শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৭ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১১ শাওয়াল ১৪৪৫


স্মরণ: উজাড়প্রাণ মানুষ ছিলেন সৈয়দ ফজলুল করীম রহ.

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

পলাশ রহমান ।।

মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ ফজলুল করীম রহ.। ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ মুজাহিদ কমিটির মরহুম আমীর। বাংলাদেশের আধ্যাতিক এবং রাজনৈতিক অঙ্গনের একজন প্রাণপুরুষ। একজন সাধক, গবেষক এবং আপদমস্তক সংগ্রামী মানুষ। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আত্মশুদ্ধির রসায়ন সৃষ্টিকারী একজন উজাড়প্রাণ মানুষ ছিলেন সৈয়দ ফজলুল করীম রহ.।

তিনি আজীবন রাতের অন্ধকারে মানুষকে আন্তশুদ্ধির পথে ডেকেছেন। পথহারা মানুষের হাতে রুহানী আলোর চ্যারাগ তুলে দিয়েছেন। দিনের আলোয় গর্জে উঠেছেন প্রচলিত শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে।

তিনি দেশ শাসন, মানুষ শাসনের গোড়ায় হাত দিয়েছিলেন। বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, শুধুমাত্র নেতা পরিবর্তন করে মানব জীবনের মুক্তি আসবে না, সত্যিকারের মুক্তি এবং শান্তির স্বাদ পেতে হলে নীতির পরিবর্তন করতে হবে। শাসকদের মধ্যে আত্মশুদ্ধি ও খোদাভীতি থাকতে হবে।

নীতিগত পরিবর্তন বা সাংবিধানিক আমুল পরিবর্তন ছাড়া মানবতার মুক্তি অসম্ভব ঘোষণাকারী বাংলাদেশের রাজনীতি এবং আধ্যাতিক স্রোতধারার এই বিরল মানুষটিকে আজ পরম শ্রদ্ধাভরে, বিনম্রচিত্তে স্মরণ করছি। তিনি ২০০৬ সালের ২৫ নভেম্বর এহলোক ত্যাগ করেন।

চরমোনাইর পীর হিসাবে বেশি পরিচিত এই সিংহদিল মানুষটি ১৯৮৭ সালে ইসলামি শাসনতন্ত্র আন্দোলনের (ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ) প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এর নিঃসঙ্কোচ হাল ধরেছিলেন। তখন হয়তো অনেকেই বুঝে উঠতে পারেনি পীর মুরিদির খানকা থেকে উঠে আসা একজন মানুষ বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমন একটা ঝাকুনি দিতে পারবেন।

তিনি জোটগত রাজনীতির ক্ষেত্রে ঘোষণা দিয়েছিলেন, মানবতার মুক্তির জন্য ক্ষমতাকেন্দ্রীক কোনো জোট হতে পারে না। জোট হতে হবে আদর্শনির্ভর। মৌলিক আদর্শ পাশ কাটিয়ে ক্ষমতাকেন্দ্রীক জোট করে নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়তো করা সম্ভব, কিন্তু জাতীর ভাগ্য বদল করা সম্ভব নয়।

সৈয়দ ফজলুল করীম রহ. মানব জীবনের প্রতিটি কাজকে ইবাদতে রুপ দেয়ার চেষ্টা করতেন। ভোটকে একটি পবিত্র আমানত হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন এ মহান সাধক।

তিনি বলেছিলেন, নেতা বা শাসক নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভোট একটি গুরুত্বপূর্ণ আমানত। সঠিক পাত্রে ভোট না দিলে রাষ্ট্রের সকল দূর্নীতি বা অপকর্মের কুফল ভোট প্রদানকারীকেও ভোগ করতে হবে। সুতরাং ভোট কোনো হেলাফেলার বিষয় নয়। সঠিক পাত্রে ভোট প্রদান করা মুসলমানদের ঈমানি দায়িত্ব।

গত জাতীয় নির্বাচনে তার দল ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ এককভাবে সর্বোচ্চ আসনে (২৯৯) নির্বাচন করেছিল। দলটির বর্তমান নেতারা দৃঢ়চিত্যে ঘোষণা করেছিলেন, জোট রাজনীতির নামে আওয়ামীলীগ বিএনপি দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকে ভাগাভাগি করে নিয়েছে।

এতে দেশের রাজনীতিতে ভিন্নমত-ভিন্নাদর্শ চর্চার পথ সংকুচিত হয়েছে। বড় দুই দলের কাছে দেশের মানুষ জিম্মি হয়ে পড়েছে। দল দুটির মধ্যে স্বাধীনতার মূল চেতনা- মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার ও অর্থনৈতিক সাম্যর পরিবর্তে স্বৈরমানসিকতা পোক্ত আসন গেড়েছে।

অনেকেই সৈয়দ ফজলুল করীমের রহ. সৃষ্টি করা নতুন ধারার রাজনীতিকে হযরত হাফেজ্জি হুজুরের রহ. রাজনীতির বর্তমান সংস্করণ মনে করেন।

আজ আমাদের স্বাধীনতার চেতনা অরক্ষিত। জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত। জুলুম, নির্যাতন, দূর্নীতির খরায় গোটা দেশ চৌচির। মানুষের ভোটাধিকার নেই। নাগরিক অধিকার সরকার পক্ষের করুনায় পরিণত হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সৈয়দ ফজলুল করীমের রহ. রাজনৈতিক এবং আধ্যাতিক দর্শন যে কতোটা প্রাসঙ্গিক তা বুঝতে কারো কষ্ট হওয়ার কথা নয়।

তিনি রাজনীতিকে সমাজের নষ্টপাড়া থেকে বের করে এনে পবিত্র ইবাদতের আদল দিতে চেয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, একজন শাসক যদি খোদাভীরু হয়, রাজনীতিকে ইমানি দায়িত্ব মনে করে তবে সমাজ থেকে অন্যায় অত্যাচার জুলুম বিদায় নিতে বাধ্য হবে।

সহজ-সরল-নির্লোভ জীবনাচারে অভ্যস্ত মানুষটির হৃদয় ছিল আকাশের মতো প্রশস্ত। তিনি সব সময় মানুষের এহকাল এবং পরকালের মুক্তির স্বপ্ন দেখতেন।

তিনি ছিলেন আধ্যাতিক এবং রাজনৈতিক রসায়নের এক মহাপ্রাণ অনুঘটক। তার নামটি উচ্চারিত হলেই মানসপটে ভেসে ওঠে মাঝারি গড়নের একজন ধীর-স্থির, শান্ত স্বভাবের বর্ণিল-স্বপ্নিল-বর্ণাঢ্য জীবন বৈচিত্রের এক ব্যতিক্রম পুরুষের প্রতিচ্ছবি। সোজা-সাপ্টা নিরহঙ্কার অথচ অসাধারণ ব্যক্তিত্বের মহিমায় মহিমান্বিত একজন সাধক ছিলেন সৈয়দ ফজলুল করীম রহ.।

দেশের জাতীয় রাজনীতিতে তিনি ছিলেন একজন প্রভাব বিস্তারকারী মডেল। আধ্যাতিক জগতের রাহবার। মানতবার মুক্তির জন্য সতত জাগ্রত একজন সেনাপতি। সর্বপরি মানব কল্যাণব্রতে অঙ্গীকারবদ্ধ একজন দেশপ্রেমিক মহানায়ক।

তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি। স্বাধীনতা বিরোধীদের চক্ষুশুল। যুদ্ধের সময় তার বাবা সৈয়দ ইসহাক রহ.- এর প্রতিষ্ঠিত চরমোনাইর মাদরাসায় মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি ছিল। সেখানে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র লুকিয়ে রাখতেন। যুদ্ধের ছক আঁকতেন।

দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি সৈয়দ ফজলুল করীমের ছিল ঈর্ষণীয় মায়া। সারাক্ষণ মানুষের কল্যাণচিন্তায় মেতে থাকতেন। লুটপাটের রাজনীতি, আধিপত্যের রাজনীতি, অন্যদেশ নির্ভর রাজনীতির বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সদা জাগ্রত।

যারা তার সান্নিধ্য পেয়েছেন শুধুমাত্র তারাই বলতে পারবেন, তিনি দেশকে, জাতীকে কতো বেশি দিতে চেয়েছিলেন। মানবতার কল্যাণচিন্তায় তিনি কতোটা উদগ্রিব থাকতেন। রাসুলের স. আদর্শে কতোটা দৃঢ় ছিলেন। ঈমানি চেতনায় কতোটা শক্ত ছিলেন, কতো উঁচু মাপের একজন পরহেজগার আলেম ও সাধক ছিলেন।

সৈয়দ ফজলুল করীম আজ আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু রেখে গেছেন কিছু কালজয়ী বক্তৃতা, দর্শন। হাজার চেষ্ট করেও তাকে আর পাওয়া যাবে না। কিন্তু তার কালজয়ী কথা, কর্ম এবং দর্শন হয়ে আছে উত্তরশুরীদের প্রেরণার দলিল। যা পথহারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় যে কোনো মানুষের মাঝে দেশপ্রেম, খোদাপ্রেম জাগিয়ে তুলবে।তার রাজনৈতিক এবং আধ্যাতিক প্রতিটি বক্তব্যই আমাদের জাতীয় সম্পদ। এগুলো যথাযথ ভাবে সংরক্ষণ করা দরকার। সার্বজনীন করা দরকার।

বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সৈয়দ ফজলুল করীম প্রতিদিন, প্রতিমুহুর্তে কতোভাবে যে প্রাসঙ্গিক তা এই এক রচনায় লিখে শেষ করা অসম্ভব।

বর্তমানে তার ছেলে সৈয়দ রেজাউল করীম যোগ্যতার সাথে ইসলামি আন্দোলন এবং বাংলাদেশ মুজাহিদ কমিটির হাল ধরেছেন। দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত প্রতিদিন চষে বেড়াচ্ছেন বাবার রেখে যাওয়া অসমাপ্ত মিশন নিয়ে। তারা চেষ্টা করছেন বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে অন্তত একটি করে মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত করতে, যাতে দেশের মানুষ নৈতিক শিক্ষা থেকে বিচ্যুত হয়ে না যায়। এই মিশন বাস্তবায়নের জন্য সৈয়দ ফজলুল করীম রহ. প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাংলাদেশ কোরান শিক্ষা বোর্ড।

আগামীকাল (২৬ নভেম্বর) থেকে বরিশালের কির্তনখোলা নদীর তীরে চরমোনাইর মাদরাসায় তিন দিনের বার্ষিক ওয়াজ মাহফিল শুরু হবে। সেখানে মানুষের আধ্যাতিক চেতনা জাগ্রত করতে দেশ বিদেশের আলেমগণ ওয়াজ নসিহত করবেন এবং লাখো মানুষ দুহাত তুলে তাদের প্রিয় আধ্যাতিক এবং রাজনৈতিক রাহবার সৈয়দ ফজলুল করীমের রহ. জন্য দোয়া করবেন। আমরাও তার আত্মার শান্তি কামনা করি।

লেখকঃ প্রডিউসার, রেডিও বেইজ, ইতালি

আরএম/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ