বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১২ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫


ডাকসুর ইসলামফোবিয়া!

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

জহির উদ্দিন বাবর
সাংবাদিক

প্রায় ২৮ বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন হয় গত মার্চে। নির্বাচনটা কোন স্টাইলে হয়েছে সেটা সবাই দেখেছে, নতুন করে বলার আর কিছু নেই। প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে হলেও শিক্ষার্থীদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক ডাকসু সচল হয়েছে, এটাই বড় পাওনা। সেই ডাকসু দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা নানা সমস্যার সমাধান করবে সেটাই ছিল প্রত্যাশিত। কিন্তু সেটা না করে গত বৃহস্পতিবার (২৬ সেপ্টেম্বর) কার্যনির্বাহী সভায় এক হঠকারী সিদ্ধান্ত নিলো। ঢাবি ক্যাম্পাসে সব ধর্মভিত্তিক (সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী) ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা দিলো।

সভা শেষে ডাকসুর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ‘ডাকসুর নির্বাহী সভার আলোচ্যসূচি অনুযায়ী সাহিত্য সম্পাদক মাজহারুল কবির শয়নের প্রস্তাবের ভিত্তিতে ডাকসু সর্বসম্মতিক্রমে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মভিত্তিক ও সকল প্রকার সাম্প্রদায়িক ছাত্র রাজনীতি ডাকসু নিষিদ্ধ করছে।

এ মর্মে ডাকসুর গঠনতন্ত্রে সুনির্দিষ্ট ধারা যুক্ত করার আহ্বান জানাচ্ছে। একইসাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট-সিন্ডিকেটসহ অন্যান্য কমিটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মভিত্তিক এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ সম্পর্কিত নির্দেশনা প্রণয়নের আহ্বান জানাচ্ছে।’ ডাকসুর এজিএস ও ছাত্রলীগ নেতা সাদ্দাম হোসেন গণমাধ্যমের কাছে এভাবেই বিষয়টি তুলে ধরেন।

ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নুর। তবে এক পর্যায়ে ছাত্রলীগ নেতাদের ব্যক্তিগত আক্রমণের মুখে তিনি সভা থেকে বেরিয়ে আসেন। আর সেদিন বৈঠকে উপস্থিতই হননি ছাত্রলীগের পদ হারানো নেতা জিএস গোলাম রাব্বানী।

ডাকসুর প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে হঠকারী এই সিদ্ধান্তকে সর্বসম্মতিক্রমে বলা হলেও গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এর সঙ্গে দ্বিমত করেছেন ভিপি নুর।

শুক্রবার ডাকসুর পেডে নিজের স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে নুর বলেন, ‘গত ২৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) মিটিংয়ে ডাকসুর এজিএস ও ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন, সাহিত্য সম্পাদক মাজহারুল কবির শয়ন ও সদস্য রাকিবুল ইসলাম ঢাবিতে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের প্রস্তাব তুলেছিলেন। বাংলাদেশের সংবিধান মোতাবেক প্রচলিত আইন ও নিয়ম-কানুন মেনে যেসব রাজনৈতিক দল তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে, কিংবা যেসব ধর্মভিত্তিক দল নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন নিয়ে রাজনীতি করছে, ঢাবিতে তাদের ছাত্র সংগঠনের রাজনীতি নিষিদ্ধকরণে ডাকসু বা ঢাবি কর্তৃপক্ষের কোনো এখতিয়ার নেই। সুতরাং এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত আমরা ডাকসু থেকে নিতে পারি না।’

প্রথম কথা হলো, ডাকসুর এজিএস এটাকে ‘সর্বসম্মতিক্রমে’ দাবি করলেও আসলে সেটা যে সর্বসম্মতিক্রমে না সেটা প্রমাণিত। কারণ ডাকসুর কার্যকরী প্রধান ভিপি। তিনি সরাসরি এই সিদ্ধান্তে বিরোধিতা করছেন। আর জিএস উপস্থিতই ছিলেন না। সুতরাং এটাকে ‘সর্বস্মত’ কোনো মত না, ছাত্রলীগের দলীয় মত বলা যেতে পারে।

দ্বিতীয়ত, ডাকসু এই সিদ্ধান্ত নিতে পারে কি না সেটা নিয়ে দেখা দিয়েছে প্রশ্ন। সংবিধান যাদেরকে রাজনীতি করার অধিকার দিয়েছে তাদেরকে আইন করে রাজনীতি থেকে বাইরে রাখার অধিকার কি ডাকসুর আদৌ আছে! হয়ত ক্ষমতার জোরে ডাকসুর ওপর সওয়ার হয়ে ক্যাম্পাসে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে দমিয়ে রাখতে পারবে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনটি। কিন্তু আইন ও নীতি-নৈতিকতার প্রশ্নে তাদের এই অপচেষ্টা হঠকারিতা ছাড়া আর কিছু নয়।

ধর্মভিত্তিক ছাত্র সংগঠন বলতে বোঝানো হচ্ছে, ইসলামি দলগুলোর ছাত্র সংগঠনকে। ঢাবি ক্যাম্পাসে ইসলামি ধারার যেসব সংগঠন সক্রিয় রয়েছে তাদের অভিভাবক সংগঠন প্রায় সবগুলোর নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন রয়েছে। প্রচলিত আইন মেনে তারা রাজনীতি করছেন। সারাদেশে কোথাও তাদের রাজনীতি করতে বাধা নেই অথচ তথাকথিত প্রাচ্যের অক্সফোর্ডে তারা নিষিদ্ধ এটা তো মেনে নেয়ার বিষয় নয়। স্বাভাবিকভাবে কথিত এই ডাকসুর সিদ্ধান্তের ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে তথাকথিত মুক্তচিন্তার উন্মুক্ত প্রান্তর হিসেবে গণ্য করা হয়। এই দোহাই দিয়ে এখান থেকে অতীতে অনেক জাতিবিধ্বংসী চিন্তার স্ফুরণও আমরা লক্ষ্য করেছি। যারা এতো মুক্তচিন্তার চর্চা করেন তারা কীভাবে এতো সঙ্কীর্ণ মানসিকতা লালন করতে পারেন!

আপনারা ক্যাম্পাসে রাজনীতি করবেন, শিক্ষার্থীদের নানা আদর্শের কথা বলে টানার চেষ্টা করবেন, তাহলে অন্যরা কেন পারবে না! বিচারের ভার সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ছেড়ে দেন, তারা কার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে কোন দিকে ঝুঁকবে সেটা তাদের ব্যাপার। আপনারা তাতে বাধা দেয়ার কে! ইসলাম তো এখনও কাগজেপত্রে দেশের রাষ্ট্রধর্ম, সংবিধানে এটা বহাল রেখেই ঢাবি থেকে কেন ঝেঁটিয়ে বিদায়ের অপচেষ্টা!

দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ ইসলামকে বৈরী হিসেবে দেখা হয়। এখানকার তথাকথিত মুক্তমনাদের মধ্যে সবসময় ‘ইসলামফোবিয়া’ কাজ করে। অথচ এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পেছনে যাদের মূল ভূমিকা সেই নবাব খাজা সলিমুল্লাহ, সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, আবুল কাশেম ফজলুল হক সবাই ছিলেন ইসলামবান্ধব।

পূর্ববঙ্গে এই প্রতিষ্ঠানটি গড়তে বহু সংগ্রাম-সাধনা করতে হয়েছে তাদের। তখন কি তারা ভেবেছিলেন তাদের হাতেগড়া প্রতিষ্ঠানটিতে ইসলাম একদিন এভাবে নিগৃহীত হবে! এটা ভাবলে হয়ত তারা ভিন্ন চিন্তা করতেন।

আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাদের ‘পূজা’ করা হয় সেই রবীন্দ্রনাথসহ অনেকেই সেদিন তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেন প্রতিষ্ঠিত না হতে পারে, এই অঞ্চলের মুসলমানরা যেন শিক্ষা-দীক্ষায় এগিয়ে যেতে না পারে কলকাতার বাবুরা সেদিন এরজন্য কম প্রচেষ্টা চালাননি। অথচ আজ তারাই এখানে পূজনীয় আর বিতাড়িত ইসলাম ও মুসলমান!

কোনো সংগঠন দেশবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হলে কিংবা এ ধরনের কোনো তৎপরতা চালালে ঢাবি ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ হতেই পারে। কিন্তু টার্গেট করে আদর্শভিত্তিক ইসলামি ধারার সংগঠনগুলোকে সেখানে কাজ করতে না দেয়ার ফন্দি আঁটা খুবই দুঃখজনক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাল মার্কস, লেলিন আর ডারউইনদের মতবাদ চর্চা হতে পারলে মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মতবাদ চর্চা হতে বাধা কোথায়? কোন যুক্তিতে তাদের দমিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা! যারা প্রাচ্যের এই অক্সফোর্ডকে ‘ডাকাতদের গ্রামে’ পরিণত করেছে সেইসব সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো নিষিদ্ধ না করে ইসলামভিত্তিক সংগঠনগুলোর দিকে কুনজর কেন!

ডাকসুর কথিত এই সিদ্ধান্তে জনসাধারণের মত জানতে অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম’ তাদের ফেসবুক পেইজে একটি জরিপ চালিয়েছিল। সেখানে ১৪ ঘণ্টায় প্রায় ১৬০০ মানুষ ভোট দিয়েছে। সেখানে ডাকসুর এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মত দিয়েছে ৯৬ ভাগ লোক। আর ৪ ভাগ লোক পক্ষে মত দিয়েছে।

দৈনিক মানবজমিনও একই ধরনের জরিপ চালিয়েছিল। সেখানেও প্রায় একই ফলাফল এসেছে। এর দ্বারাই বোঝা যায়, তাদের এই সিদ্ধান্তটি কতটা হঠকারিতামূলক এবং গণবিরোধী। আমরা প্রত্যাশা করি তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক এবং হঠকারী এই সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসুক।

লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম।


সম্পর্কিত খবর