শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১১ শাওয়াল ১৪৪৫


চিকিৎসা বিজ্ঞানের সোনালী অতীত

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আলী আকবর: চিকিৎসা বিজ্ঞানে মুসলমানদের যে অবদান রয়েছে, তা আধুনিক বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় এক সোনালী অনুচ্ছেদ। এটাকে অবজ্ঞা করা মানেই সভ্যতার ইতিহাসকে অস্বীকার করা।

মানব সভ্যতার যে জয়যাত্রা আমরা আজ দেখতে পাচ্ছি, তা রাতারাতি সম্ভব হয়নি। এর নেপথ্যে আছে হাজারো মানুষের ঘাম ও শ্রম। আর সেই মানুষগুলো ছিল ইসলামি সালতানাতের দক্ষ জনশক্তি। তাদের অধ্যবশায় আর অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে পৃথিবীর এই আধুনিকায়ন।

মুসলিমরা তাদের খিলাফাত হারানোর পর পাল্টাতে থাকে ইতিহাস। রসায়ন বিজ্ঞানী আল হাসানের নাম হয়ে যায় হ্যাজন এতে বুঝার উপায় থাকে না তিনি আরবীয় নাকি ইউরোপীয়, মুসলিম নাকি অমুসলিম? এতো গেল নাম বিকৃতির কথা।

পশ্চিমারা বিজ্ঞানের অনেক আবিষ্কারকে তারা নিজেদের নামে চালিয়ে দিতেও দ্বিধাবোধ করেনি। এমন শত সহস্র ইতিহাস ছিনতাইয়ের কথা আমরা সবাই জানি। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় 'আধুনিক' শব্দ যোগ করে তারা এর 'জনকের' নামটাও নিজেদের করে নিয়েছে।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিকাশ

বিশেষত চিকিৎসাশাস্ত্রে মুসলমানেরা যখন গবেষণা শুরু করেছে তখন ইউরোপীরা গবেষণাগারের কোন ধারনাই পায়নি। ইউরোপে আজকের দিনে যে বিশ্ববিদ্যালয়, ল্যাব-রিসার্চ সেন্টার গড়ে উঠেছে তার মুলে রয়েছে মুসলিম সভ্যতার অন্যতম নিদর্শন 'কর্ডোভা'। এই কর্ডোভা নগরী আজও সেই সাক্ষ্য দেয়। আর বাগদাদের মত জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ নগরী তৎকালীন ইউরোপ ও আফ্রিকায় আরেকটি খুঁজে পাওয়া যায় না।

বার শতকের মাঝামাঝি সময়ে মোঙ্গল দস্যুদের দ্বারা বাগদাদ নগরী ধ্বংশের মধ্যদিয়ে আরবে এবং ত্রয়োদশ শতকে কর্ডোভা নগরী মুসলমানদের হাত ছাড়া হলে ইউরোপে মুসলমানদের সোনালী দিনের সূর্য অস্ত যায়। বদলাতে থাকে ইতিহাস আর তাতে যোগ হয় নতুন নতুন অধ্যায়।

তাদের শত অপচেষ্টার পরেও আজো পৃথিবী মনে রেখেছে আল রাজী, ইবনে সীনা, ইবনে যহর, আল নাফিস, ইবনুল হাইসামকে। এদের মত চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা সেইদিনগুলোতে তৈরী করেছিলেন চোখের লেন্স, শৈল্যবিদ্যা, থার্মোমিটার, দুইশো সার্জারী যন্ত্রপাতি। তারা অপারেশনের সময় পশুর নাড়ি ব্যবহার করার মত যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আজ থেকে হাজার বছর আগে ।

প্রথম হাসপাতাল

রাসূল সাঃ তার জীবদ্দশায় বিশেষত যুদ্ধকালীন সময়ে যে ভ্রাম্যমান চিকিৎসাকেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন সে ধারণাকে কাজে লাগিয়ে পরবর্তীতে মুসলিম শাসকগণ স্থায়ী চিকিৎসাকেন্দ্র তথা হাসপাতাল গড়ে তোলেন। খলিফা ওয়ালিদ ইবনে মালিকের শাসনামলে প্রথম স্থায়ী হাসপাতাল তৈরী করা হয়। ধর্ম-বর্ণ ভেদে সবাই সেখানে চিকিৎসা পেত। রোগ ভেদে ছিল আলাদা ওয়ার্ড ব্যবস্থা। হাসপাতালের তৎকালীন ওয়ার্ড ইনচার্জকে বলা হতো সাউদ।

চিকিৎসা বিজ্ঞানে তৎকালীন মুসলমানদের দখল ও অংশগ্রহণ এমন পর্যায় পৌঁছেছিল যে, ৯৩১ সালে খলিফা মুত্তাদির বিল্লাহর শাসনামলে বাগদাদ শহরে ভুলে একজন রোগী মারা যাওয়ায় নগরীর প্রধান চিকিৎসক সিনান ইবনে সাবিতের তত্ত্বাবধায়নে সকল চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেয়া ও পরীক্ষা নেয়া হয়। এতে শুধুমাত্র বাগদাদ শহর থেকেই ৮৬০ জন চিকিৎসক অংশগ্রহণ করেছিল।

তৎকালীন পৃথিবীর হাসপাতাল

মুসলিম সালতানাতে প্রতিষ্ঠিত তৎকালীন হাসপাতালের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, সিরিয়ার দামেস্ক শহরের আল-নূরী হাসপাতাল, জেরুজালেমের আল সালহানি,বাগদাদের আল -সাইয়িদাহ, আল মুক্তির আদুদি হাসপাতা,কায়রোর আল মানসুরি হাসপাতাল।

আফ্রিকার মরক্কো ও তিউনিসে আল- মার ওয়ান, মারাবেশ হাসপাতাল ইত্যাদি। আন্দালুসিয়া বা স্পেনের কর্ডোভা, গ্রানাডায় গড়ে উঠে হাসপাতাল ও হাম্মামখানা। শরীর সুস্থতার জন্য গোসলের প্রয়োজনকে সামনে রেখেই সরকারিভাবে এই হাম্মামখানা তৈরি করা হয়। আশ্চর্যের বিষয় ইউরোপীয়রা তখনও গোসলের প্রয়োজনীতা সম্পর্কে জানতো না।

এই হাসপাতালগুলোর মাধ্যমে আরবে,ইউরোপ আর আফ্রিকায় মানব সভ্যতার ইতিহাসে নবযুগের সূচনা হয়। গ্রানাডা শহরের ধ্বংসাবশেষ আজও মুসলমানদের সেই সোনালী দিনের কথা আমাদের মনে করিয়ে দেয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের দুটি প্রধান শাখা মেডিসিন ও সার্জারী। নিম্নে এই দু'টির উল্লেখযোগ্য মুসলিম আবিষ্কার হলোঃ-

মেডিসিন

আল রাজী মেডিসিন শাস্ত্রে বিশেষ অবদানের জন্য চিরস্মরণীয়। স্মল পক্স (small pox) এবং মিসল ( Measles) এর পার্থক্য নিরূপন করে তিনি প্রমাণ করেন এই দুটি নয়। বানরের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে তিনি পারদকে রেচক( purgative) হিসাবে ব্যবহার করেন। মুসলিম বিজ্ঞানীরা গাছের নির্যাস থেকে ঔষধ তৈরির জন্য পাতন(Distillation) ক্রিশ্টাল Crystalization) এবংSublimation ইত্যাদি পদ্ধতি ব্যবহার করতেন যা আজও রসায়ন ও ফার্মাসীবিদ্যায় ব্যবহৃত হচ্ছে। ফার্মাসীবিদ্যার অনেক মৌলিক শব্দই এসেছে আরবী ভাষা থেকে যেমন, Dru, Alkali,Alcohol, Alembic, Syrup ইত্যাদি।

সার্জারী

চোখের ছানি অপারেশন করার মধ্য দিয়ে চক্ষু চিকিৎসায় এক যুগান্তকারী ইতিহাসের জন্ম দেন মুসলিম বিজ্ঞানীরা। কারণ সে সময়ে মানুষ ছানি পড়াকে অন্ধত্ব বলেই মনে করত। অস্ত্রপাচারের সময় চেতনা নাশকের ব্যবহার করেন ইবনে সিনা।

আল জাহরাভি সার্জারী বিদ্যায় আল তাসরিফ নামে একটি বই লেখেন। যাতে সার্জারীতে ব্যবহৃত দুইশো যন্ত্রপাতির সচিত্র বর্ণনা ছিল।

এতে পদার্থবিজ্ঞানী ইবনুল হাইমাসের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। বর্তমানের Lens শব্দটি হাইমাসের ব্যবহৃত আরবী শব্দ "অদাসা' নেয়া হয়েছে। দাসা শব্দের অর্থ মুসুরীর ডাল। চোখের লেন্স দেখতে অনেকটা মুসুরীর ডালের মত। ল্যাটিন অনুবাদকারীরা ' দাসা ' কে lenticutum নামকরণ করেন যা আজ Lens নামে পরিচিত।

কয়েকজন চিকিৎসা বিজ্ঞানী

মুসলিম বিজ্ঞানীদের মধ্য আমরা সবচেয়ে বেশি যার সাথে পরিচিত তিনি ইবনে সিনা।অনেকেই তাকে চিকিৎসা শাস্ত্রের জনক বলে থাকে। ইবনে সিনা আজ থেকে হাজার বছর আগে ক্যান্সারের শল্যচিকিসায় যে ধারণা দিয়েছিলেন তার প্রয়োগ আজও চলছে।

তিনি সর্বপ্রথম চেতনা নাশকের ধারণা দেন এবং আফিম ব্যবহার করেন। এছাড়া যক্ষ্মা রোগের কারণ নিরুপণ ও ক্ষতস্থানের ড্রেসিংয়ে তিনি মদ ব্যবহারের সুপারিশ করেন।

আল রাজী অনুজীববিদ্যা ব্যবহার করে সঠিক স্থানেহাসপাতাল নির্মাণের সুপারিশ করতেন।অ্যালকোহলকে এন্টিসেপটিক হিসাবে ধারণা রাজীর দেয়া। পদার্থবিজ্ঞানী ইবনুল হাইমাস চশমা আবিষ্কার করেন।

আল-নাফিস সর্বপ্রথম হৃদপিন্ডে রক্ত চলাচলের বর্ণনা দেন।

পশ্চাতে বুকাসিস নামে পরিচিত আল জাহরাভি সার্জারী বিদ্যায় আল তাসরিফ নামে একটি বই লেখেন। যাতে সার্জারীতে ব্যবহৃত দুইশো যন্ত্রপাতির সচিত্র বর্ণনা ছিল। এই যন্ত্রপাতির সবগুলোই তিনি তৈরী করেছিলেন। তিনিই প্রথম কিডনি কেটে মুত্রথলির পাথর বের করেন। হাড়ভাঙা, ক্ষতস্থানের রক্ত বন্ধে ও দাঁতের চিকিৎসায় তিনি প্রথম তুলা ব্যবহার করেন।

এই সব মুসলিম বিজ্ঞানীগণ পার্থিব জীবনে বিশেষ কোন খ্যাতির জন্য নয় বরং মানুষের সেবাতে যে আল্লাহর সন্তুষ্টি তাতে তারা জীবনটা চিকিৎসা শান্ত্রে ব্যয় করে গেছেন।

লেখক: শিক্ষার্থী, সরকারী রাজেন্দ্র কলেজ,ফরিদপুর।


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ