শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১০ শাওয়াল ১৪৪৫


আলেমরা কেন জননেতা হতে পারেন না?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

পলাশ রহমান ।। ইতালি থেকে


আমাদের সমাজের আলেম-ওলামাদের সাধারণ মানুষ শ্রদ্ধা করে, ভক্তি করে। ধর্ম জানা মানুষ হিসাবে সবাই তাদের সালাম আদাব করে। কিন্তু রাজনীতিতে নেতা হিসাবে মানতে চায় না। নির্বাচনে ভোট দিতে চায় না। এর অন্যতম কারণ হতে পারে সাধারণ মানুষ আলেম সমাজকে সাধক মানুষ, আধ্যাতিক মানুষ ভাবতেই বেশি পছন্দ করে।

তাছাড়া মাদরাসাভিত্তিক শিক্ষা বিস্তারের বাইরে সমাজ কল্যাণমূলক কাজের সাথে আলেম সমাজকে খুব একটা দেখা যায় না। যে আলেমরা রাজনীতি করেন তারাও সারাবছর ইস্যুভিত্তিক কিছু আন্দোলন সংগ্রাম নিয়ে ব্যাস্ত থাকেন। সাধারণ মানুষ তাদের নিত্য সমস্যায় আলেমদের কাছে পায় না। সুতরাং রাজনৈতিক নেতা হিসাবে গণমানুষ তাদের উপর আস্থা আনতে পারে না।

আমি মনে করি, রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে, গণমানুষের নেতৃত্বে আসতে হলে দেশের আলেম সমাজকে সমাজ কল্যাণে মনোযোগী হতে হবে। দেশের মানুষের নিত্য সমস্যা অনুসন্ধান করতে হবে এবং তা সমাধানের জন্য আন্তরিক ভাবে এগিয়ে আসতে হবে। সমাজের জন্য যা কিছু কল্যাণকর তা’ই সমাজ কল্যাণের আওতাধীন। অর্থাৎ মানব সমাজের লিভিং স্ট্যান্ডার্ড বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা, প্ল্যানিং করা বা স্কিম হাতে নেয়া এবং তা কার্যকর করা।

ইনসাফ ভিত্তিক আদর্শ সমাজ বিনির্মানের জন্য চেষ্টা করা। উদ্যোগ গ্রহণ করা। যেমন সামাজিক নিরাপত্তা, দারিদ্র নিরসন, মানব সম্পাদ উন্নয়ন, শিশু সুরক্ষা, প্রতিবন্ধি সুরক্ষা, ভুল কূসংস্কার থেকে মানুষকে বের করে আলোর পথ দেখানো ইত্যাদী।

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন দুনিয়াতে মানুষ প্রেরণ করেছেন সুনির্দিষ্ট কিছু দায়িত্ব দিয়ে। মানুষ ভিন্নতায় প্রতিভাও দিয়েছেন ভিন্ন ভিন্ন। সেগুলোর সঠিক ব্যবহার এবং সমাজের জন্য কল্যানকর কাজ করাই মূলত সমাজ কল্যাণ। সমাজ কল্যানের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সমাজের অবহেলিত, অক্ষম, সুবিধা বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। সামাজিক মর্যাদার সাথে তাদের বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। নিয়মিত তাদের খোঁজ খবর রাখতে হবে। যেমন: বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধি ভাতা, হিজড়া জনগোষ্ঠি, উপজাতী, বেদে, চা শ্রমিক, মৎস শ্রমিক, গার্মেন্ট শ্রমিকসহ নিম্নআয়ের মানুষদের পাশে দাঁড়ানো। তাদের সুবিধা অসুবিধার খোঁজ খবর রাখা। তাদের জীবন মান উন্নয়নের চেষ্ট কারা। অধিকার আদায়ের জন্য তাদের পাশে থাকা এবং তাদের মধ্যে নৈতিক শিক্ষার বিস্তার ঘটানো।

ক্যান্সার, কিডনি, লিভারসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো। তাদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা। বিশেষ করে যারা আর্থিকভাবে অসহায় বিনামূল্যে তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। সরকারী অনুদান এবং সুযোগ সুবিধা আদায়ের জন্য চাপ প্রয়োগ করা।

অটিজম বা প্রতিবন্ধিদের পাশে দাঁড়ানো। তাদেরকে সমাজ থেকে আলাদা করে না দেয়া। তাদের মেধা অনুযায়ী কাজের ব্যবস্থা করা। সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি সর্বস্তরে তাদের উপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা। মাদরাসা, স্কুল, কলেজেসহ সমাজের সকল পর্যায়ে বাক প্রতিবন্ধি, শ্রবণ প্রতিবন্ধি, দৃষ্টি প্রতিবন্ধি, বুদ্ধি প্রতিবন্ধি, অঙ্গ প্রতিবন্ধিদের উপযোগী শিক্ষা চালু করা। দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ দেয়া। তাদের জন্য নির্ধারিত কোটা এবং সংরক্ষিত স্থানের ব্যবস্থা করা ইত্যাদী। বিশেষ করে তাদের মধ্যে ধর্মীয় শিক্ষার প্রসার ঘটানোর জন্য সকল মাদরাসায় এবং মসজিদভিত্তিক মক্তবে তাদের উপযোগী শিক্ষা চালু করা ও দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ দেয়া। এসব কাজে সহযোগিতা করা।

সমাজের অবহেলিত, কম সুবিধায় থাকা মানুষগুলোকে ধর্মীয় এবং সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার চেষ্টা করা। অসহায় এতিম শিশুদের পাশে দাঁড়ানো, ভবঘুরে, বাস্তুহারাদের আশ্রয়স্থল নিশ্চিৎ করা এবং তাদের কর্মদক্ষ করে গড়ে তোলা। তাদের অধিকার সচেতন করে গড়ে তোলা। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা এবং সেবা দিয়ে সমাজের স্বাভাবিক স্তরে তাদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা। বিশেষ করে শিশু অপরাধী এবং মাদকসেবীদের কাউন্সিলিং করানো এবং তাদের মধ্যে ধর্ম চর্চার অভ্যাস গড়ে তুলতে সাহায্য করা।

সমাজের দারিদ্রতা নিরসনের জন্য দক্ষ জনশক্তি তৈরী করার কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে সমাজের পিছিয়ে পড়া নারী পুরুদের পাশে দাঁড়ানো। বিধবা, বৃদ্ধা, এসিড দগ্ধ, অঙ্গ হারানো নারী, পুরুষ, বৃদ্ধদের আর্থিক এবং সামাজিকভাবে মর্যাদার সাথে বসবাসের ব্যবস্থা করা। সুস্থ এবং স্বাভাবিক জীবন যাপনের জন্য ভুল, কূসংস্কার থেকে ফিরিয়ে ধর্মীয় এবং বিজ্ঞানভিত্তিক বিষয়গুলো তাদের জানানোর ব্যবস্থা করা।

বিশেষকরে গ্রামের মানুষদের মধ্যে ধর্ম এবং বিজ্ঞানের মিশেলে সহজ সরল এমন শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করা যা তাদের জীবন যাপনের মান আরো উন্নত করে তোলে। কর্ম দক্ষতার জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং নারীদের উন্নয়নের জন্য নারী কর্মী, প্রশিক্ষক তৈরী করা। যারা শরীয়তের বিধান মেনে নারীদের ঘরে ঘরে গিয়ে ধর্ম এবং বিজ্ঞানের ভিত্তিতে সহজ জীবন যাপনের পথ দেখাবে। শারিরীক এবং মানষিকভাবে তাদের সচেতন করে তুলবে।

মানব সম্পদের উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব না হলে সমাজ কল্যাণ সম্ভব হবে না। সুতরাং শহরের বস্তিবাসী এবং ভিক্ষুক থেকে শুরু করে গ্রামের সাধারণ মানুষ পর্যন্ত সর্ব স্তরের মানুষকে কারিগরী শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। জীবন সম্পর্কে তাদের সচেতন করতে হবে।

যারা বিভিন্ন মাজার কেন্দ্রীক জীবন যাপন করে, মাথায় জটা বেধে নোংড়া, অস্বাস্থ্যকর নিম্নমানের জীবন যাপন করে, ভুল কুসংস্কারে ডুবে থাকে, তাদের সেখান থেকে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের মধ্যে ধর্মের সঠিক শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

যারা বিদেশে কাজের জন্য যেতে আগ্রহী তাদের জন্য বিভিন্ন দেশের কাজের চাহিদা মোতাবেক প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করা। ওই সব দেশের ভাষায় পারদর্শী করে গড়ে তুলার জন্য কোর্সের ব্যবস্থা করা। বিশেষ করে আরব বিশ্বের শ্রম বাজার নিজেদের দখলে রাখার জন্য মাদরাসার শিক্ষার্থীদের বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। সঠিক উপায়ে প্রশিক্ষণ এবং সহযোগিতা পেলে তারা সাধারণ শিক্ষিতদের থেকে অনেক বেশি এগিয়ে থাকতে পারবে। দেশের অর্থনীতিতে শক্ত ভুমিকা রাখতে পারবে।

সামাজিক অপরাধী, কিশোর অপরাধী, মাদকসেবী, প্রতিবন্ধি, ভবঘুরেদের যোগ্যতা অনুরাসারে কর্ম প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। বিনামূল্যে তাদের জন্যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

মানুষকে সুদ্ধাচার শিক্ষা দিতে হবে। সমাজে সহবস্থানের জন্য পারস্পারিক সুদ্ধাচার এবং শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করা খুব জরুরী। এর জন্য মানুষের মধ্যে সামাজিক, নৈতিক এবং ধর্মজ্ঞান থাকা খুব প্রয়োজনীয়। সুতরাং মানুষকে সুদ্ধাচার এবং শ্রদ্ধাবোধ শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। নৈতিকবোধ জাগ্রত করতে হবে। ‘কোনো অবস্থাতেই অন্যের ক্ষতি সাধন করা যাবে না’ এমন মানসিকতা তৈরী করতে সহায়তা করতে হবে।

সমাজের অসহায় নির্যাতিত মানুষরা দ্রুত এবং হয়রানি মুক্ত বিচার পাওয়ার জন্য পঞ্চায়েত নেতাদের কাছে ছুটে যায়, কিন্তু তারা সঠিক বিচার পায় না। তাদের সাথে ইনসাফ করা হয় না। সুতরাং এই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াতে হবে। তাদেরকে ইনসাফ এবং অধিকার সচেতন করে তুলতে হবে।

সর্বপরি সমাজ কল্যানের জন্য অর্থিক তহবিল থাকা চাই। এর জন্য সামাজের ধনী ব্যক্তিদের বোঝাতে হবে প্রত্যেকেরই একটা সামাজিক দায়িত্ববোধ আছে, কমিটমেন্ট আছে। ধনীদের সম্পদে গরীবের, অসহায়, অক্ষম মানুষের অধিকার আছে। সমাজের ধনী মানুষদের অর্থিক অনুদান এবং ছদকা সংগ্রহ করে সমাজ কল্যাণ ফান্ড গঠন করতে হবে।

এছাড়া প্রত্যেক আদর্শ রাষ্ট্রে সরকারী সমাজ কল্যাণ দপ্তর থাকে। সেখান থেকে সমাজের কল্যাণ খাতে আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়। এগুলো যেনো সঠিকভাবে মানুষের কাছে পৌঁছায়, দূর্নীতিবাজ অসৎ মানুষরা যেনো এই অর্থ আত্মসাৎ করতে না পারে সে দিকে নজর রাখতে হবে।

সামাজিক এবং রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করতে হবে। অসহায়, সুবিধা বঞ্চিত মানুষদের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাদের নিত্য প্রয়োজের খোঁজ খবর রাখতে হবে। তাদের অধিকার সচেতন করে গড়ে তুলতে হবে। অধিকার আদায়ের জন্য তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাদের মনের মধ্যে বিশ্বাস জন্ম দিতে হবে যে ধর্মীয় আদর্শের কল্যাণ রাষ্ট্র কায়েম করতে পারলে অধিকারের জন্য লড়াই করতে হবে না। রাষ্ট্রই তাদের অধিকার নিশ্চিত করবে। সুতরাং নৈতিক আদর্শের কল্যাণ রাষ্ট্র কায়েমের জন্য চেষ্টা করতে হবে। নির্বাচন এলে ভোট দিতে হবে।

এর জন্য প্রত্যেক জেলা, থানা, ইউনিয়ন পর্যায়ে তালিকা তৈরী করতে হবে। তাদের সুবিধা অসুবিধা কাছ থেকে উপলব্ধি করতে হবে এবং তাদের অধিকার আদায়ের জন্য সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে। আলাদা আলাদা টিম বা সেল গঠন করে সাংগঠনিক ভাবেও তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে এবং নৈতিক আদর্শের ইনসাফভিত্তিক বা কল্যাণ রাষ্ট্র কায়েমের জন্য চেষ্টা করতে হবে।

আরএম/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ