বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১২ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫


ধর্ষণের মহামারি: যা ভাবছে কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীরা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

রকিব মুহাম্মদ
যুগ্ম বার্তা সম্পাদক

দেশে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলছে। প্রায় প্রতিদিনই সংবাদমাধ্যমে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় ধর্ষণের খবর পাওয়া যাচ্ছে। স্কুলছাত্রী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী, গৃহবধূ, মডেল-অভিনেত্রী, প্রতিবন্ধী নারী, এমনকি শিশু, কেউই রেহাই পাচ্ছে না ধর্ষণের কবল থেকে।

চলতি বছরের প্রথম চার মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে শতাধিক। যা শুধু আলোচনায় এসেছে। এর বাইরে তো রয়েছে অনেক। লোক-লজ্জা বা সম্মানের ভয়ে প্রকাশ করেনি ভুক্তভোগীরা।

দেশে এ অপরাধ প্রতিরোধে রয়েছে কঠিন শাস্তির বিধান সম্বলিত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন। কিন্তু তারপরেও কেন ঠেকানো যাচ্ছে না ধর্ষণের ঘটনা? বরং ক্রমশ বেড়েই চলেছে এ অপরাধ। কওমি মাদরাসার তরুণ প্রজন্মও ভাবছে এই মহামারির কারণ ও প্রতিকার নিয়ে।

মুহাম্মদ আবু মুসা, জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলূম মাদানিয়া যাত্রাবাড়ী। 

ধর্ষণ এক বিশাল মহামারি আকার ধারণ করছে এখন। একেকজন একেকভাবে এত্থেকে উত্তরণের পথ বলছেন। কিন্তু কেউই এর মূল কারণ নির্ণয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করছেন না। সে জায়গায় প্রশ্ন থেকেই যায়। অনেকেই প্রশ্ন তুলেন- পোশাকই যদি ধর্ষণের কারণ হয়ে থাকে, তাহলে ছোট্ট শিশু এবং বোরকাওয়ালিরা ধর্ষণ হচ্ছে কেন? আমি মনে করি এটাও তাদের ভুল ধারণা।

কারণ একটাই- আজ ছোট্ট শিশু বা বোরকাওয়ালি ধর্ষণ হলে এগুলা প্রকাশ পাচ্ছে খুব সহজে, আর এটা এজন্যই যে এরা মূলত এ কালচারের না। তাই অটোমেটিক তারা নিজ লজ্জা এবং দায়িত্ববোধ থেকে অকপটে সব খুলে বলে দিচ্ছে নিজ অভিভাবকদের। এর বিপরীতে, হাজার হাজার মেয়ে প্রতিনিয়ত ধর্ষণ হচ্ছে, কিন্তু এটাকে তারা স্রেফ ইনজয় মনে করছে, তাই এগুলা আর বলেকয়ে ধর্ষণ বলে প্রকাশ হচ্ছে না।

প্রতিটা মানুষকে আল্লাহ পাক নির্দিষ্ট যৌন ক্ষুধা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। এবং এটাকে স্বচ্ছ পন্থায় তার নির্দিষ্ট স্থানে বিবাহের মাধ্যমে কভারেজ করার সে পন্থাও দিয়েছেন। কিন্তু যারা এ ক্ষেত্রে কৃত্রিম উপায়ে নিজের মাঝে সে যৌন চাহিদাটা আরও দিগুণ করে, সেই তখন যৌন উন্মাদ হয়ে এসব কাজে জড়িয়ে পড়ে।

আর সেই সব কৃত্রিম বস্তুই হলো- নগ্ন চলাফেরা, মিডিয়া এবং চলচিত্র-নাটকে অশালীন পোশাকের ছড়াছড়ি। এবং সর্বত্রই ভারতীয় চ্যানেল'র খোল্লামখুল্লা প্রদর্শনী। তাই জোর দিয়ে বলছি- ধর্ষণের মহামারি বন্ধ করতে তার মূল কারণ নির্ণয় করি। অন্যথায় তা শুধু বেড়েই চলবে।

মুহাম্মদ রকিব হাসান, জামিয়া ইমদাদুল উলুম ফরিদাবাদ

সময়টা ভালো যাচ্ছে না বর্তমান বাংলাদেশের। আমাদের দেশের পরিবেশ প্রকৃৃতিকে নিন্দিত করছে যে ক’টি কারণ তার অন্যতম ধর্ষণ। হঠাৎ-ই যেন বেড়ে গেল ধর্ষণের আপদ। এর কারণ হিসেবে কেউ বলছেন পুরুষের নৈতিকতাই দায়ী। কেউ বলছেন না এর পেছনে দায়ী পোশাক সংস্কৃতির নগ্নতা।

আসলে কি এই দুটির মাঝে কোনো তফাৎ আছে? আমি তো বলি না কোনো তফাৎ নেই। বরং বিষয়টি এভাবে যদি দেখি যে, নৈতিকতার অধঃপতন আরো ঢের আগে থেকেই শুরু হয়েছে। সেসবের অন্যতম হলো, নগ্নতা অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, ছেলে মেয়েদের অবাধ মেলামেলা, ব্লু ফিল্মের সহজলভ্যাতা এবং যৌন উদ্দীপক খোলামেলা পশ্চিমা সংস্কৃতির বার্তাবাহী পোশাক যা আমাদের পরিবেশের সাথে একদমই বেমানান।

অর্থাৎ স্পষ্ট করে যেটা আমি বলতে চাচ্ছি তাহলো, পুরুষের নৈতিকতা ধ্বসের পেছনে পোশাকও অনেকাংশে দায়ী। ইসলাম ধর্মে বারবার নারীকে পর্দার আদেশ দিয়েছে তো ধর্ষণসহ যাবতীয় ফেৎনার দুয়ার বন্ধ করতেই।

পাশাপাশি আমাদের শিক্ষা, পরিবার, সমাজ ও সর্বোপরি রাষ্ট্র থেকে নৈতিকতা বিদায় নিচ্ছে। বিকৃত মানসিকতা একদিনেই তৈরি হয় না। ক্রমান্বয়ে, ধীরে ধীরে। যার পরিণামে ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে।

অনিবার্যভাবে এখানে আরেকটি প্রসঙ্গ এসে যায় সেটা আইন। তথা শাস্তির কঠিন আইন প্রণয়ন করে ধর্ষণ প্রতিরোধ করা। আমি মনে করি, শুধু আইন নয় আজকে ধর্ষণ বন্ধে নৈতিকতার শিক্ষাটাই ছড়িয়ে দিতে হবে। কেবল আইন করে ধর্ষণ প্রতিরোধ আদৌ সম্ভব নয়।

সুতরাং নৈতিকতা হরণ করে এমন সবকিছু বন্ধে সরকারকে প্রয়াসী হতে হবে। মানুষের হৃদয়ে ধর্মীয় মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। বিশেষ সজাগ হতে হবে পরিবারকে। এবং সুষ্ঠু বিচার ও সর্বোচ্চ শাস্তির নিশ্চয়তা দিতে হবে সমাজকে। যেন আইনের কালো ফাঁকে কেউ বেরিয়ে যেতে না পারে। তাইলেই একটি সুন্দর বাংলাদেশ গড়ে উঠবে।

কামরুল হাসান, আল-জামিয়া ইসলামযি়া দারুল উলূম মাদানিনগর

ধর্ষণ' প্রথমত এটা চরম পর্যায়ের বর্বরতা ও নৃশংসতা। আমার মনে হয় 'মানবিক অবক্ষয়' থেকেই এর ঘৃণ্য সূচনা। একজন ধর্ষক ক্ষেত্র বিশেষে একটি পশুর প্রতিরূপ। এ বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে বেশ কয়েকটি কারণে ধর্ষন প্রবণতা বাড়ছে।সেসব বিষয়গুলোর পূর্ণ প্রতিরোধ এবং কিছু বিষয়ে যত্নশীল হওয়ার মাধ্যমেই এ 'সামাজিক ব্যাধি' নির্মূল করা যেতে পারে।

প্রথমত বলব, ধর্মের আবহে থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণে ধর্ষণের প্রবণতা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।'এটা কেউ মানুক চাই না মানুক। মূল কথা এটাই, কোনও জাতি কোনও ধর্ম ছাড়া পূর্ণ নয়। সভ্যও হতে পারবেনা কেউ। যে যে ধর্মেরই হোকনা কেন, কোনও ধর্মই কিন্তু অপরাধ এবং ধর্ষনের অনুমতি দেয় না। আর ধর্ম পালনের মাধ্যমেই মানুষ শুদ্ধ ও পবিত্রতার ছায়ায় থাকে।পাপ থেকে বেঁচে থাকার কঠোর অভিপ্সা নিয়ে জীবন পরিচালিত করতে থাকে।

পুরুষ এবং নারী দুজনের ব্যাপারেই পর্দার বিধান আছে। প্রত্যেকেই স্ব- স্ব'অবস্হান থেকে পর্দার সঠিক প্রয়োগ। শুধুমাত্র নারীদের পোষাক নিয়ে আপত্তি না তুলে, তাদেরকে পর্দার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে পুরুষদেরও যথাসম্ভব মানসিক উন্নতি সাধন।

যথাযথ আইনের প্রয়োগ না করার কারণে এই অপরাধ মহামারীর আকার ধারণ করছে সুতরাং, ধর্ষককে সর্বোচ্য শাস্তির আওতায় এনে তিনদিনের মাঝে বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা। এবং সোশ্যাল মিডিয়া ও ইন্টারনেটের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার। অতএব, এ সমস্ত বিষয়ে সরকার ও দায়িত্বশীলদের পূর্ণ হস্তক্ষেপ।

আয়েশা আক্তার, রামপুরা জাতীয় মহিলা মাদরাসা

ধর্ষণ একটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক ব্যাধি! তবে তার কুপ্রভাব আচ্ছন্ন করে গোটা সমাজকে। একটি মানুষের ভেতর যখন যৌনতার চুড়ান্ত বিকৃতি ঘটে তখনই সে ধর্ষণের মত একটা গর্হিত অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে!

এক্ষেত্রে কোন এক পক্ষকে দায়ী করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়! বরং এক্ষত্রে পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্র যার যার অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে। পরিবারের উচিৎ ছেলে হোক বা মেয়ে হোক উভয়কে যথেষ্ট রক্ষণে রাখা! ধর্ম কাউকেই অবাধ যৌনাচারের শিক্ষা দেয়না। তাই তাদেরককে ধর্মের বানী শোনানো! এবং যথাসময়ে তাদের বিবাহের বন্দবস্ত করা।

সামাজিক ভাবেও এর প্রতিকারের জুড়ি নেই। ধর্ষণ প্রতিকারে পরিবার ও সমাজের পাশাপাশি সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পার রাষ্ট্র তথা সরকার! ধর্ষণ প্রতিরোধে ইসলামী অনুশাসন অনুযায়ী স্তরভেদে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রাখা। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে চলমান সকল পর্ণসাইট বন্ধ করে দেওয়া।

সর্বোপরি সরকারী বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোতে যৌন আবেদনময়ী অশ্লীল সিনেমা, নাটক প্রচার বন্ধ করা এবং এসবের নির্মাতাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা! এসব কিছুই পারে ধর্ষণ প্রতিরোধে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে!

আরএম/


সম্পর্কিত খবর