বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১১ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫


সন্তানদের যেভাবে গড়ে তুলেছেন জকি ও নকির বাবা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

দাওরায়ে হাদীসে (তাকমিল) দেশসেরা মেধাবী ছাত্র জকি ও নকির সেরা হওয়ার পেছনের গল্প জানতে কথা হয় তাদের পিতার সাথে। পিতা মুফতি রহীমুদ্দীনপাকিস্তানের আল্লামা মুফতি তাকি উসমানির স্নেহধন্য শাগরেদ। তাই নিজের সন্তানদেরও মুফতী শফী রহ. এর সুযোগ্য পুত্রদের মতোই গড়ে তুলতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি তাকি সাহেবের অনুমিতক্রমে ছেলের নামও রেখেছেন তাকী। আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকমের হাটহাজারী প্রতিনিধি মুহাম্মাদ ইশতিয়াক সিদ্দিকীর সঙ্গে আলাপচারিতায় সন্তানদের ছোটবেলা থেকে গড়ে তোলার সেই গল্প শোনালেন মুফতি রহীমুদ্দীন


আওয়ার ইসলাম: প্রিয় সন্তানদের ঈর্ষণীয় সাফল্যে আপনার অনুভূতি কী?

মুফতি রহীমুদ্দীন: আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহ পাকের বিশেষ দয়া ও মেহেরবাণীতে এ বিরাট নিয়ামত অর্জিত হয়েছে। তবে এই অর্জনটি জীবনের চূড়ান্ত পর্যায়ের সফলতা নয় এবং তাতে অতিখুশি ও আনন্দিত হওয়ার কোন যৌক্তিকতা নেই। কারণ তাদের সামনে পাড়ি দেওয়ার মতো অনেক পথ বাকি রয়েছে এখনো।

মুজাদ্দিদ আশরাফ আলী থানবী রহ. এর একটি মলফুজ (উক্তি) মনে পড়ছে, যার মর্মার্থ হল – “একজন তালিবে ইলমের জন্য পরীক্ষার সফলতা বা বিজ্ঞ আলেম হওয়া বড় খুশির বিষয় নয় বরং ইলমী প্রজ্ঞার সাথে সাথে উত্তম ইসলামি জীবন গঠনের মাধ্যমে নিজেকে একজন যোগ্য, আদর্শবান ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে গঠন করাই হলো আসল সফলতা।”

দৃষ্টান্ত স্বরূপ আমি বলব, বিশ্বনন্দিত আলেমেদীন, আল্লামা সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদবী রহ., বর্তমান বিশ্বের বরেণ্য ব্যক্তিত্ব, আমার প্রাণপ্রিয় শিক্ষক, শায়খুল ইসলাম আল্লামা তাকি উসমামি এবং আমার মাহবুব উস্তাদ, উস্তাজুল উলামা আল্লামা আহমদ শফী দামাত বারাকাতুহুমসহ অন্যান্য মনীষীগণ নিছক আরবি সাহিত্য, তাফসির, হাদিস ও ফিকাহ শাস্ত্রে পাণ্ডিত্য, শিক্ষকতার যোগ্যতা, বংশীয় পরিচয়, আন্তর্জাতিক খ্যাতি, মানসম্পন্ন লেখক-গবেষক কিংবা বড় মাপের শিক্ষক হওয়াতেই সারা বিশ্বে সাড়া জাগানো গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেননি।

বরং তাদের মাঝে বিদ্যমান উল্লেখিত গুণাবলীর যথার্থ মূল্যায়ন রয়েছে কারণ তারা বিশেষভাবে অনুপম সুন্নতি চরিত্র ও একজন আদর্শবান অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজেদের গঠন করেছেন। বিষয়টি অত্যন্ত সূক্ষ্ম। বর্তমান সমাজের পরদে পরদে অতি মূল্যবান এই বস্তুটির অভাব অনুভব হচ্ছে।

আওয়ার ইসলাম: একটি সফল শিক্ষাজীবন পার করতে অভিভাবকদের ভূমিকা অন্যতম। আপনিই জকি ও নকির অভিভাবক। ছোটবেলা থেকে তাদের কীভাবে গড়ে তুলেছেন?

মুফতি রহীমুদ্দীন: এ ক্ষেত্রেও আমি মহান রাব্বুল আলামীনের অশেষ মেহেরবানীর কথাই বলব। তার বিশেষ দয়ায় আমাদের পারিবারিক ও ঘরোয়া পরিবেশ সন্তানদের শিক্ষা জীবনের জন্য অত্যন্ত অনুকূলে ছিল। ব্যক্তিগত জীবনে আমি নিজে শিক্ষক এবং তাদের আম্মা একজন আদর্শ শিক্ষিকা। চট্টগ্রাম লালখান বাজার মাদরাসার বেষ্টনীতে বসবাসের কারণে তাদের ছোটবেলার পড়ালেখা অত্যন্ত ইলমী পরিবেশে সম্পন্ন হয়েছে। পরবর্তীতে আরো উন্নত শিক্ষা ও তরবিয়্যত অর্জনের লক্ষ্যে তারা ৭ বছর পূর্বে দারুল উলূম হাটহাজারীর নূরানী পরিবেশে ভর্তি হয়েছিল।

দারুল উলূম হাটহাজারী সম্মানিত মুরুব্বিগণের বিশেষ দোয়া, সহযোগিতা ও সুদৃষ্টি তাদের সাফল্য অর্জনে যথেষ্ট সহায়ক হয়েছে। ক্লাসে নিয়মিত উপস্থিতি, অহেতুক সময় নষ্ট করা থেকে বিরত রাখা, উত্তম উত্তম তালিবে ইলম হিসেবে তাদের চরিত্র গঠনের বেলায় আমরা সজাগ ছিলাম এবং আসাতিযায়ে কেরাম অনেক সচেষ্ট ছিলেন। মেধা ও সৎ চরিত্র বিকাশে অন্তরায় পরিবেশ, মূল্যবান সময় নষ্টকারী উপকরণ যথা স্মার্টফোন ইত্যাদি ব্যবহারের হাতে তাদেরকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছি। আমাদের প্রাণপ্রিয় উস্তাদ মুহতামিম সাহেব দামাত বারাকাতুহুমসহ অন্যান্য উস্তাদের খেদমতে উপস্থিত হয়ে সন্তানদের প্রতি তাদের আন্তরিক দোয়া ও সুদৃষ্টি কামনার চেষ্টা করেছি।

বলাবাহুল্য, সন্তানদের নিত্য প্রয়োজনীয় খাবার-পানীয়, জামা-কাপড়সহ পড়ালেখার যাবতীয় উপকরণ অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে যোগান দেওয়ার সাথে সাথে মাদরাসার অভ্যন্তরে কিংবা বাইরে তাদের প্রতি সার্বিক নজর রাখার ক্ষেত্রে আমরা অত্যন্ত বড় ভূমিকা রেখে আসছিলাম।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বিগত ৭ বছর সন্তানেরা আমি অথবা আমার কোনো প্রতিনিধি ব্যতীত একাকীভাবে মাদরাসার ক্যাম্পাস হতে বাহিরে ঘুরতে কিংবা প্রয়োজনে বের হয়েছে কিনা আমার সন্দেহ! প্রতি ২ সপ্তাহ পর নিয়মিত ছুটিতে বাসায় বেড়াতে আসার ক্ষেত্রে আমি নিজে সাথে থেকে তাদের আনা-নেওয়ার ব্যাপারে সচেষ্ট ছিলাম। এই দীর্ঘ সময়ে বাসায় বেড়াতে আসার সংখ্যা যদি ২০০ বার হয় তার মধ্যে ১৯৫/১৯৬ বার আমি নিশ্চিতভাবে তাদের সাথে ছিলাম। একাকীভাবে ড্রাইভার অথবা আপন কোন প্রতিনিধির সাথে বাসায় আসা যাওয়ার সংখ্যা ৪/৫ বার এর চেয়ে বেশি হবে না।

পাঠকদের জন্য বিষয়টি আরো একটু খোলাসা করছি, নিজের পেশাগত দায়িত্ব ছাড়াও দেশ-বিদেশে আমার যথেষ্ট সফর করতে হয়। বছরে ৮/১০ সংক্ষিপ্ত সফরে বিদেশে যেতে হয়। এরই মধ্যে তাদের বাসায় বেড়াতে আনা-নেওয়ার জন্য অনেক সময় আমার দেশি-বিদেশী সফরকে এগিয়েছি অথবা সংক্ষিপ্ত করেছি। তেমনিভাবে তারা বেড়াতে আসার সময় পিছিয়েছে অথবা আমার প্রয়োজনে তাদের হাতে মাদরাসার ছুটি থাকা সত্ত্বেও তাদেরকে ছুটি শেষ হবার পূর্বেই পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।

সর্বশেষ যে বিষয়টি ভুলবার নয় তা হল, এই দীর্ঘ সময় মাদরাসার ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে সার্বিক বিষয়ে তত্ত্বাবধান ও তাদের প্রতি যথেষ্ট নজরদারির ভূমিকাসহ আরো অনেক বিষয় যে সকল হিতাকাঙ্খী উস্তাদবৃন্দ মূল্যবান ভূমিকা রেখেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন, আমার ঘনিষ্ট বন্ধু হযরত মাওলানা আশরাফ আলী নিজামপুরী সাহেব।

জকি ও নকির ব্যাপারে মাওলানা বন্ধুবর নিজামপুরী বলেন, ক্লাসরুম ও ঘুমানোর রুমই ছিলো তাদের ছোট্ট পৃথিবী। এ ছাড়া কোথাও যাওয়ার সুযোগ ছিলো না। বাড়ি যাওয়া ছাড়া এমনকি মাদরাসার গেটের বাইরেও যায়নি তারা। নিরবচ্ছিন্ন মেহনত মোজাহাদার মাধ্যমে তারা নিজেদের গড়ে তুলেছে। তাদের এ সাফল্যে আমি অত্যন্ত গর্বিত ও আনন্দিত।)

আওয়ার ইসলাম: তালিবে ইলম ও অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে কোন পরামর্শ?

মুফতি রহীমুদ্দীন: উপরে উল্লেখিত দুইটি উত্তরে সম্মানিত অভিভাবকদের জন্য অনুসরণীয় কিছু বিষয় নিহত আছে। বিশেষভাবে নিজ সন্তান নিয়ে উস্তাদবৃন্দের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা ককরে তাদের জন্য দোয়া ও সুদৃষ্টি কামনা করা অত্যন্ত জরুরি। সন্তানের যাবতীয় প্রয়োজনীয় উপকরণ যোগান দেওয়ার সাথে সাথে তারা আদর্শবান ছাত্র হিসেবে নিজেকে গঠন করার ব্রত নিয়ে নিজেদের পরিচালিত করছে সেদিকে সূক্ষ্ম দৃষ্টি রাখা আবশ্যক।

তালিবে ইলমের উদ্দেশ্যে বলার মত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, ইখলাস। তারা ইখলাস তথা আল্লাহ পাকের সান্নিধ্য অর্জনের লক্ষ্যে আত্মনিয়োগ করলে কখনো পথচ্যুত হবে না। কারণ একজন খাঁটি তালিবে ইলম নিজের মূল্যবান সময় অযথা কাজে নষ্ট করতে পারে না। আল্লাহ প্রদত্ত আমানত 'মেধাশক্তি'কে কাজে লাগিয়ে একজন মুসলিম নিশ্চিত সফলতা প্রান্তে পৌঁছে যাবে।

বর্তমান সময়ের সবচেয়ে স্পর্শকাতর কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট। প্রয়োজনীয় দিক থেকে অবশ্যকীয় হলেও একজন তালিবে মূল্যবান সময় নষ্ট করার জন্য এর কোনো জুড়ি নেই। আমার সন্তানদের স্মার্টফোন থেকে রাখতে সবসময় সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি।

আরএম/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ