শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৪ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


লেখালেখি চর্চার সেইসব দিন

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

[সম্প্রতি বিশিষ্ট লেখক শরীফ মুহাম্মদের একটি দীর্ঘ আত্মজৈবনিক সাক্ষাৎকার নেন জহির উদ্দিন বাবর। সেই সাক্ষাৎকারটির অংশবিশেষ প্রকাশিত হয়েছে লেখা ও লেখকের কথা নিয়ে প্রকাশিত লেখকপত্রের তৃতীয় সংখ্যায়। আওয়ার ইসলামে পুরো সাক্ষাৎকারটি পর্যায়ক্রমে গদ্য আকারে প্রকাশিত হচ্ছে। আজ প্রকাশিত হলো তৃতীয় পর্ব]


আজও মনে পড়ে কিশোরমনে দাগ কাটা উস্তাদদের অবদানের কথা। মূলত আমার জীবনে সব উস্তাদের ইহসানই গুরুত্বপূর্ণ। ইতোমধ্যে কারি সোহরাব সাহেব, মাওলানা রহমতুল্লাহ সাহেব, মাওলানা কারি বেলায়েত সাহেবের কথা উল্লেখ করেছি। তাদের অবদান অনেক।

কামরাঙ্গীচরে আসার পরে যিনি আমাদেরকে নেগরানি করতেন, যাঁর কাছে আমাদের একটা কিতাব পড়ার সুযোগ হয়েছে, তিনি মাওলানা আবদুল হক সাহেব। তাঁকে কামরাঙ্গীচরে ‘ময়মনসিংহের হুজুর’ বলা হতো। তিনি এখন ময়মনসিংহ বড় মসজিদের খতিব এবং হাফেজ্জি হুজুরের খলিফা। তাঁর নেগরানি বা তত্ত্বাবধানের যে স্মৃতি, এটা এখন বুঝি আমার উপরে বিশাল প্রভাব ফেলেছে।

আমার ভেতরে একটু চটপটে, প্রভাবিত হওয়া, দুষ্টুমি করা এজাতীয় স্বভাবগুলো ছিল। তাঁর কঠিন নেগরানির কারণে এই জায়গাগুলোতে আল্লাহ আমাকে হেফাজত করেছেন। আর উস্তাদ হিসেবে হজরত মাওলান আজীমুদ্দিন সাহেব-বাঁশবাড়িয়ার হুজুর; হজরত মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ সাহেব-আদীব হুজুর; হজরত মাওলানা মুহাম্মদ ইসমাঈল সাহেব বরিশালি হুজুর; হজরত মাওলানা বশির সাহেব; হজরত মাওলানা মাহবুবুর রহমান সাহেব; হজরত মাওলানা আবদুল হাই পাহাড়পুরি হুজুর রহ; হজরত মাওলানা সিদ্দিকুর রহমান সাহেব খুলনাবি রহ. বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছেন।

আর ফরিদাবাদ মাদরাসায় মাওলানা মতিউর রহমান সাহেব; মাওলানা বশীরুদ্দিন সাহেব একজন হুজুর ছিলেন; এখন সম্ভবত তিনি নরসিংদীর দত্তপাড়া মাদরাসার শায়খুল হাদিস, এসব মানুষের বড় প্রভাব ছিল। অপরদিকে লালবাগে শেষ দুই বছর যারা যারা হাদিস পড়িয়েছেন প্রত্যেকেরই অবদান ও প্রভাব ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

হজরত মাওলানা মুফতি ফজলুল হক আমিনী সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগটা তখনই গড়ে ওঠে। বিভিন্ন দরসের বিষয়গুলোকে নোট করে লেখা বানিয়ে পত্রিকায় ছাপিয়ে তাঁকে দেখাতাম। তখন ‘আজাদ’ পত্রিকা অফিসটা ছিল লালবাগের কাছে। এটা আমার একটা মজার ব্যাপার ছিল। কিতাবের কোনো একটা অধ্যায় শুরু হলে ভূমিকা হিসেবে আমিনী সাহেব যে আলোচনা করতেন; বা হজরত মাওলানা আবদুল হাই সাহেব, যিনি এখনও হায়াতে আছেন; তাদের আলোচনাটা আমি সাজিয়ে লেখা বানিয়ে দিয়ে দিতাম।

আজাদ পত্রিকায় শুক্রবারে একটা ইসলামি পাতা বের হতো। সেখানে লেখা ছাপা হয়ে যেত। সেগুলোর কিছু কিছু আমিনী সাহেবকে দেখানোর সুযোগ হয়েছে। হুজুর তখন থেকেই আমার প্রতি একটা স্নেহের দৃষ্টি দিতে থাকেন। এছাড়া অন্য উস্তাদদের মধ্যে খুব মনে পড়ে ঢাকুবি হুজুরের কথা, হজরত মাওলানা আবদুল মজিদ সাহেব রহ., খুব আদর করে করে পড়াতেন। মনে পড়ে চিটাগাং হুজুরের কথা, মাওলানা শামসুল আলম সাহেব রহ.। আরও অন্য আসাতিজায়ে কেরামের কথাও মনে পড়ে।

ছাত্রজীবনে শিল্প-সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ

শিল্প-সাহিত্যের প্রতি আমার অনুরাগটা ছাত্রজীবন থেকেই। এটা একদম প্রকৃতিগত বলব না, পরিবেশের অনেকটা প্রভাব আছে। ময়মনসিংহে যে এলাকায় আমাদের বাসা, গলগন্ডা কাঠগোলা বাজারের পাশে, সেখানে বইপত্র পড়ার একটা চক্রের মতো ছিল। সেবা প্রকাশনীসহ আরও কিছু প্রকাশনীর বই আট-আনা দিয়ে নেয়া যেতো। কারও কারও কাছে কয়েকশ বই ছিল। কেউ সম্পর্কে আমাদের মামা, কেউ খালাম্মা; আমি যখন কিশোর বা শিশু তাদের অনেকের কাছ থেকে বই এনে পড়েছি।

নওমহল নানার বাসায় গেলে মামা সালিম হাসানকে লেখালেখি করতে দেখতাম। এটার একটা প্রভাব পড়েছে। আরেকটা ব্যাপার হলো, যেকোনো একটা বই পড়লে পঠিত বইয়ের বিষয়বস্তু নিয়ে আমি আচ্ছন্ন হয়ে পড়তাম। গল্পের মধ্যে ঢুকে পড়তাম। ছোটকালে আমার ভেতরে একটা কল্পনাপ্রবণতা কাজ করতো। এটা হয়তো সব শিশুর মাঝেই কাজ করে, কমবেশি।

আমার মনে আছে, যিনি আমাকে বাসায় ক্লাসের বাংলা বই পড়াতেন, এমন অনেক হয়েছে বই পড়ার মাঝখানে বইয়ের পাতায় হাতের যে স্কেচ করা থাকত হাশেম খানের, ওই স্কেচের মধ্যে আমার চোখ আটকে থাকত। আমি বলতাম, গ্রামটা এরকম কেন, শহরটা এরকম কেন, সিন্দাবাদের জাহাজের বর্ণনা, ওই বর্ণনায় স্কেচটার দিকে আমার চোখ আটকে থাকত। শিল্প বা সাহিত্য যেটাই আমি পড়তাম ছোটকালে আচ্ছন্ন হয়ে থাকতাম লম্বা একটা সময়।

এরপর যখন কাউকে কাউকে দেখতাম লিখতে, অমুকের লেখা প্রকাশ হয়েছে আর সেই লোকটা আমার পরিচিত, তখন আমার মনে হতো এই লেখার ব্যাপারটা তো জাদুময় একটা ব্যাপার, প্রভাবক একটা ব্যাপার, এটা মানুষের চিত্তে দোলা দেয়ার মতো একটা বিষয়, আবার এটা তো দেখা যায় সম্ভব। মানুষ তো পারে, তাহলে তো আমারও পারতে হবে। আমারও একটু একটু শিখতে হবে।

কামরাঙ্গীচর মাদরাসায় ভর্তি হই ১১/১২ বছর বয়সে। এর এক-দুই বছরের মধ্যে আমার এলাকা এবং কামরাঙ্গীচর মাদরাসার পরিবেশ এবং পরিবারে মামার যে ছায়া- এসব পরিবেশ থেকেই আমি কিছুটা লেখালেখি নিয়ে চেষ্টা করার ক্ষেত্রে প্রভাবিত হয়েছি।

আমাদের ছাত্রজীবনে মাদরাসার পরিবেশে লেখালেখি চর্চার সুযোগ খুব বেশি ছিল না। সেই আশির দশকের তিরাশি, চুরাশি, পঁচাশি সালের কথা। তখন নূরিয়া মাদরাসায় একটু ইতিবাচক একটা পরিবেশ ছিল। কারণ সেখানে তখন দেয়াল পত্রিকা ছিল।

কিন্তু সামগ্রিকভাবে সারা বাংলাদেশে, আমরা যেটা দূর থেকে শুনেছি এবং ওইসময় কানেও আসতো; ঢাকার কয়েকটা মাদরাসায় লেখালেখির একটা পরিবেশ ছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল মালিবাগ। ফরিদাবাদে যখন আমি ছিলাম তখন সেখানে লেখালেখির পরিবেশ ব্যাপক ছিল না, কিছু কিছু ছিল। উস্তাদরা কোনো কোনো জায়গায় উৎসাহিত করতেন। ব্যাপক পরিসরে ছিল এটা বলব না, আবার অনেক জায়গায় হয়তো বাধাও ছিল। বাধা দেয়ার এই জিনিসগুলো আমি দেখিনি। দূর থেকে শুনতাম।

মাদরাসায়ে নূরিয়ার আসাতিজায়ে কেরাম বিষয়টাকে যেভাবে ‘আহলান-সাহলান’ করতেন তা অন্য মাদরাসায় করা হতো না। অনেক মাদরাসায় দেখেছি এটা একটু ভ্রুকুটির সঙ্গে দেখা, একটু বাঁকা চোখে দেখা; একটা ছেলে যদি মূল লেখাপড়া বাদ দিয়ে অন্য কিছু করতে থাকে তাকে যেমন চোখে দেখা হয় এরকম একটি চোখ কোথাও কোথাও থাকতো।

আমার সাথীদের অনেকেই সেই সময় লেখালেখি চর্চা করতেন। মাওলানা ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী, আমাদের এক জামাত নিচে পড়তেন। হাফেজ হওয়ার কারণে নিচে পড়তেন, তবে বয়সে সম্ভবত আমার চেয়ে এক-দুই বছরের বড় হবেন। তাঁর লেখার ব্যাপারে সবাই জানেন। মাওলানা মাসউদুর রহমান ভাই, যিনি মাসউদুর রহমান বিশ্বাস নামে শুরুর দিকে লিখতেন; গত ১৭ আগস্ট তিনি ইন্তেকাল করেছেন, অনেক সুন্দর লিখতেন।

আমাদের একটু সিনিয়র ভাই মাওলানা আবু তাহের রহমানী, যিনি এখন মাদরাসাতুস সুফফার প্রিন্সিপাল; বাংলাবাজারের একটি প্রকাশনী থেকে তাঁর বেশ কিছু বই বের হয়েছে। এখন তিনি কম লেখেন। মালিবাগ মাদরাসার শিক্ষক মাওলানা নাসিম আরাফাত ভাই, রাহমানী ভাই আর তিনি একই জামাতের ছাত্র; অনেক ভালো লেখেন।

বশির মেসবাহ ভাই দেয়াল পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। অংকনের কাজটা তিনি ওই সময় থেকেই ভালো করতেন। এখনও তাঁর জগৎটা ওইটা নিয়েই বেশি। এখনও লিখলে ভালো লেখেন। মাওলানা আহলুল্লাহ ওয়াসেল, ইন্তেকাল করেছেন। কম লিখতেন, কিন্তু যখন লিখতেন সুন্দর লিখতেন। বিশেষ করে তাঁর শেষ জীবনের ১৫/২০ বছর রাজনৈতিক লেখালেখিই বেশি করেছেন, তবুও তা খুব সুন্দর এবং অত্যন্ত সেন্সেবল হতো। মুফতি আমিনী সাহেব হুজুরের অনেক ধরনের বক্তব্যই তাঁকে কপি করতে হতো, সেগুলো তিনি দায়িত্বের সঙ্গে করতে পারতেন। তাঁর দুয়েকটি বইও বের হয়েছে।

ফরিদাবাদে এক বছর পড়ার সময় যাইনুল আবিদীন ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়। তিনি আমাদের এক জামাত উপরে ছিলেন। আমি শরহেবেকায়া পড়তাম, তিনি হেদায়া পড়তেন। তিনি এখন দেশের শক্তিমান আলেম লেখকদের একজন। ওই সময় আরেকজন মানুষ ছিলেন মাওলানা আলমগীর ভাই, লাজনাতুত তালাবা করতেন; ক্লাসগতভাবে কখনও তাঁর সঙ্গী ছিলাম না, তবে কয়েক জায়গায় দেখা হয়েছে। তাকে এখন আর লেখালেখি করতে দেখি না। আরও কেউ কেউ ছিলেন যাদেরকে এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না।

-এএ


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ