শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


ভারত কাশ্মীরে গণহত্যা বন্ধ না করলে...

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

হামিদ মির

কাশ্মীরকে বলা হয় ‘আউলিয়াদের জান্নাত’। শ্রীনগর থেকে নিয়ে মোজাফফরাবাদ পর্যন্ত জম্মু ও কাশ্মীরের প্রতিটি শহর ও গ্রামে আউলিয়া ও মাশায়েখের মাজার পাওয়া যায়। এই ভূখণ্ডে ইসলাম তলোয়ারের জোরে নয় বরং হজরত বুলবুল শাহ, সাইয়েদ মির আলি হামদানি, শায়খ নুরুদ্দিন ওলি, শায়খ শামসুদ্দিন ইরাকি এবং হজরত বাবা জুয়ুন শাহর মতো সুফিদের শিক্ষার দ্বারা বিস্তৃত হয়েছে। এটি ওই ভূখ- যেখানে লিল্লাহ আরেফা ও হিব্বা খাতুনের মতো সুফিদের শের (কবিতা) আজও মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত।

আজাদ কাশ্মীরে হজরত মায়ি উম্মি ও হজরত মায়ি তুতির মাজারে ভক্তদের ঢল এ কথা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট, এখানে নারীদের অনেক বেশি সম্মান করা হয়। কিন্তু বর্তমানে অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীরে ভারতীয় বাহিনীর দ্বারা কাশ্মীরি নারীদের প্রতিদিনের সম্ভ্রমহানি দ্বারা লিল্লাহ আরেফার আত্মা প্রতিদিনই কেঁপে ওঠে। আর হাব্বা খাতুনের হয়ত ওই ধোঁকার কথা মনে পড়ে যায় যা বাদশা আকবর তার স্বামী ইউসুফ শাহ চুকের সঙ্গে করেছিলেন। আকবর যখনই কাশ্মীর দখলের চেষ্টা করতেন তখনই কাশ্মীরের শাসক ইউসুফ শাহ চুক তা ব্যর্থ করে দিতেন। অবশেষে বাদশা আকবার ইউসুফ শাহকে সন্ধির প্রস্তাব দেন এবং সাক্ষাতের জন্য দিল্লিতে ডেকে পাঠান।

ইউসুফ শাহের স্ত্রী হাব্বা খাতুন ছিলেন একজন কবি। তিনি স্বামীকে দিল্লি যেতে বারণ করলেন। কিন্তু ইউসুফ শাহ চুক মুঘল বাদশার সম্মানে দিল্লি চলে গেলেন। হাব্বা খাতুনের সন্দেহই সত্য প্রমাণিত হলো। ইউসুফ শাহ চুক দিল্লিতে যাওয়ার পর বাদশা আকবর তাকে গ্রেপ্তার করিয়ে বিহারের একটি কারাগারে পাঠিয়ে দিলেন। স্বামীর বিরহে হাব্বা খাতুন অনেক কবিতা রচনা করেন এবং সুর ধরে তিনি নিজেই তা গাইতেন। ইউসুফ শাহ চুকের সঙ্গে যে ধোঁকাবাজি করা হয়েছিল সেই একই ধোঁকাবাজি দিল্লি কাশ্মীরের ওই লোকদের সঙ্গেও করেছে যারা তাদের ওপর ভরসা করত।

১৫ আগস্ট থেকে জম্মু ও কাশ্মীরকে দিল্লি পুরোপুরি বন্দী করে রেখেছে। ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়েছে অন্তত আট লাখ ভারতীয় বাহিনী কাশ্মীরে গণহত্যা দ্বারা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে সংখ্যালঘুতে পরিণত করার চেষ্টা করছে। এজন্য পাকিস্তান সরকার ওই এলাকায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিষয়টি আন্তর্জাতিক আদালতে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আল্লাহর অশেষ কৃতজ্ঞতা, আমাদের পাকিস্তানের সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে প্রচণ্ড রাজনৈতিক মতভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও অন্তত কাশ্মীর ইস্যুতে পরস্পরকে সহযোগিতা করছে। বিরোধীদের আস্থায় আনার পর সরকার কাশ্মীরের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।

এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, বর্তমানে পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে সংকটে আছে। একদিকে আমরা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফের সামনে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে আছি। অন্যদিকে আমাদের মাথার ওপর আন্তর্জাতিক সংস্থা এফআইটিএফের তলোয়ার ঝুঁলছে। তা সত্ত্বেও আমরা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক ডাকাতে সফল হয়েছি। পাঁচ সদস্যের মধ্যে তিনটিই বৈঠকে আমাদের পাকিস্তানকে সমর্থন করেছে। সবার ধারণা, এই বৈঠক অনুষ্ঠানের ব্যাপারে চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

এটা সত্য যে, এই বৈঠক অনুষ্ঠানের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে; কিন্তু চীন ছাড়াও রাশিয়া এবং ব্রিটেনের ভূমিকাও কম ছিল না। রাশিয়া তার স্বাভাবিক অবস্থান থেকে সরে এই বৈঠক অনুষ্ঠানে বিরোধিতা থেকে বিরত থেকেছে। আর বৈঠকে জাতিসংঘের ভূমিকা তুলে ধরে ফ্রান্সকে অবাক করে দিয়েছে; যে দেশটি নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের পক্ষে লড়ছিল। ব্রিটেন সেই বৈঠকে দাবি তুলেছে, জম্মু-কাশ্মীরে যেসব মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে সেগুলো যেন তদন্ত করে দেয়া হয়।

নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে পাকিস্তানের পক্ষে চীন ছাড়াও রাশিয়া ও ব্রিটেনের জোরালো অবস্থান নেয়া নিঃসন্দেহে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সফলতা। তবে এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা পাকিস্তানি ও কাশ্মীরিদের বিক্ষোভ প্রদর্শনও কম ভূমিকা রাখেনি। নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে মার্কিন প্রতিনিধি যদিও পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেননি; তবে ভারতের পক্ষও নেননি।

নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকের পর পাকিস্তানের উচিত জম্মু-কাশ্মীর ইস্যু জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে তোলা; যারা আগে থেকেই ভারতীয়দের নিপীড়নের চিত্র উন্মোচন করে দিয়েছে। পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তাহমিনা জনজুয়াকে জেনেভার মানবাধিকার কাউন্সিলে এই বিষয়টি তোলার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক আদালত, হিউম্যান রাইট কাউন্সিল ছাড়াও আগামী মাসে জাতিসংঘের সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হবে; সেখানেও এই বিষয়টি তোলা দরকার; যাতে অধিকৃত এলাকায় ভারত মুসলিম গণহত্যা থেকে ফিরে আসে। কিন্তু ভারত এই পথ থেকে ফিরে না এলে পরিস্থিতি আরও মারাত্মক আকার ধারণ করবে।

অতীতে এমন অনেক উদাহরণ আছে, যখনই ভারত অধিকৃত এলাকায় নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়েছে তখনই আজাদ কাশ্মীরের লোকেরা ‘সিজ ফায়ার লাইন’ (অস্ত্র বিরতি রেখা) ভাঙার ঘোষণা দিয়েছে। এ ধরনের ঘোষণা সর্বপ্রথম মুসলিম কনফারেন্স নেতা চৌধুরী গোলাম আব্বাস ১৫ জুন ১৯৫৮ তারিখে দিয়েছিলেন। তিনি ২৭ জুন ‘সিজ ফায়ার লাইন’ তুলে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। চৌধুরী গোলাম আব্বাসকে দমানোর অনেক চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু তিনি কিছুতেই দমে যাননি। অবশেষে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর প্রতিবাদে রাওয়ালপিন্ডি থেকে নিয়ে মোজাফফরাবাদ পর্যন্ত কয়েক দিন লাগাতার বিক্ষোভ হয়েছে।

৩০ জুন ১৯৫৮ লাহোরে অনেক বড় একটি বিক্ষোভ হয়; যার ফলে সরকার চৌধুরী গোলাম আব্বাসকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানের সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ফিরোজ খান নুন। তখন তাকে একদিকে ভারতীয় আগ্রাসন অন্যদিকে চৌধুরী গোলাম আব্বাসের ‘সিজ ফায়ার লাইন’ ভাঙার জেদ সামলাতে হয়েছে। ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারিতে জিকেএলএফ ‘সিজ ফায়ার লাইন’ ভাঙার ঘোষণা দিয়েছিল; যা এখন ‘লাইন অব কন্ট্রোল’। সে সময় পাকিস্তান সরকার এবং কাশ্মীরিরা আরেক দফা মুখোমুখি অবস্থানে আসে এবং অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে।

গত ১৫ আগস্ট পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান মোজাফফরাবাদে অবস্থানকালে আজাদ কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী রাজা ফারুক হায়দার ‘লাইন অব কন্ট্রোল’ ভাঙার ইঙ্গিত দেন। রাজা ফারুক হায়দার মূলত আজাদ কাশ্মীরের জনসাধারণের প্রতিনিধিত্ব করেন। কেননা কাশ্মীরিদের একটি বড় অংশ মনে করে, ভারত ও পাকিস্তান আলোচনা দ্বারা এই সমস্যার সমাধান না করলে এবং জাতিসংঘের ভূমিকাও ফলপ্রসূ না হলে তারা নিজেরাই সেই সীমান্তরেখা তুলে দেবেন যা দুই কাশ্মীরকে বিভক্ত করে রেখেছে।

আউলিয়াদের পুণ্যভূমিকে রক্তপাত থেকে বাঁচানো শুধু পাকিস্তানিদের নয়; বরং গোটা বিশ্বের দায়িত্ব। এজন্য বিশ্ববাসী শুনে রাখুন, ভারত যদি তার অধিকৃত এলাকায় মুসলিম নিপীড়ন থেকে বিরত না থাকে তাহলে আজাদ কাশ্মীর এবং পাকিস্তানের লোকেরা ‘লাইন অব কন্ট্রোল’কে নিজেদের রক্তে রঙিন করা থেকে বিরত থাকবে না।

লেখক: হামিদ মির, পাকিস্তানের বিখ্যাত সাংবাদিক। (২২ আগস্ট দৈনিক জংয়ে প্রকাশিত কলামটি অনুবাদ করেছেন: জহির উদ্দিন বাবর)


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ