শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১০ শাওয়াল ১৪৪৫


সুখি সুখি শরতে

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

যমীর মাহমুদ: গাঢ় নীল আকাশ। সোনা রং রোদ। দক্ষিণা হাওয়ায় উড়ে সফেদ মেঘের খেয়া। হাজারো পাখির কলরবে জেগে উঠে পৃথিবী। নীলিমায় ডানা মেলে উড়ে চলা শালিকের দল। বাঁশঝাড়ে বকের ছানা। বাতাসে দোল খাওয়া কাশফুল। নদীতে ছোট ছোট ঢেউয়ের সাথে নৌকার মিতালি। প্রেমময় জোছনা। নরম আলোয় ভরা রূপালী চাঁদ। আধাঁরে আলোর মশাল-জোনাকি। সবুজে ভরপুর ফসলের মাঠ। নতুন পত্র পল্লবে জেগে উঠা বন বনানী। হাসনাহেনা, শিউলি, মালতির পাগল করা ঘ্রাণ। মাঝে মাঝে রোদ বৃষ্টির লোকচুরি খেলা। রং ধনুর সাত রং। চোখ জোড়ানো মন ভোলানো এ দৃশ্য এক ঋতুতেই দেখা যায়। মোহনীয় সে ঋতুই শরৎ।

শরৎ বাংলার ষড়ঋতুর তৃতীয় ঋতু। ভাদ্র ও আশ্বিন মাস এর বহমান কাল। পৃথিবীর চারটি প্রধান ঋতুর একটি হচ্ছে শরৎকাল। বর্ষা ও হেমন্তের মাঝে এর অবস্থান। বর্ষার রেশ কাটিয়ে নবান্নের দিকে ছুটে চলে শরৎ। এ সময় রাত তাড়াতাড়ি আসে। আবহাওয়া ঠাণ্ডা হতে থাকে। পত্রঝড়া বৃক্ষের পাতারা ঝরে পড়তে শুরু করে এ সময়।

শরৎকালে আকাশটা হয় দেখার মত। অন্য ঋতুতে আকাশের এমন সৌন্দর্য তেমন একটা চোখে পড়ে না।

আকাশের গায়ে নীল চাঁদোয়া। মাঝে মাঝে বকুলের মত থোকা থোকা মেঘ। কখনো পেঁজা তুলার মত হাওয়ায় উড়ে এদিক ওদিক। বৃষ্টিরা ঝাঁকবেধে নেমে আসে ধরণির বুকে। সোনালি রোদের তাড়া খেয়ে কখনো গুটিয়ে পালায়। ভেজা বর্ষায় ডুবে থাকা চরাচর জেগে উঠে নতুন প্রাণের আশায়। সবুজের মেলা বসে প্রকৃতির মাঝে। ধানের কচি পাতা। ঘাস ফড়িংয়ের ছোটাছুটি।

ক্ষেতের কোনে অশ্বথের ছায়া। রাখালের বাঁশির সুর। মেঘহীন আাকাশে অগণিত তারার হাট। রূপালি জোছনায় বিধৌত হয় সমতট। বাসরের নিস্তব্দতা ভাঙ্গে শিয়ালের হুক্কা হুয়া ডাক। ঝিঁঝিঁপোকার গান আর জোনাকির নাচে পরিবেশ পায় স্বর্গিয় আবেশ। কাঁঠাল পাতার ফাঁকে হুতোম পেচার গোল গোল চোখ পাহারায় থাকে রাতভর। কার সাধ্য ভাঙ্গে এ অপার্থিব নাচের মঞ্চ। শেষরাতে নামে আগমনী শীতের নকীব-শিশির। দূর্বা ঘাসের মাথায় মুক্ত সদানা। সুর্যের কাচা হলুদ আলোয় ঝিলিক দিয়ে উঠে সে মুক্ত। ভোরের আলো গায়ে মেখে লাঙ্গল জোয়াল কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে কৃষক। এই তো শরৎ।

নদীর দু'ধারে কাশবন। মৃদু মন্দ বাতাসে উঠে শুভ্রতার ঢেউ। নদীর পাড় ধরে নৌকা বায় মাঝি। মুখে ভাটিয়ালি সুর। কিশোরির মনে উঠে উচাটন। লেস ফিতা বাঁধা বেনি দুলিয়ে ছুটে চলে বনের গভীরে। দু'হাত প্রসারিত করে চোখ মুদে আকাশে তাকায়। শুভ্রতার এ রাজ্যে সেই তো একমাত্র রাণী। শরৎ ছাড়া এমন দৃশ্যপট আর কোথায় পাবে তুমি?

সূর্য ডুবে যায়। আঁধারে ছেয়ে যায় চারদিক। বাতাসের গায়ে ভর করে যে ফুল আলো ছড়ায়। মাতাল করা ঘ্রাণে বিমুগ্ধ হয় চারপাশ। কি ফুল সেটা? হাসনাহেনা। এ তো শরতের ফুল।

দুধ সাদা বদনে আলতার প্রলেপ মাখা শিউলি- সে তো শরতেরই বোন । হিমঝুরি , ছাতিম, মালতি, জয়ী, কামিনী, টগর, দোলনচাঁপা শুধু শরতেই শোভা পায়। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম শরতের এমন মোহনীয় রূপে মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন:

এসো শরৎ প্রাতের পথিক এসো
শিউলি বিছানো পথে
এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে এসো
অরুণ -কিরণ রথে।

দলি শাপলা শালুক শতদল এসো
রাঙ্গায়ে তোমার পদতল
নীল লাল ঝরায়ে ঢল ঢল এসো
অরণ্য পার্বতে।

গ্রীষ্মে পাকা ফলের মিষ্টি মধুর ঘ্রাণ। বর্ষায় টিনের চালে ঝুম ঝুম বৃষ্টি। শরতের কাশবন। হেমন্তে ফোটে কৃষকের মুখে হাসি। ঘরে ঘরে উঠে সোনালী ফসল। শীতের সকালে ঝরে শিশির। দূর্বা ঘাসে একে যাই আমার শৈশবের পদছাপ। বসন্তে কোকিলের গানে নেচে ওঠে প্রাণ। হাজারো ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না একলা জেগে রই। প্রকৃতির রূপের এ পরিবর্তন। রংয়ের এ বৈচিত্র। সে তো শুধু অপরূপ এ বাংলার বৈশিষ্ট্য। সৃষ্টিকর্তার ভালোবাসার দান। কুদরতের আজব কারিশমা। তাইতো প্রত্যহ প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে বাজে শুকরিয়ার সুর।

শরতের কথা উঠলেই রবি ঠাকুরের কবিতাটি বারবার মনে পড়ে।

শরৎ বাণীর বীণা বাজে
কমল দলে
ললিত বাঘের সুর ঝরে তাই
শিউলি তলে।

সুখী সুখী শরতের এ মায়াময় পৃথিবীতে তোমায় স্বাগতম।

-এএ


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ