যবহারের ওপর তাঁর দক্ষতা আমাদেরকে পূর্ববর্তী ফকীহদের কথাই স্মরণ করিয়ে দিতো।

প্রায় দু’বছর পূর্বে বেফাক আয়োজিত একটি শিক্ষক প্রশিক্ষণ সভায় তিনি আমন্ত্রিত ছিলেন। সেখানে তিনি একটি বক্তব্য প্রদান করেন। এর কিছুদিন পর চারদিক থেকে তাঁর প্রশংসা শুনতে পাই। ঢাকা থেকে অনেকেই তার সম্পর্কে জানতে চান।

কিছুদিন পর তাঁকে জিজ্ঞেস করি, হুজুর! ঢাকার একটি সভায় আপনার বক্তব্যের পর চারদিক থেকে আপনার প্রশংসা ভেসে আসছে। সেটি কি ধরনের বক্তব্য ছিলো? বললেন- ‘বেফাকের শিক্ষক প্রশিক্ষণ সভা ছিলো, আমার বিষয়বস্তু ছিলো ফিকহ’র পরিভাষা নিয়ে। সেখানে ঘণ্টাখানেক বক্তব্য প্রদানের পর অনেকের আবদারের প্রেক্ষিতে আমি একি মজলিসে পুনরায় বক্তব্য প্রদান করি।’

স্পষ্টতই বুঝা যাচ্ছে, তাঁর বক্তব্য সেখানে ঝড় তুলেছিল। ফলশ্রুতিতে আবারও বক্তব্য প্রদানের জোরালো আবেদন আসে। আসলে আল্লাহ তা‘আলা যাকে প্রখর মেধা দান করেন, সে যদি তা সঠিক পন্থায় ব্যবহার করে, তবে উভয় জাহানের সফলতা তার পদচুম্বন করে।

প্রখর মেধার সঙ্গে কঠোর পরিশ্রম যুক্ত হলে তা হয়ে ওঠে সোনায় সোহাগা। ধীমান মেধাবী মানুষ যখন গভীর সাধনায় লিপ্ত হয়, তখন সফলতার শীর্ষ চূড়ায় সে আরোহণ করতে সক্ষম হয়। আমাদের মরহুম হুজুরের ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটেছিল। তাই তিনি অসাধারণ এক আলেমেদ্বীন হিসেবে সর্বমহলে সমাদৃত হন।

তাঁর কাছে পড়ে, তাঁর সান্নিধ্যে থেকে আমার কাছে যা প্রতিভাত হয়েছে সেটা হচ্ছে- তাঁর প্রচুর পরিমাণ পড়াশুনা ছিলো। উলূমে শরইয়্যা’র সবক’টি বিষয়ে তিনি প্রচুর পড়েছেন। এই ‘কাসীরুল মুতালাআ’ বা পড়াশুনার আধিক্যের কারণে তাঁর মাঝে রুসূখ ফিল ইলম তথা ইলমের গভীরতা সৃষ্টি হয়েছিলো।

তাঁর বিস্তৃত মুতালাআর কিছুটা আঁচ করা যায় তাঁর রচিত ‘তাকরীরে কাসিমী’ পাঠে। এখানে তিনি তাফসীরে বায়যাবীর শুধু সূরা ফাতেহা’র তাফসীর পেশ করেছেন।

কাজী বায়যাবী রহ. সূরা ফাতেহার তাফসীরে যা বলেছেন, এর ব্যাখ্যা তিনি লিখেছেন ৩৪২ পৃষ্ঠার কিতাবে। বায়যাবীর জটিল ও সুক্ষ্ম বিষয়গুলোর ওপর তাঁর মেধাদীপ্ত আলোচনা পাঠে আমার মনে হতো, এটাতো দ্বিতীয় আরেকটি বায়যাবী হয়ে গেলো।

এতো বিস্তৃত আলোচনা ও তাত্ত্বিক উপস্থাপনায় কিতাবটি নযিরবিহীনই মনে হয়। তাফসীরে বায়যাবী’র প্রায় স্থানের শব্দ-বাক্যের চুলছেড়া বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন গ্রহণযোগ্য কিতাবগুলোর উদ্ধৃতি সহকারে।

প্রচুর কিতাবের রেফারেন্স’র সমাহার তিনি সেখানে ঘটিয়েছেন। বায়যাবীর পাঠক মাত্রের জানা আছে, বায়যাবীতে অনেক জটিল-কঠিন বিষয়াদির আলোচনায় কিতাবকে সমৃদ্ধ করা হয়েছে। যা সচরাচর অন্যান্য কিতাবে পাওয়া যায় না। তন্মধ্যে একটি আলোচনা আছে বিসমিল্লাহ’র ‘বা’ অক্ষরের ওপর। ‘বা’ এর মধ্যে ‘ফাতহা’র পরিবর্তে ‘কাসরা’ কেন আসলো? এই আলোচনাটি কাজী বায়যাবী রহ. তাঁর মতো করে বর্ণনা করেছেন।

এই কিতাবের অন্যান্য ব্যাখ্যাকারগণও নিজস্ব ভঙ্গিতে এর আলোচনা করেছেন। আমাদের শায়খ সেখানে এমনকিছু তথ্য ও যুক্তির সমাহার ঘটিয়েছেন, যা অন্যান্য ব্যাখ্যাগ্রন্থে পাওয়া যায় না। তাঁর আলোচনায় ‘বা’ অক্ষরটির ওপর ‘কাসরা’ আসার কারণটি অত্যন্ত সাবলীলভাবে বোধগম্য হয়ে ওঠে।

কাজী বায়যাবী রাহ. সূরা ফাতেহার ১৪টি নাম উল্লেখ করেছেন। এই ১৪টি নাম আলোচনা করার পর হুজুর বলেছেন, কাজী সাহেব সূরা ফাতেহার ১৪টি নাম উল্লেখ করেছেন, এতে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, সূরা ফাতেহার নাম এ চৌদ্দটিতেই সীমাবদ্ধ। বরং এই সূরার আরো অনেক নাম রয়েছে। বিভিন্ন তাফসীরের কিতাবের উদ্ধৃতিতে তিনি সূরা ফাতেহার ৩৫টি নাম উল্লেখ করেছেন। এমন অনেক তাত্ত্বিক আলোচনাই তাকরীরে কাসিমীতে রয়েছে।

ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন একজন পরিশীলিত মানুষ। তাঁর কথা ও কাজের মধ্যে ভারসাম্য থাকতো। তাঁর মার্জিত কথাবার্তা ও আচরণে সবাই মুগ্ধ হতো। তার সবগুলো কথার মাঝেই একটা আর্ট থাকতো। থাকতো শেখার মতো কিছু উপাদান। তাঁর পুরো স্বত্ত্বাটাই ছিলো একটি পাঠশালা। তাঁর হাঁটা-চলা, চাহনী সবকিছুতেই শিক্ষণীয় কিছু থাকতো।

তাঁর চলাফেরা দেখে অনেক কিছুই শেখা যেতো। তাঁকে দেখলে মনের অজান্তেই কিছু সময় তাকিয়ে থাকতাম। ইন্তেকালের দিন দারসে যাওয়ার সময় কেনো জানি দীর্ঘক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকি। দারস থেকে আসার সময়ও একিভাবে দীর্ঘসময় তাকিয়ে রই। দেখছি আর ভাবছি, হুজুর মোটামোটি সুস্থ হয়েছেন।

আহ! তখনও জানিনে তাঁকে আর দেখা যাবে না। এটাই শেষ দেখা। হয়তো এজন্যই দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকা। তাঁর প্রতিটি কথায় আমি মুগ্ধ হতাম। কিছু পাথেয় সংগ্রহ করতাম। দিকনির্দেশনা পেতাম।

অনর্থক কাজ থেকে বেঁচে থাকা সফল মুমিনের অনিন্দ্য সুন্দর বৈশিষ্ট্য। যেমনটা কুরআনে বর্ণনা করা হয়েছে। তাঁর মাঝেও এই গুণটি ছিলো। আমি বিস্মিত হয়েছি, তিনি কতো চমৎকারভাবে তাঁর কথা-কাজ ও আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সবচে’ বিস্ময়কর যে বিষয়টি আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে, সেটি হচ্ছে তাঁর সহনশীলতা।

প্রচণ্ড ধৈর্যশক্তি তাঁর মাঝে ছিলো। কতো মানুষ কতো ধরনের কথা বলতো, কখনো কারো সঙ্গে রাগ করতে দেখিনি। যেকোনো পরিস্থিতিতে শান্ত থাকার মতো একটা বিস্ময়কর গুণ তাঁর মাছে বিদ্যমান ছিলো। প্রশংসনীয় গুণাবলীর মোহনা ছিলেন তিনি। যার ফলশ্রুতিতে তুলনারহিত এক আস্থাভাজন অভিভাবকে পরিণত হয়েছিলেন। জামেয়ার সার্বিক উন্নতি-অগ্রগতিতে তাঁর বলিষ্ঠ পদক্ষেপগুলো জামেয়াকে এগিয়ে নিয়েছে।

জামেয়ার আসাতিযায়ে কেরাম কীভাবে পড়াচ্ছেন; মাঝেমধ্যে তিনি সরাসরি ক্লাসের সামনে উপস্থিত হয়ে প্রত্যক্ষ করতেন। যেমনটা জামেয়ার প্রতিষ্ঠাতা আরিফবিল্লাহ হযরত মাওলানা হাফিজ আকবর আলী রহ.’র মাঝে বিদ্যমান ছিলো। তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত বলা এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে সম্ভব নয়। আল্লাহর রহমত শামিলেহাল হলে ইনশাআল্লাহ তাঁকে নিয়ে জীবনীগ্রন্থ লেখার ইচ্ছে রয়েছে।

দারস-তাদরীস, ওয়াজ-নসীহতের পাশাপাশি লেখালেখিতেও তাঁর হাত পাঁকা ছিলো। তাফসীরে বায়যাবীর উর্দূ ব্যাখ্যাগ্রন্থ তাকরীরে কাসেমী, বুখারী শরীফের (ইফাবা কর্তৃক প্রকাশিত ২৮নং পারার) বঙ্গানুবাদ, হায়াতে ঈসা, সত্যের আলোর মুখোশ উন্মোচন, আদাবুল মুতাআল্লিমীন, প্রচলিত মোজার ওপর মাসেহ করা বৈধ নয় কেন? তাঁর অমরকীর্তি। তাঁর অসাধারণ মেধা, প্রজ্ঞা, বাগ্মিতা এবং কুরআন-হাদীসের অধ্যাপনা ও বিশদ ব্যাখ্যার জন্য তিনি অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

দ্বীনের প্রচার-প্রসারের জন্য তিনি দেশ-জাতির কাছে অমর হয়ে থাকবেন। থাকবেন ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য আলোর দিশারী হয়ে। গেলো ৩ রজব ১৪৪০ হি. মোতাবেক ১১ মার্চ ২০১৯ ঈ. সোমবার ৬৩ বছর বয়সে তাঁর সাঁজানো- গোছানো বাগান ছেড়ে চলে গেলেন মহান প্রভুর সান্নিধ্যে। লাখো জনতার চোখের জলে বিদায় নিলেন তিনি। মহান আল্লাহ তাঁর যাবতীয় খিদমাত কবুল করুন এবং তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউস দান কুরন, আমীন॥

লেখক: শিক্ষক, জামেয়া ক্বাসিমুল উলূম, দরগাহ হযরত শাহজালাল রহ. সিলেট।

আরএম/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ