বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১২ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫


হে পৃথিবী আমি রমজান বলছি

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

তানভীর সিরাজ

হিজরি ১০ম মাস। লোকে আমাকে রামাজান বলে। বলুক। যার যা-ই ইচ্ছা বলুক, আর লিখুক, তাতে আমার কিচ্ছু যায়-আসে না। তবে আমি চাই তারা যেন আমার ইজ্জতভ্রষ্ট না করুক; আমার ইজ্জত আবরুর হেফাজত করুক। যারা আমার ইজ্জত আবরুর হেফাজত করবে আমি তাদেরকে জান্নাতের রাইয়ান নামক শাহী তোরণ দিয়ে প্রবেশ করাবো।

মূলত আমি রোজাদারের গুনাহ মুক্তজীবন গড়ার এক কর্মশালা, প্রশিক্ষণ কোর্স, আর আত্মশুদ্ধির মাস স্বরূপ। যদি ‘আমান্না সাল্লামনা’ বলে তারা আমল করেন, এবং সিয়াম পালনে পূর্ণ তাকওয়া অবলম্বন করেন তবেই আমি তাদের জন্য দরবারে ইলাহিতে সুপারিশ করবো।

আমি রোজাদারের জাহান্নামের আগুনের ঢাল ও দুর্গ হবো এবং তাদেরকে জান্নাতের রাইয়ান নামক শাহী তোরণ দিয়ে প্রবেশ করাবো। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে-

إِنّ فِي الجَنّةِ بَابًا يُقَالُ لَهُ الرّيّانُ، يَدْخُلُ مِنْهُ الصّائِمُونَ يَوْمَ القِيَامَةِ، لاَ يَدْخُلُ مِنْهُ أَحَدٌ غَيْرُهُمْ.

জান্নাতে রাইয়ান নামক একটি শাহী তোরণ আছে, যা দিয়ে একমাত্র রোজাদারগণই প্রবেশ করবে। অন্য কেউ সে তোরণ দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। (আর যে ব্যক্তি সে রাইয়ান গেট দিয়ে প্রবেশ করবে সে আর কখনো পিপাসার্ত হবে না।) -সহিহ বুখারি ১/২৫৪; সহিহ মুসলিম, হাদিস-১১৫২।

সিয়াম কী? এবার তা জেনে নিই!
সাওম মানে বিরত থাকা। কুকর্ম ও কুচিন্তা ও ইন্দ্রিয় পরিচর্যা পরিহার করে সংগ্রামী হওয়াই রোজার শিক্ষা। রামাজান- এর শাব্দিক অর্থ দগ্ধ করা। সিয়াম সাধনার উত্তাপে; ধৈযের্র অগ্নিদহনে মুসলমান মাত্রই এ মাসে কুপ্রকৃত্তিকে দগ্ধ করে শুদ্ধ পরিশোধিত মানুষে পরিণত হয়। তাই রমজানুল মুবারক দৈহিক, আত্মিক, নৈতিক ও সামাজিক পরিশুদ্ধির প্রশিক্ষণের মাস। ( নির্বাচিত প্রবন্ধ-১, ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন,পৃ. ৩৫)

হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা মুহাম্মদ আশরাফ আলী থানবী রা. বয়ানে বলেন, ‘রামাজান হচ্ছে আল্লাহর দিকে ফিরে আসার মাস। বান্দার কর্তব্য হলো এই মহাফযীলতের মাস থেকে পুরা ফায়দা হাছিল করা, অর্থ্যৎ পিছনের সমস্ত গোনাহ থেকে তাওবা এবং বাকি জীবন আল্লাহর হুকুমমত চলার নতুন প্রতিজ্ঞা করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন-

{يٰأَيُّهَا ٱلَّذِينَ آمَنُواْ كُتِبَ عَلَيْكُمُ ٱلصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى ٱلَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ}البقرة183

হে মুমিনগণ, তোমাদের প্রতি রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের প্রতি ফরজ করা হয়েছিলো, যাতে তোমাদের মধ্যে তাকওয়া সৃষ্টি হয়। (সূরাতুল বাকারাহ-১৮৩)

পুরো রামাজানের এই যে সিয়াম সাধনা, এর আসল মাকছাদ হলো দিলের মধ্যে তাকওয়া পয়দা করা, আর তাকওয়ার মানে হলো অন্তরে আল্লাহ তায়ালার ভয় জাগ্রত হওয়ার মাধ্যমে বিগত জীবনের সমস্ত গুনাহ থেকে তাওবা করার তড়প ও ব্যাকুলতা সৃষ্টি হওয়া এবং সামনের জীবনে আল্লাহর হুকুমমত চলার প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করা।’ (তাওবা-ইসতিগফারের হাকিকত, মাওলানা মুফতি তাকী উসমানী, সম্পাদনা, মাওলানা আবু তাহের মিছবাহ, পৃ. ২৫-২৬)

আমার সময়ে আসমানের সকল দরজা খুলে দেয়া হয়, খুলে দেয়া হয় রহমতের সবকপাট আর বন্ধ করে দেয়া হয় আজাব-গযবের জাহান্নামি সমস্ত প্রবেশপথ। তাই আমাকে অবহিত করা হয় রহমতের, মাগফিরাতের এবং নাযাতে- ভগ্নাংশের মাস রূপে।

রমজান মাস ঘনিয়ে আসলে সাহাবাগণকে সুসংবাদ দিয়ে বলতেন- ‘রমজানের প্রথম রাতে দুষ্ট শয়তানকে শৃঙ্খলিত করে দেওয়া হয়। জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়।

জাহান্নামের সব দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কল্যাণের প্রতি আহবান করা হয় এবং অকল্যাণকে বিতাড়িত করা হয়। রমজানের প্রতি রাতেই অসংখ্য মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়া হয়।’ (তিরমিজি, হাদিস নং: ৬৮২)

আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্তা নিয়ে যে ব্যক্তি এই সময়ে রোজা রাখবে, তার অতীতের সমস্ত ছগিরা বা ছোট ছোট গোনাহ মাফ করে দেয়া হবে। রোজাদারের আনন্দঘন সময় দু'টি, এক: ইফতারের সময়, দুই: মহানপ্রভুর সাক্ষাত-সময়।

রামাযানের ২০ রাকাত তারাবি হযরত উমরের যুগ থেকে চলে এসেছে। আমি বুঝি দীর্ঘ পরিশ্রমে ২০ রাকাত তারাবি পড়তে হাল যামানার মুসল্লিদের বেশ কষ্ট হয়। তাই বলে কি ৮ রাকাত পড়ে চলে যাবো?!

যারা ৮ রাকাত পড়ে চলে যায় আমি তাদের বহু পশ্চাদে। তারা আমার হক পুরাপুরি আদায় করে নি। হযরত উমরের যুগ আমাকে যেভাবে আদায় করেছে হাল জামানার মুছল্লিদের উচিৎ সেইভাবেই ২০ রাকাত পড়া, ৮ রাকাত নয়।

কারণ তারাবি তো আর তাহাজ্জুদ নয়। ২০ রাকাত তারাবির মেহনতের বিনিময়ে মুছল্লিদের সমস্ত ছগিরা গোনাহ মার্জিত হয়।
- পল্লি কবি জসিম উদ্দিন

তারাবি নামাজ: কবিতায় বলেন,
‘তারাবি নামাজ পড়িতে যাইব মোল্লাবাড়িতে আজ,
মেনাজদ্দীন, কলিমদ্দীন, আয় তোরা করি সাজ।

চালের বাতায় গোঁজা ছিল সেই পুরাতন জুতা জোড়া,
ধুলাবালু আর রোদ লেগে তাহা হইয়াছে পাঁচ মোড়া।

তাহারি মধ্যে অবাধ্য এই চরণ দুখানি ঠেলে,
চল দেখি ভাই খলিলদ্দীন, লণ্ঠন-বাতি জ্বেলে।
ঢৈলারে ডাক, লস্কর কোথা, কিনুরে খবর দাও।
মোল্লাবাড়িতে একত্র হব মিলি আজ সারা গাঁও।’

আমি একে সত্তরের মাস। রামাজানের প্রতিটি নেক আমলে সত্তর গুণ নেকি বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এক একটি নফল আমলে এক একটি ফরজের নেকি আর এক একটি ফরয আমলে সত্তর ফরযের নেকি! আমি এমন লাভবান, মর্যাদাপূর্ণ এক মাস।

রামাজানে দিনরাত, রাতদিন দোয়া কবুল হয়। তাই এ সময়কে মূল্যায়ন করা চায়। তবে হাদিস শরিফে এসেছে তিনজন ব্যক্তির দোয়া ফেরত দেওয়া হয় না।

ثَلَاثَةٌ لَا تُرَدّ دَعْوَتُهُمُ: الصّائِمُ حَتّى يفطر، والإمام العادل، ودعوة المظلوم.

তিন ব্যক্তির দুআ ফেরত দেওয়া হয় না: রোজদার ব্যক্তির দোয়া ইফতার পর্যন্ত, ন্যায়পরায়ণ শাসকের দুআ ও মযলুমের দুআ। -সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস ৩৪২৮।

সকল ইবাদত আল্লাহর জন্য। রোজার বহুবিধ বিশেষত্বের কারণে শুধু তাকেই নিজের জন্য খাস করে নিয়েছেন এবং বলেছেন- ‘রোজা তো আমারই জন্য’। তাই রোজার প্রতিদান তিনি নিজেই দান করবেন এবং বে-হিসাব দান করবেন বলে তিনি রোজাদারকে সুসংবাদ দান করেছেন। আল-কাউসার, লাতায়িফ ১৬৮-১৭০।

কখনো আমি ২৯'শা, আবার কখনো ৩০'শা হয়ে থাকি। আমার শুরু রামাযানের চাঁদ দিয়ে আর আমার শেষ শাওয়ালের সূর্য দিয়ে। এ তো, এসবকিছু নিয়েই আমি রামাযান।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ