শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১২ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫


ছারছীনা মাদরাসার প্রথম শাইখুল হাদিস ছিলেন দেওবন্দের ছাত্র

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুহাম্মাদ হাবীবুর রহমান

বাংলার বুকে ইলমে হাদীসের প্রচার-প্রসারে যারা নিরলসভাবে খেদমত করেছেন, আল্লামা নিয়ায মাখদুম খোতানী রহ. তাদের অন্যতম। তিনি এশিয়ার রাশিয়া ও চীনের সীমান্তবর্তী পূর্ব তুর্কিস্তানের খোতান প্রদেশের ইলচী জেলায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯১৪ অথবা ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। চীন স্বাধীনতার পরবর্তী সময় ঐ এলাকাটি সীংগাঙ নামে পরিচিতি লাভ করে।

তার পিতার নাম শায়েখ মুহাম্মাদ সিদ্দীক রহ. এবং দাদার নাম শায়েখ মুহাম্মাদ রহ.। তারা দুজন ছিলেন তৎকালীন সময়ে খোতান শহরের শ্রেষ্ঠ আলেম। তার মামা শায়েখ আহমদ রহ.ও ছিলেন তৎকালীন সময়ে মুসলিম নেতা। তিনি ঐ অঞ্চলের বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেন।

মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তিনি তার পিতাকে হারিয়ে এতিম হন। এর এক বছর পর তার মাতৃবিয়োগ ঘটে। পিতা-মাতাহীন বালক নিয়াম মাখদুম তার চাচা শায়েখ মুহাম্মাদ কাসেমের তত্ত্বাবধানে বড় হন। তিনি তাকে ভর্তি করান স্থানীয় খালাক মাদরাসায়। সেখানে তিনি আরবী ভাষা, নাহু ও সরফ অধ্যয়ন করেন এবং শরহে জামী পর্যন্ত লেখাপড়া শেষ করেন।

এরপর তিনি উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য খোতান থেকে প্রায় তের মাইল দূরে, বর্তমান পাকিস্তানের নিকটবর্তী শহর ঐতিহ্যবাহী কাশগরে চলে যান। সেখানকার এক মাদরাসায় তিনি ভর্তি হন এবং সাত বছর অধ্যয়ন করেন। উচ্চতর ইসলামী শিক্ষা তথা হাদীস, তাফসীর, ফিকহ, ইলমে মানতিক, ফালসাফা ও অন্যান্য ইলম অর্জন করেন।

কাশগর শহরে যখন চীনের কমিউনিস্ট বাহিনীর আগ্রাসন প্রকট আকার ধারণ করে, তখন তিনি ইসলাম ও দেশ মাতৃকার স্বাধীনতা রক্ষার্থে কমিউনিস্ট বিরোধী আন্দোলনে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। কমিউনিস্টদের সাথে সম্মুখযুদ্ধে টিকতে না পেরে তিনি পাহাড় ঘেরা বরফবেষ্টিত বন্ধুর পথে নানা প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে কাশ্মীর হয়ে সাহারানপুরে হিজরত করেন। এটি ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের কথা।

সাহারানপুরে অবস্থানকালে তিনি ঐতিহ্যবাহী দীনি বিদ্যাপীঠ দারুল উলুম দেওবন্দের সন্ধান পান এবং সেখানে ভর্তি হন। এ মাদরাসায় তিনি একাধারে দশ বছর অধ্যয়ন করেন। এখান থেকে তিনি দাওরায়ে হাদীস ও তাফসীরের সনদ লাভ করেন। তৎকালীন সময় দারুল উলুম দেওবন্দের মুহতামিম ছিলেন মাওলানা কারী তৈয়্যব রহ. এবং শায়খুল হাদীস ছিলেন শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানী রহ.।

প্রখর মেধা ও আশ্চর্য স্মৃতিশক্তির কারণে তিনি প্রত্যেক শ্রেণিতে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন এবং ‘মুমতায’ ছাত্র হিসেবে সকলের নজর কাড়েন। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে তার অধ্যয়ন শেষ হয়। দারুল উলুম দেওবন্দের তার উল্লেখযোগ্য শিক্ষকগণ হলেন শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানী রহ., শায়েখ ইদরীস কান্ধলবী রহ., শায়েখ ই’যায আলী খান রহ., শায়েখ ইবরাহীম বিলইয়াবী রহ. প্রমূখ।

তৎকালীন ছারছীনা দরবার শরীফের পীর অলীয়ে কামেল আল্লামা শাহ সূফী নেছারুদ্দীন আহমদ রহ. তার প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের সর্বপ্রথম কামিল মাদরাসা ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ ছারছীনা দারুচ্ছুন্নাত কামিল মাদরাসায় ইলমে হাদীস শিক্ষাদানের জন্য দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে আল্লামা নিয়ায মাখদুম খোতানী রহ.কে ‘শাইখুল হাদীস’ হিসেবে নিয়োগ দেয়া জন্য মাদরাসা বরাবর একখানা চিঠি লিখেন।

চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে আল্লামা নিয়ায মাখদুম রহ. তার আসাতিযায়ে কেরামের পরামর্শ ও দোয়া নিয়ে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে ভারত থেকে হিজরত থেকে চলেন আসেন বাংলার নিভৃতপল্লী ছারছীনা মাদরাসায়। সেখানে তিনি ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ‘শাইখুল হাদীস’ হিসেবে ইলমে হাদীস পাঠদানে নিয়োজিত ছিলেন।

বাংলাদেশের অনেক প্রথিতযশা উলামায়ে কেরাম তার নিকট শিক্ষা লাভ করেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ড. মুহাম্মাদ মুস্তাফিজুর রহমান, ড. আলী হায়দার মুর্শিদী, ড. মুহাম্মাদ আব্দুর রশিদ, প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ ইয়াহয়া রহমান, ড. মুহাম্মদ সিদ্দীকুর রহমান, ড. মুহাম্মাদ কাফীলুদ্দীন সরকার সালেহী, মাওলানা আ.খ.ম. আবুবকর সিদ্দীক প্রমূখ।

আল্লামা নিয়ায মাখদুম খোতানী রহ. ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ও বহু শাস্ত্রের পন্ডিত। তাফসীর, হাদীস, ফিকহ, কালাম, মানতিক, ফালসাফা, আদব, ইতিহাস, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা প্রভৃতি শাস্ত্রে তার অগাধ পান্ডিত্য ছিল। ইলমে তাসাওউফে তার অবস্থান ছিল অনেক উচু স্তরে। দেওবন্দে অধ্যয়নকালে তিনি শাইখুল হাদীস হুসাইন আহমদ মাদানী রহ. -এর হাতে বাইয়াত হন এবং পরবর্তীতে আল্লামা নেছারুদ্দীন আহমদ রহ. এর হাতে বাইয়াত নবায়ন করেন।

আল্লামা নিয়ায মাখদুম খোতানী রহ. ছিলেন দুনিয়াবিরাগী, পরহেযগার ও প্রচারবিমুখ ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন কুরআন-সুন্নাহর প্রতি অত্যন্ত অনুরাগী। মুতালায়া, দরস, লেখালেখি, যিকির-আযকার ও ইবাদত-বন্দেগীতে তিনি পুরো সময় ব্যয় করতেন।

১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থতার মাত্রা বৃদ্ধি পেলে তাকে ঢাকায় তার শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে আসা হয় এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ অক্টোবর, বুধবার আসরের নামাযের পর তিনি ইন্তেকাল করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররামে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। আজিমপুর নতুন কবরস্থানে প্রবেশদ্বারের সন্নিকটেই এ মহান মনীষীকে দাফন করা হয়।

আল্লামা নিয়ায মাখদুম খোতানী রহ. গ্রন্থরচনা ও লেখালেখির ক্ষেত্রে বেশ এগিয়ে ছিলেন। তার অন্যতম ছাত্র ড. আব্দুর রশিদের ভাষ্যমতে- তিনি সাত খন্ড সিহাহ সিত্তা এবং শামায়েলে তিরমিযীর ব্যাখ্যাগ্রন্থ রচনা করেন। কিন্তু এ ব্যাখ্যাগ্রন্থসমূহ প্রকাশিত হয়নি।

অতি সম্প্রতি আল্লামা নিয়ায মাখদুম খোতানী রহ. এর মেয়ে খালেদা বেগমের একান্ত প্রচেষ্টা ও অর্থায়নে এবং তার ভ্রাতুষ্পুত্র পাকিস্তানের পাঞ্জাবে অবস্থিত জামিউল উলুম ঈদগাহ বাহাওয়ালানগরের শাইখুল হাদীস হযরত মাওলানা শাহ জালীল আহমাদ আখুন দা.বা. এর সার্বিক সহযোগিতায় সুনানে তিরমিযীর ব্যাখ্যাগ্রন্থ মায়ারিফুল খুতানী আলা সুনাতিত তিরমিযী পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত হয়েছে।

এ ব্যাখ্যাগ্রন্থে তিনি কিতাবুত তাহাবারাত তথা পবিত্রতা অধ্যায় থেকে কিতাবুল বুয়ু তথা ক্রয়-বিক্রয় অধ্যায়ের উট বা অন্য কোন প্রাণী ঋণ হিসাবে গ্রহণ সংক্রান্ত পরিচ্ছেদ পর্যন্ত হাদীসসমূহের ব্যাখ্যা করেছেন। দারুল উলুম দেওবন্দে অবস্থানকালে এ ব্যাখ্যাগ্রন্থের অধিকাংশ রচনা করেছেন।

লেখক : শিক্ষার্থী, মাস্টার্স ইন আলহাদীস এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ, দারুননাজাত সিদ্দীকিয়া কামিল মাদরাসা, ঢাকা।

আরএম/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ