বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১২ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫


মেঘনা-গোমতির চরের দুরন্ত সেই শৈশব

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন । । 

আমার জন্ম নিজ গ্রামে। এক সময় আমরা ঢাকা জেলার অন্তর্গত ছিলাম। এখন মুন্সীগঞ্জ জেলার গজারিয়া থানায়। আমার গ্রামের নাম চাষিরচর। সম্পূর্ণ চরাঞ্চল। এক পাশে মেঘনা আরেক পাশে গোমতি নদী। দুই নদীর মাঝখানে একটা চর। আমার জন্ম সেই গ্রামে এবং শৈশব ও কৈশোরের কিছুটা সময় কেটেছে এখানে।

তখনকার কৈশোর মনে হয় সারা বাংলাদেশেই সুন্দর ছিল। সেই সময় মানুষের সংখ্যা ছিল কম। সেই সময়কার বিচারে মানুষের সাদামাটা জীবনপদ্ধতি তা খুব চমৎকারভাবেই সেখানে ছিল। সেখানে আমাদেরও দুরন্ত শৈশব কেটেছে।

আমার পরিবার খুবই সাধারণ পরিবার। আমার বাবা একজন গৃহস্থ মানুষ ছিলেন। আমার দাদার একমাত্র জীবিত পুত্রসন্তান হওয়ায় প্রচুর পরিমাণে জায়গা-জমি আমার বাবার ছিল।

এ হিসেবে আমার বাবা ছিলেন স্বচ্ছল মানুষ। আমার বাবা খুব বেশিদূর লেখাপড়া করতে পারেননি এ কারণে যে, তার আট নয় বছর বয়সে আমার দাদা মারা যান। আর ওই সময় চর এলাকায় খুব ভালো লেখাপড়া করার মতো উপায়-উপকরণও ছিল না। এজন্য আর্থিক স্বচ্ছলতা সত্ত্বেও তাঁর পক্ষে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। পরিবার বলতে আমার বাবা, দুই ফুফু। আমরা ছয় ভাই তিন বোন। আমাদের পরিবারের মধ্যে আমি একাই মাদরাসায় পড়েছি।

শুনেছি আমার বাবার এক বড় ভাই মাদরাসায় পড়তেন। তিনি অনেকটা পড়াশোনা করলেও শেষ করতে পারেননি। যুবক বয়সেই মারা যান। সম্ভবত সেই কারণেই আমার বাবার ইচ্ছা ছিল আমাদের ছয় ভাইয়ের কাউকে আলেম বানাবেন।

আমাদের দূরসম্পর্কের এক চাচা ছিলেন যিনি ওই সময় মানিকগঞ্জের একটি হিফজখানায় পড়াতেন। তখন আমাদের এলাকায় নিয়মতান্ত্রিক কোনো মাদরাসা ছিল না। নিয়মতান্ত্রিক মাদরাসা প্রথম শুরু হয় নারায়ণগঞ্জের দেওভোগে।

আমার বাবা হাফেজ সাহেবের সঙ্গে পরামর্শ করলে তিনি বললেন, কাকা! যাকে পড়াতে চান আমাকে দিয়ে দিন। আমি একদম ‘অ’ ‘আ’ শুরু করার পরপরই আব্বা আমাকে ওই হাফেজ সাহেবের সঙ্গে দিয়ে দিলেন।

মানিকগঞ্জে যেখানে তিনি পড়াতেন সেই মাদরাসাটিও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গড়ে ওঠা কোনো মাদরাসা ছিল না। এজন্য পাশেই সুন্দর একটি স্কুল ছিল। আমার পড়াটা যেন চালু থাকে এজন্য পাশের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। সেখানে আমি ক্লাস ফাইভ-সিক্স পর্যন্ত পড়ি। এরপর আমার বাবা যখন জানলেন আমি স্কুলে পড়ছি আর অবসর সময়টা হিফজখানায় পড়ছি তখন তিনি বললেন, আমি তো এটা চাচ্ছি না। স্কুলে পড়ালে তো আমি বাড়িতে রেখেই পড়াতে পারি।

তারপর আব্বা আমাদের আশপাশে মাদরাসার খোঁজ নিলেন। আমাদের নদী পার হলেই কুমিল্লার দাউদকান্দি। সেখানে ঢাকারগাঁও মাদরাসা বলে একটি মাদরাসা আছে। সেটি অনেক প্রাচীন। আব্বা সেখানে নিয়ে গেলেন।

সেখানে যে মুহতামিম ছিলেন মাওলানা সিরাজুল হক সাহেব, তিনি বললেন ছেলেকে হাফেজ না মাওলানা বানাবেন। আব্বা বললেন মাওলানা। সেই সময় এই পরিবেশ গড়ে ওঠেনি একজন হাফেজও হবে আবার মাওলানাও হবে। হিফজখানায় যিনি পড়তেন তিনি শুধু হাফেজই হতেন। আর কিতাবি লাইনে যিনি পড়তেন তিনি মাওলানাই হতেন। এভাবেই মূলত আমার একাডেমিকভাবে মাদরাসায় ভর্তি হওয়া।

শৈশবে আমাদের পরিবারে আপনজন কেউ মারা যায়নি। ঘনিষ্ঠ কাউকে তখন হারাতে হয়নি। এজন্য হৃদয়ে নাড়া দেয়ার মতো কোনো ঘটনা তখন মনে পড়ে না। তাছাড়া সুচিন্তিতভাবে জীবনকে চিনে-জেনে বুঝে এগিয়ে যাওয়া এটা আমার ক্ষেত্রে ঘটেছে অনেক পরে। আর ছোটবেলায় সম্ভবত কারও মতো হতে চাইতাম না। যখন নাহবেমির পড়ি তখন জীবিত বড় বুজুর্গ হিসেবে হজরত হাফেজ্জি হুজুর রহ.কে দেখি। গ্রাম থেকে তাঁকে দেখতে ঢাকায় চলে এসেছিলাম। এজন্য ছোটবেলায় আমার অন্তরে জেঁকে বসা মানুষ হলেন হাফেজ্জি হুজুর রহ.।

চলবে...
.
[লেখা ও লেখকের কথা নিয়ে প্রকাশিত লেখকপত্রের সৌজন্যে। জুলাই ২০১৯ সংখ্যায় প্রকাশিত আত্মজৈবনিক সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন: জহির উদ্দিন বাবর]

আরএম/


সম্পর্কিত খবর