শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৭ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১১ শাওয়াল ১৪৪৫


ইতিকাফের ২১টি মাসয়ালা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতী সুহাইল আবদুল কাইয়ূম

ইতিকাফ কী? শরীআতে এর বিধান কী?: ইতিকাফ আরবি শব্দ, যার অর্থ অবস্থান করা, আবদ্ধ করা বা আবদ্ধ রাখা। পরিভাষায় ইতিকাফ হলো, ইবাদাতের উদ্দেশ্যে ইতিকাফের নিয়তে নিজেকে নির্দিষ্ট জায়গায় নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আবদ্ধ রাখা। যিনি ইতিকাফ করেন তাকে মুতাকিফ বলে।

রমজানের শেষ দশদিন তথা ২০ রমযান সূর্যাস্তের পূর্ব থেকে ঈদের চাঁদ তথা শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা যাওয়া বা ৩০তম রমযান এর সূর্যাস্ত পর্যন্ত ইতিকাফ করা সুন্নাতে মুআক্কাদায়ে কিফায়া। কোনো মসজিদে মহল্লার কয়েকজন বা কোনো একজন আদায় করলে সবাই দায়মুক্ত হয়ে যাবে। আর কেউ-ই আদায় না করলে সবাই দায়ী থাকবে। তবে যারা আদায় করবেন শুধু তারাই সাওয়াবের অধিকারী হবেন।

১০ দিনের কম যতটুকু সময় ইতিকাফ করবে তা নফল ইতিকাফ হিসাবে গণ্য হবে। পুরুষরা মসজিদে ইতিকাফ করবে আর মহিলারা নির্দিষ্ট ঘরে বা নির্ধারিত কক্ষে ইতিকাফ করবে।

ইতিকাফ তিন প্রকার: ১. ওয়াজিব: যেমন মান্নতের ইতিকাফ।
২. মুস্তাহাব: যেমন রমযানের শেষ ১০ দিন ব্যতীত যতো ইতিকাফ করা হবে, তা সবই মুস্তাহাব ইতিকাফ।
৩. সুন্নাতে মুআক্কাদাহ: যেমন রমযানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করা সুন্নাতে মুআক্কাদায়ে কিফায়া।

রমজানের শেষ দশ দিন ইতিকাফ করা সুন্নাতে মুআক্কাদায়ে কিফায়া। অর্থাৎ এলাকাবাসীর কোনো একজনও যদি ইতিকাফ করে তাহলে সকলেই দায়িত্বমুক্ত হয়ে যাবে। আর কেউ না করলে সকলেই সুন্নাত ছেড়ে দেওয়ার জন্য দায়ী হবে। -ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ১/২১১।

ইতিকাফ অবস্থায় মসজিদে কী করবে?: ইতিকাফ অবস্থায় চুপ থাকাকে সাওয়াব মনে করে চুপ থাকা মাকরূহ। তদ্রুপ ইতিকাফ অবস্থায় বেকার বসে থাকাও ঠিক নয়। সাধ্যমত কুরআন তিলাওয়াত, নফল নামায, উমরী কাজা, তাসবীহ-তাহলীল পড়তে থাকবে। -ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ১/২১২-১৩।

পারিশ্রমিক দিয়ে ইতিকাফে বসানো: পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ইতিকাফ করা ও করানো উভয়টাই নাজায়েজ। এভাবে ইতিকাফ করালে মহল্লাবাসী দায়মুক্ত হবে না। -বাদায়িউস সানায়ে : ২/৪৫৫।

ইতিকাফ অবস্থায় দুনিয়াবী কাজ করা: ইতিকাফ অবস্থায় বিনা প্রয়োজনে দুনিয়াবী কাজ যেমন, বেচা-কেনা ইত্যাদিতে লিপ্ত হওয়া মাকরূহ। তবে বিশেষ প্রয়োজনে মসজিদে মাল না এনে বেচা-কেনার চুক্তি করতে পারবে। -রদ্দুল মুহতার : ৩/৪৪০।
পেশাব-পায়খানা ও গোসলের জন্য মসজিদ থেকে বের হওয়া: পেশাব-পায়খানা, উযূ ও ফরজ গোসলের জন্য মসজিদ থেকে বের হওয়া জায়েজ আছে। কিন্তু বায়ু ত্যাগ করার জন্য মসজিদ থেকে বের হওয়া জায়েজ নেই। -রদ্দুল মুহতার : ৩/৪৩৫।

ফরয গোসল ছাড়া প্রতিদিন আমরা যে গোসল করে থাকি, তার জন্য মসজিদ থেকে বের হওয়া জায়েজ নেই। তবে একান্ত প্রয়োজন হলে পেশাব-পায়খানার জন্য বের হয়ে ওজু করতে যে পরিমান সময় লাগে সে পরিমাণ সময়ে গোসল করতে পারবে। এর চেয়ে বেশি সময় ব্যয় করা যাবে না। -ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ১/২১২।

খাবার আনার জন্য বাসায় যাওয়া: খাবার পৌঁছানোর কেউ না থাকলে ইতিকাফকারী নিজে গিয়ে খাবার আনতে পারবে। -রদ্দুল মুহতার : ৩/৪৩৫।

শুকনা কাপড় আনতে মসজিদের বাইরে যাওয়া: গোসলের পর যদি ইতিকাফকারী মসজিদের বাইরে কাপড় শুকাতে দেয়, তাহলে শুধু কাপড় আনার নিয়তে বাইরে যাওয়া যাবে না। বরং অন্য কারো মাধ্যমে আনাবে বা ইস্তিঞ্জা করতে গিয়ে আনবে। -আল বাহরুর রায়েক : ২/৩০৩; বাদায়েউস সানায়ে : ২/২৮৪।

জানাযা পড়ার জন্য মসজিদের বাইরে যেতে পারবে না: জানাজার জন্য বের হতে পারবে না। তবে পেশাব-পায়খানার জন্য বের হলে বিলম্ব না করে পথে জানাজা পড়ে নিতে পারবে। -রদ্দুল মুখতার : ৩/৪৩৫।

মসজিদের বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলা: পেশাব-পায়খানা বা ওজুর জন্য বের হয়ে পথিমধ্যে কারও সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলা নাজায়েজ। এর দ্বারা ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। -ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ১/২১২।

২০ তরিখের সূর্যাস্তের পূর্বে ইতিকাফে কেউ বসতে না পারলে: কোনো এলাকার মসজিদে যদি ২০ তরিখের সূর্যাস্তের পূর্বে কেউ ইতিকাফে না বসে তাহলে পরবর্তীতে হলেও ইতিকাফে বসা চাই। যাতে যথাসম্ভব সুন্নাতের উপর আমল হয়ে যায়। -ফাতাওয়ায়ে দারুল উলুম : ৬/৫০৮।

ভুলে মসজিদ থেকে বের হয়ে গেলে: ইতিকাফকারী যদি ইতিকাফের কথা ভুলে গিয়ে মসজিদ থেকে বের হয়ে যায় তাহলেও তার ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। -ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ১/২১২।

জুমার সুন্নাত গোসলের জন্য বের হওয়া: ইতিকাফ অবস্থায় জুমার সুন্নাত গোসলের জন্য বের হওয়া যাবে না। তবে পেশাব-পায়খানার জন্য বের হলে আসার পথে জুমার সুন্নাত গোসল করে আসতে পারবে। -ইমদাদুল আহকাম : ৪/১৪২।

স্বপ্নদোষ হলে ইতিকাফ নষ্ট হবে না: ইতিকাফ অবস্থায় স্বপ্নদোষ হলে ইতিকাফ নষ্ট হবে না। -ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ১/২১৩।

বিনিময় নিয়ে মসজিদে কাজ করা: ইতিকাফ অবস্থায় বিনিময় নিয়ে মসজিদে কোনো কাজ করা যাবে না। -ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ১/১১০।

ইতিকাফকারীদের জন্য মসজিদের কোণে পর্দা টানানো: ইতিকাফকারী মসজিদের এক কোণে পর্দা টানিয়ে ইতিকাফের জন্য জায়গা নির্দিষ্ট করতে পারবে বরং এটা মুস্তাহাব। তবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত জায়গা আটকানো থেকে বিরত থাকা উচিত। কাতার সোজা করার ক্ষেত্রে যেনো কোনো সমস্যা না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখা জরুরি। তবে মুসল্লিদের জায়গা সংকুলান না হলে জামাআতের সময় পর্দা উঠিয়ে দিতে হবে। -ফাতাওয়ায়ে রহিমিয়া : ৭/২৭৮।

ইতিকাফের জন্য স্বামীর অনুমতি নেয়া: যে সব মহিলাদের স্বামী আছে, তাদের সুন্নাত ইতিকাফের জন্য স্বামীর অনুমতি নেওয়া জরুরি। অন্যথায় ইতিকাফ দুরস্ত হবে না। -ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ১/২১১।

ইতিকাফের জন্য হায়েজ-নেফাস থেকে পাক হওয়া: মহিলাদের ইতিকাফের জন্য মাসিক থেকে পবিত্র থাকা শর্ত। অতএব ইতিকাফের পূর্বেই মাসিকের শুরু এবং শেষের দিন-তারিখ হিসাব করে নেওয়া উচিত। যাতে ইতিকাফ শুরু করার পর তা নষ্ট না হয়ে যায়। -ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ১/২১১।

কোনো কারণে ইতিকাফ নষ্ট হয়ে গেলে: পুরুষ বা মহিলার ইতিকাফ কোনো কারণে নষ্ট হয়ে গেলে পরবর্তীতে তা রোজাসহ কাজা করে নিতে হবে। যে দিনের ইতিকাফ নষ্ট হয়েছে সে দিনের কাযা করা ওয়াজিব। আর বাকি দিনগুলোর কাযা করা উত্তম। -ইমদাদুল ফাতাওয়া : ২/১৫৪।

মহিলাদের জন্য ইতিকাফের নির্ধারিত স্থান থেকে বের হওয়া: মহিলাদের জন্য ইতিকাফের নির্ধারিত স্থান থেকে পেশাব-পায়াখানা ছাড়া অন্য কোনো প্রয়োজনে বের হওয়া জায়েজ নেই। বের হলে ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। -ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ১/২১১।

ইতিকাফ অবস্থায় প্রয়োজনে মোবাইলে কথা বলা যাবে: ইতিকাফ অবস্থায় প্রয়োজনে নিজের পরিবার-পরিজন বা অন্য কারো সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করা যাবে। -ফাতাওয়া মাহমুদিয়া : ১৫/৩০৩।

বিশেষ প্রয়োজনে ইতিকাফ ভাঙ্গা যাবে: ইতিকাফকারী গুরুতর অসুস্থ হলে, মামলা-মুকাদ্দামার তারিখ পড়লে বা পরিবারের কেউ অসুস্থ কিন্তু সেবা করার লোক নেই, এসব প্রয়োজনে মসজিদ থেকে বের হতে পারবে তবে এর দ্বারা ইতিকাফ ভেঙ্গে যাবে। -ফাতাওয়া মাহমুদিয়া : ১৫/২৯৯।

ইস্তিঞ্জা করতে বাড়িতে যাওয়া: মসজিদে টয়লেট না থাকলে বা হাই কমোড টয়লেট প্রয়োজন হলে এর জন্য ইতিকাফকারী তার ঘরের টয়লেটে যেতে পারবে। তবে পথিমধ্যে বা ঘরে দেরি করলে ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। -রদ্দুল মুখতার : ৩/৪৩৫ ।

লেখক: নায়েবে মুফতি ইসলামিক ফিকহ একাডেমী ঢাকা

-এএ


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ