বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১২ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫


উর্দু সাহিত্যে বিবর্তন: উলামায়ে দেওবন্দের দর্শন ও ভূমিকা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

সুলাইমান সাদী ।।

দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা হিন্দুস্তানের গৌরবের মাইলফলক। যা হিন্দুস্তানের পোড়োভূমিতে শ্যামল সজিব প্রবাহ দান করেছে। দারুল উলুম দেওবন্দ মুসলমানদের ধর্মীয় ও জাতীয় ঐতিহ্য রক্ষা করে সব ধরণের মালিন্য দূর করেছে। গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের অন্ধত্ব তাড়িয়ে জ্বালিয়েছে আদর্শের আলো। তাগুদের মোকাবেলায় প্রশ্নাতীত প্রত্যয় স্থাপনের জন্য হাজারও মুজাহিদ, মুফাসসির, মুহাদ্দিস, মুতাকাল্লিম, ফকীহ, বক্তা, তার্কিক, হাফেজ, কারী , সুফীসহ চিন্তাশীল কলম সৈনিকদেরও জন্ম দিয়েছে।  যারা তাদের কলমের শক্তিতে অশুভ ঝড়ের গতি ফিরিয়ে দিয়েছেন।

সাহিত্যে দারুল উলুমের ভুমিকা তুলে ধরতে গিয়ে মাওলানা আনিসুল ইসলাম কাসেমী বলেনঃ প্রায় দেড়শ বছরের ইতিহাসে দারুল উলুম উর্দু সাহিত্যে এক ঘটনাবহুল ও গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা করেছে। সমানভাবে কাজ করেছে গদ্য, কবিতা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও অনুবাদকর্মে। গ্রন্থনা ও সংকলনেও কোনও ত্রুটি রাখেনি। প্রকাশ করেছে মাসিক, সাপ্তাহিক ও দৈনিক। প্রতিষ্ঠা করেছে পাঠাগার, গবেষনাগার ও ইনস্টিটিউট।ৎ

সাহিত্যকাননে কাসেমি বসন্ত

ঈমান ও আধ্যাত্মিকতায় আলো ফেলবার তাগিদে দারুল উলুমের সম্পর্ক মূলত আরবি সাহিত্যের সঙ্গে। এ আলো সাধারণের দোরগোড়ায় পৌঁছিয়ে দিতে এবং ইসলামি জাগরনের খাতিরে উর্দু ভাষা ও সাহিত্যেও পূর্ণতা অর্জন করেছে। কেউ কেউ তো সাহিত্যকে কবিতার রঙে রাঙিয়ে এমন কমনীয়ত দান করেছে যে, তাদের লেখায় খেলে উঠেছে যাদুময় বাস্তবতা, তরঙ্গময় প্রবাহ, অপরিহার‌্য সুক্ষ্মতা ও মেঘালয়ের উচ্চতা।

ফলে মানুষের চিন্তা চেতনায় এমন বিদ্যুতের ছটা ফেলেছে যে, তারা স্বেচ্ছা আকর্ষনে ইসলামের দিকে দৌড়ে এসেছে। এমনকি এখানে চর্চিত সাহিত্য ইসলামের সত্যিকার মুখপত্র হয়ে উঠেছে। কব্যিক কল্পনাবিলাস, কুফুরি নাস্তিকতা, দার্শনিক ঘোরনন্দন, অসাম্প্রতিক রাগভাঁজন, অহেতুক প্রেমকাহিনী, অর্থহীন উপন্যাস উপাখ্যান, কপট বানোয়াট চপলতা, ইত্যাদি থেকে এ সাহিত্য পবিত্র থেকেছে।

এখানকার সাহিত্য কালাল্লাহ ও কালার রাসুলুর মেশক আম্বরে সুরভিত। আম্বিয়ায়ে কেরামের শিক্ষা ও আদর্শে লহরিত। সাহাবায়ে কেরামের চেষ্টা প্রচেষ্টা ও অহমিকাময় ঘটনাবলীর অমোচনীয় স্মৃতি ও আলোকিত ‍দৃষ্টান্ত। ডক্টর নওয়াজ দেওবন্দী দারুল উলুমের সাহিত্যিক ভূমিকার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, নিজের বক্তব্য অন্যের কাছে পৌঁছে দেবার সবচেয়ে প্রভাকর ও কার‌্যকর মাধ্যম লিখনি। দেওবন্দের সন্তানরা সাহিত্যমাঠেও তাদের যোগ্যতার লৌহনিরীক্ষায় উত্তীর্ন হয়েছে।

উলামায়ে দেওবন্দ রচিত দশহাজারেরও বেশি গ্রন্থ তাদের যোগ্যতার বহির্প্রকাশ। সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় উলামায়ে দেওবন্দের ভূমিকা ও তৎপরতায় স্মরণীয় ইতিহাস রচিত হতে পারে।

অস্বীকারের সুযোগ নেই, উলামায়ে দেওবন্দ যখন কলম তুলে নিয়েছেন সাহিত্য ও সৃষ্টিশীলতার রাজপুত্রদের চেহারাও দেখার দৃশ্যে পরিণত হয়ে গেছে। তবে ইতিহাস প্রতারনা করে উলামায়ে দেওবন্দের সাহিত্যিক কীর্তি উপেক্ষা করেছে। আজ আমাদের দায়িত্ব হলো, সাম্প্রদায়িক ও মতাদর্শিক বিদ্বেষে ম্লান হয়ে যাওয়া সাহিত্যকীর্তির ইতিহাস বর্তমান প্রজন্মের সামনে পুঙ্খানুপুঙ্খ তুলে ধরা।

কবিতা ও দারুল উলুম

কবিতা লেখার ক্ষেত্রে সুন্দর বিন্যাস ও উচ্চারনের ক্ষেত্রে চটুলতা ও চসৎকারিত্ব সৃষ্টি  করে। এর গুরুত্ব আল্লামা আনজার শাহ এর লেখায় কিছুটা লক্ষণীয়ঃ নিঃসন্দেহে ইসলামে এমন কবিতার কোনও অবকাশ নেই যার মুখ্য হচ্ছে, অর্থহীনতা, অশ্লীলতা, চেতনায় অস্থীরতা সৃষ্টি ও সৌন্দর‌্য ও প্রেমের অসমীচীন বয়ান।

তবে যদি তা আবেগ ও কল্পনার সত্যিকার নান্দনিক প্রকাশ কবিতার স্বাভাবিক কাঠামোয় ঢুকে পড়ে তাহলে ইসলাম এর বিরোধিতা করবে না। যেমনটি পৃথিবীর স্বভাব – মাওলানা আব্দুল্লাহ এর ভাষায়, উলামায়ে দেওবন্দ কবিতাকে তাদের পেশা বা একমাত্র ধ্যানে পরিণত করেননি। বরং কবিতা ছিল তাদের অনুভবগত মেধা ও চিন্তামনস্কতার ফসল। অবচেতনেই তারা কাসিদা, কবিতা, গজল ইত্যাদি রচনা করেছেন। তবে প্রথাগত কবিদের দলে কখনও তারা নেজেদের নাম লেখাননি।

এজন্যে হাকিমুল ইসলাম রহ. এক জায়গায় বলেন, আমি কবি নই। কবিতা রচনা আমার পেশাও নয়। তবে আবেগ যখন মধমক্ষিকার গানের দলে ভিড়ে যায় কাব্যশাস্ত্র দেয়াল হয়ে দাঁড়াতে পারে না। কবিতার ঝর্ণা আপনি প্রবাহিত হতে থাকে। তাদের রচিত কাব্যগঙ্গায় ডুব দিলেই টের পাওয়া যায় কী মণিমুক্তার তার তলদেশে লুকিয়ে আছে।

মাওলানা আব্দুল্লাহ আরও বলেন, মাওলানা মুহাম্মদ মিয়া সাহেব রহ. তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ উলামায়ে হক এর প্রথম খণ্ডে শিক্ষা ও রাজনীতির দিক থেকে উলামায়ে দেওবন্দের কয়েকটি যুগের অবতারনা করেছেন। আমরা যদি সাহিত্যের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি তাহলে দেখব, প্রতিটি যুগই জন্ম দিয়েছে উর্দু ভাষায় নেতৃত্বদানকারী শ্রেষ্ঠ কবি সাহিত্যিক বক্তাদের।

উলামায়ে দেওবন্দের প্রথম সারির সাহিত্যিকদের ছোট্ট একটি তালিকা

হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা কাসেম নানুতুবি রহ., মাওলানা ইয়াকুব সাহেব রহ., শাইখুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান দেওবন্দী রহ., হাকিমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানবি রহ., আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মিরি রহ., মাওলানা হাবিবুর রহমান উসমানি রহ., আল্লামা শিব্বির আহমদ উসমানি রহ., মুফতি শফি সাহেব রহ., শাইখুল আদীব মাওলানা এজায আলী রহ., মাওলানা নাসিম আহমদ ফরিদি রহ., হাকিমুল ইসলাম কারী তৈয়ব সাহেব রহ., মাওলানা হামিদ আল আনসারি গাজি রহ., মাওলানা সাঈদ আহমদ আকবরাবাদি রহ., মুফতি আতিকুর রহমান রহ., মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানি রহ., কলম সম্রাট মাওলানা মানাযির আহসান গিলানি রহ., মাওলানা আমিনুর রহমান আমির উসমানি রহ., মাওলানা এহসানুল্লাহ তাজুর রহ., মাওলানা রিদওয়ানুল কাসেমি রহ., মুফতি কফিলুর রহমান নিশাত উসমানি রহ., আল্লামা আনজার শাহ কাশ্মিরি রহ.।

উলামায়ে দেওবন্দ শুধু উর্দু ভাষা ও সাহিত্যের বিবর্তন ও উন্নতিতে নয়, কাজ করেছেন এর স্থায়িত্ব, নান্দনিকতা, পবিত্রতা, মধুরতা, চিত্তাকর্ষন, আবেগময়তা, যাদুময়তা ও কমনীয়াতা নিয়েও। উর্দু সাহিত্যে উলামায়ে দেওবন্দের লুকিয়ে রাখা খাজানা আবিস্কার করে তাদের সুনাম ও সুকীর্তির স্বীকৃতি দেয়া সময়ের দাবি।

লেখক: তরুণ কবি ও প্রাবন্ধিক

আরএম/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ