বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১১ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫


লেখকদের সঙ্গে ৫৪ ঘণ্টা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মিযানুর রহমান জামীল ।।

জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেইট। ১১ জনের একটি কাফেলা। লেখকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরামের নির্বাহী কমিটির সদস্য সবাই। আমাদের গন্তব্য সৈকতের শহর কক্সবাজার। প্রতি বছর ফোরামের উদ্যোগে একদিনের একটি সফর হয়।

সেখানে আমাদের নির্বাহী কমিটির সদস্যদের ব্যস্ত থাকতে হয় আয়োজন নিয়ে। উপভোগের খুব একটা সুযোগ থাকে না। এজন্য একটু রিফ্রেস হতে প্রতি বছর আমরা নির্বাহী কমিটির সদস্যরা একসঙ্গে ঢু মারি কোথাও। তবে সফরের পাশাপাশি আমাদের সাংগঠনিক কর্মসূচিও বাস্তবায়ন হয়ে যায়।

১৩ নভেম্বর ২০১৯। ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত ১০টা। আমাদের গাড়ি মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার হয়ে ছুটে চলল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধরে।

আমাদের সফরসঙ্গী হিসেবে আছেন সাবেক সভাপতি মুফতি এনায়েতুল্লাহ, বর্তমান সভাপতি জহির উদ্দিন বাবর; সহসভাপতি কাজী আবুল কালাম সিদ্দীক, সাধারণ সম্পাদক মুনীরুল ইসলাম, সহসাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান খসরু, সহসাংগঠনিক সম্পাদক আবুল কালাম আনছারী, প্রশিক্ষণ সম্পাদক শামসুদ্দীন সাদী, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্পাদক সাদ আবদুল্লাহ মামুন, আইন ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক নকীব মাহমুদ, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ওমর ফারুক মজুমদার, নির্বাহী সদস্য হাসান আল মাহমুদ ও আমি মিযানুর রহমান জামীল। এতোগুলো পরিচিতমুখ লেখকের সঙ্গে সফরের মজাই আলাদা!

ইতোমধ্যে সফরের আমির নির্বাচিত হয়ে গেলেন আমাদের ‘সবার দাদা’ খ্যাত মুফতি এনায়েতুল্লাহ। আর সভাপতি জহির উদ্দিন বাবর থাকলেন সার্বিক তত্ত্বাবধানে। সফরের ম্যানেজার শামসুদ্দীন সাদী ভাই কমলা, চিপসসহ বিভিন্ন খাবার আগেই গাড়িতে এনে রাখেন। খাবার, গল্প আর মজার খুঁনসুঁটির মধ্য দিয়ে ফাঁকা মহাসড়কে শাঁ শাঁ করে এগিয়ে চলল আমাদের গাড়ি।

এর মধ্যেই ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মুনীর ভাই সবাইকে নিয়ে একটি দারুণ ছড়া লিখে ফেললেন। ফেসবুকে পোস্টও করলেন। ছড়াটি ছিল প্রাণযুক্ত, পানমুক্ত। কারণ আমাদের গাড়ির পানখোর ড্রাইভার ছড়ায় স্থান পাননি। আমরা তখন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে। এর মধ্যে কেউ কেউ ঘুমের ঘোরে হারিয়ে গেলেন।

কর্ণফুলি পেরিয়ে আমাদের গাড়ি পটিয়ার কাছাকাছি একটি জায়গায় এসে থামল। রাত তখন তিনটা পেরিয়ে চারটার কাঁটায়। কারও কারও ক্ষুধা পেয়েছে। তবে রাস্তার পাশের হোটেলের খাবারের যে অবস্থা তাতে তেমন রুচি হলো না কারও। তবে হালকা শাঁসযুক্ত ডাবে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন সবাই।

কক্সবাজারের কাছাকাছি এসে আমরা একটি মসজিদে জামাতের সঙ্গে ফজরের নামাজ আদায় করি। আমরা যখন সৈকতের শহরে পৌঁছি ততক্ষণে সকালের নরম আলো পরম মমতায় তার পরশ বুলাচ্ছে মায়াবি এই শহরে। একটি মোটেল আগেই বুকিং দেয়া ছিল। প্রতি রুমে তিনজন/চারজন করে। সবার ক্ষিদে পেয়েছে। এজন্য সকালের নাস্তাটা সবাই একসঙ্গে সেরে কেউ কেউ ঘুমরাজ্যে নিজেকে সঁপে দিলেন আবার কেউ ছুটে গেলেন সৈকতে।

কক্সবাজারে আমরা থাকব একদিন। আমাদের সফরটা আনন্দ ভ্রমণ হলেও কক্সবাজারেই দুটি প্রোগ্রাম নির্ধারিত। আমাদের আসার খবরে কক্সবাজার ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার আয়োজন করে লেখালেখির বুনিয়াদি কর্মশালা। দুপুরে সামুদ্রিক তাজা মাছসহ বাহারি আইটেমে তারা আমাদের আপ্যায়িত করেন। আসর পর্যন্ত চলা কর্মশালায় দুই শতাধিক শিক্ষার্থী অনুধাবন করলেন লেখালেখির গুরুত্ব। আর কীভাবে লিখতে হবে এর একটা ধারণাও পেলেন তারা।

কক্সবাজারে এসে সূর্যাস্তের মুহূর্তটা সৈকতে না কাটাতে পারলে তো সবই মিছে! এজন্য কর্মশালার শেষ করে আমরা দ্রুত ছুটে চললাম সৈকতে। আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন স্থানীয় লেখক জমির আল হাফিজ, রহিমুল্লাহসহ কয়েকজন। শেষ বিকেলে সৈকতে একসঙ্গে স্মৃতি ধারণ, মুক্ত বাতাস আর দুষ্টু ঢেউয়ের সঙ্গে খেলা করতে করতে কেটে গেল বিকেল। রক্তিম সূর্যটি ততক্ষণে বিদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। শেষ বিকেলের নিদারুণ ও চমৎকার আবহাওয়ায় আমার ‘মহাবিপদ সঙ্কেত’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচনও হয়ে যায়।

সন্ধ্যার পর কক্সবাজার প্রেসক্লাবে আমাদের সম্মানে আয়োজন করা হয় মতবিনিময় সভার। স্থানীয় লেখক আবুল মনজুরের আন্তরিকতায় কক্সবাজার ইসলামী সাহিত্য ও গবেষণা পরিষদ এবং রামু লেখক ফোরামের ব্যানারে এই আয়োজন। এতে মূলধারার লেখক-সাংবাদিকরাও অংশ নেন। অত্যন্ত আন্তরিকতাপূর্ণ পরিবেশে এই মতবিনিময় অনুষ্ঠিত হয়। সৈকতপারের মানুষেরা আমাদেরকে তাদের হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসায় সিক্ত করেন। কোমল মনের এই মানুষদের সঙ্গে গালগপ্প আর দুই পর্বের আপ্যায়ন সারতে সারতে রাত প্রায় ১০টা বেজে যায়।

আমরা হোটেলে না গিয়ে আবার ছুটে যাই সৈকতে। রাতের সৈকত অন্যরকম এক অনুভূতির। সেখানে পাতা সিটে পাশাপাশি গা এলিয়ে দিয়ে সবাই সমুদ্রের ভয়ংকর সৌন্দর্য উপভোগ করতে থাকি। বাদাম চিবাতে চিবাতে খোশগল্প করে কখন যে রাত ১২টার কাঁটা পেরিয়ে যাচ্ছে সেটা কেউ টেরই পাইনি। আস্তে আস্তে সৈকত ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া মশাদের উৎপাত আর টিকতে দেয়নি। রাতের খাবার সেরে যখন হোটেলে পৌঁছি তখন রাত একটা ছুঁইছুঁই।

পরদিন শুক্রবার। বাদ ফজর অনেকে ছুটে যান সৈকতে। শেষবারের মতো পানিতে নেমে লাফালাফি-দাপাদাপি করেন। সকালের নাস্তা সেরে আমাদের গাড়ি ছুটে চলে ইনানী বিচের উদ্দেশে। বাম দিকে পাহাড় আর ডান দিকে নীল সাগরের ঢেউ, মেরিন ড্রাইভের অপূর্ব এই দৃশ্য সত্যিই প্রাণভরে উপভোগ করার। যাওয়ার পথে হিমছড়ি নামার কথা থাকলেও সময়স্বল্পতার কারণে সেখানে আমাদের গাড়ি থামেনি।

পাথরের গায়ে লবণাক্ত পানির আছড়ে পড়া দৃশ্য দেখার জন্য সাধারণত ইনানীতে আসেন পর্যটকরা। আমরা যখন আসি তখত ইনানীর পাথরগুলো ছিল পানিতে নিমজ্জিত। ভাটা পড়তে থাকলে পাথর উঁকি মারা শুরু করবে। সেই পর্যন্ত থাকলে আমাদের বিলম্ব হয়ে যাবে। তারপরও এক ঘণ্টার মতো আমরা বালুভেজা তীরে হাঁটাহাঁটি করি। এ সময় কেউ ঘোড়ায় চড়ে, কেউ ঝিনুক কুড়িয়ে, কেউ পানিতে ডুবে থাকা পাথরে দাঁড়িয়ে স্মৃতিগুলো ধারণে ব্যস্ত। পাইপ দিয়ে একসঙ্গে ডাব খাওয়ার প্রতিযোগিতাটিও ছিল বেশ উপভোগ্য।

কক্সবাজারে ফিরে দেরি না করে আমরা চট্টগ্রামের পথ ধরি। রাস্তায় এক মসজিদে জুমা পড়ে বন্দরনগরীতে পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় চারটা বেজে যায়। নগরীর হোটেল জামানে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মেজবানি খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেন সবাই। এবার আমাদের গন্তব্য দারুল মাআরিফ। লেখক আবদুল্লাহ আল মারুফ এসেছেন আমাদেরকে রিসিভ করতে।

রাস্তা বিভ্রাটের কারণে অনেক অলি-গলি পেরিয়ে মাগরিবের আজানের কিছুক্ষণ আগে আমরা পৌঁছি দারুল মাআরিফে। এখানকার শিক্ষক ও তরুণ লেখক মাহমুদ মুজিব আমাদেরকে রিসিভ করেন। ছাত্র সংসদে আমাদের নিয়ে মতবিনিময়ের আয়োজন ছিল। তবে আসতে দেরি হয়ে যাওয়ায় অল্প সময়ের মধ্যে দারুল মাআরিফের লেখিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে সাক্ষাৎপর্ব সারতে হয়। তবে তাদের সামান্য মুহুর্তের আন্তরিকতাও অনেক দিন মনে রাখার মতো।

বাদ মাগরিব কিংবদন্তিতুল্য আরবি সাহিত্যিক ও দারুল মাআরিফের মহাপরিচালক আল্লামা সুলতান যওক নদভীর দা.বা.-এর সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ। তিনি অসুস্থ, তবুও আমাদের কথা শুনে সময় দিতে সম্মত হয়েছেন। বাদ মাগরিব আমরা তাঁর বাসায় গিয়ে সাক্ষাৎ করি।

অসুস্থতার কারণে আমরা শুধু দোয়া নিয়ে চলে আসবো এমনটাই নির্ধারিত ছিল। কিন্তু তিনি আমাদের পেয়ে যেন সব অসুস্থতা ভুলে গেলেন! নিজের জীবনের নানা স্মৃতিচারণ করলেন এবং লেখালেখিতে এগিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিলেন।

সফরের শেষ আয়োজন ছিল নগরীর তালীমুল উম্মাহ মাদরাসায়। সেখানে চট্টগ্রাম জাগৃতি লেখক ফোরাম আমাদের সম্মানে মিডিয়া বিষয়ে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকসহ চট্টগ্রামের বিশিষ্ট লেখক ও বোদ্ধা মহল সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

প্রাণবন্ত পরিবেশে তাদের সঙ্গে মতবিনিময় হয়। তাদের আন্তরিকতা ও আপ্যায়নে বিমুগ্ধতার আবেশ নিয়ে গভীর রাতে আমাদের গাড়ি ছুটে চলে রাজধানী দিকে। রাত যখন চারটা তখন যান্ত্রিক এই শহরে পা রাখি। সম্পন্ন হয় আমাদের ৫৪ ঘণ্টার সফর। অন্যরকম আবেশ মাখা এই সফরের জন্য আবার অপেক্ষা করতে হবে একটি বছর।

লেখক: নির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম

আরএম/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ