শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১১ শাওয়াল ১৪৪৫


দীনের বিষয়ে কোনো শিথিলতা তিনি সহ্য করতেন না: শাইখুল হাদীস রহ.-এর সহধর্মীনী

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আওয়ার ইসলাম: শাইখুল হাদীস রহ. কে নিয়ে স্মৃতিচারণমূলক সাক্ষাৎকারের কাজ দীর্ঘদিন যাবৎ করছি। হজরতের ঘনিষ্ঠজন, সহকর্মী, ছাত্র ও পরিবারের প্রায় পঞ্চাশজনের স্মৃতিকথা ইতোমধ্যে রাহমানী পয়গামে প্রকাশিত হয়েছে। এ তালিকায় সবচেয়ে কাঙ্খিত ব্যক্তি ছিলেন আমাদের নানিজান শাইখুল হাদীস রহ. এর সহধর্মীনী। তিনিই হলেন হজরতের সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের সঙ্গী।

কয়েক বছর আগে নানিকে আমাদের বাসায় পেয়ে ধরলাম, আজকে আমাদের বাসায় থাকবেন, নানাজির গল্প শুনাবেন। নানি খুব সহজেই রাজি হয়ে গেলেন। আমাদের শুনালেন অনেক অজানা কথা। একরাতে সব বলা সম্ভব হল না। বললেন, আরেক দিন এসে থাকবেন। কিন্তু তার আর হয়নি। গত একবছর যাবৎ তিনি অসুস্থ।

সাক্ষাৎকারটা পূর্ণ করা সম্ভব হবে কিনা সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলাম। একদিন সন্ধ্যায় মামুন মামা বললেন, চলো আম্মার কাছে যাই দেখি কিছু কথা নেয়া যায় কিনা। আমাদের ভাগ্য ভালো ছিল। সেদিন অসুস্থ শরীরেই আমাদের সাথে অনেক কথা বললেন। টের পেলাম ৫০ বছর আগে ফেলা স্মৃতিগুলো তখনও প্রাণবন্ত। তুলে ধরলেন শাইখুল হাদীস রহ. এর জীবন সৌন্দর্য। উঠে এলো শিক্ষণীয় অনেক কথা। পাঠকের জন্য থাকলো আলোচনার চুম্বক অংশ। সাক্ষাৎকার গ্রহণ ও গ্রন্থনা মুহাম্মাদ এহসানুল হক।


এহসানুল হক : শাইখুল হাদীস রহ. এর সাথে আপনার জীবনের সূচনাকালের কথা জানতে চাই। বৈবাহিক সূত্রে আপনারা আবদ্ধ হয়েছিলেন কত সনে?

শাইখুল হাদীসের সহধর্মীনী : সেটা তো অনেক আগের কথা। দিন তারিখ এখন মনে নাই। তবে এটুকু মনে আছে আমাদের বিবাহ হয়েছিল ১৯৬৪ সনের শেষ দিকে।

এহসানুল হক : বিবাহের ঘটনাটা মনে আছে?

শাইখুল হাদীসের সহধর্মীনী : হজরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ. এর গওহরডাঙ্গা মাদরাসায় ওনার যাতায়াত ছিল। একবার তিনি গওহরডাঙ্গা মাদরাসার মাহফিলে গেলে আামর আব্বাও সেখানে যান, বয়ান শুনেন। এবং সেখান থেকে ওনাকে আমাদের উদয়পুরের মাদরাসায় নিয়ে আসেন। উদয়পুর মাদরাসায় তিনি বয়ান করেন। তার জ্ঞানগর্ভ আলোচনা শুনে এলাকার সবাই ভক্ত হয়ে উঠে। আব্বারমনের মধ্যেও তার জন্য অনেক মুহাব্বত সৃষ্টি হয়।

এহসানুল হক : এরপর আপনার সাথে কিভাবে বিবাহ হলো?

শাইখুল হাদীসের সহধর্মীনী : আমার অন্য বোনদের বিয়ের পর যখন আমার পালা এলো, আমার বিয়েটা কোথায় যেন আটকে ছিল। কথা আসতো অনেক, কিন্তু নানা কারণে কথা আর আগাতো না। আব্বা একবার রাগ হয়ে আম্মাকে বললেন, তোমার মন মতো হয় না, এজন্য বিবাহ আটকে আছে। তখন আম্মা বলে দেন, আচ্ছা এবার যেখান থেকেই প্রস্তাব আসবে আপনি সেখানেই দিয়ে দিয়েন। ঠিক এমন সময়ই আমার ভগ্নিপতি হাফেজ জামিল সাহেব এর মাধ্যমে হুজুরের পক্ষ থেকে প্রস্তাব আসে।

তাছাড়া মাওলানা আব্দুল মজিদ ঢাকুবী সাহেব ছিলেন হুজুরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তিনি তখন আমাদের উদয়পুর মাদরাসায় বুখারি শরিফ পড়াতেন। উদয়পুর মাদরাসা তখন দাওরায়ে হাদিস পযর্ন্ত ছিল। ঢাকুবী সাহেবের পরিবারের সাথে আমাদেরও খুব সুসম্পর্ক ছিল। আমাদের আসা-যাওয়া ছিল। ঢাকুবীসাহেবের বিবি আমাকে চিনতেন। এরপর যখন হুজুরের বিবাহের জরুরত হলো তখন ঢাকুবী সাহেবই আমার কথা তুললেন। তিনিও আগ্রহ প্রকাশ করলেন।

ঢাকুবী হুজুর তখন আমার আব্বার কাছে এই বিবাহের প্রস্তাব দিয়ে চিঠি লিখেন, আব্বা চিঠির জবাবে বললেন, রমজানের পর আমি ঢাকায় এসে কথা বলবো। আব্বার এক বন্ধু ছিলেন মাওলানা আব্দুল হাফিজ সাহেব। তিনি ছিলেন ঢাকা আলিয়ার শিক্ষক। তিনি আব্বার অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। তার সাথে পরামর্শ ছাড়া আব্বা কোনো কাজ করতেন না। আব্বা বললেন, ঢাকা এসে আমি তার সাথে পরামর্শ করে জানাবো।

কিন্তু ঢাকুবী হুজুর আব্বার কাছে খবর পাঠালেন, আপনার আসা লাগবে না। আমরা গওহরডাঙ্গা আসবো। সেখানেই দেখা সাক্ষাৎ হবে এবং কথা চূড়ান্ত হবে। সে অনুযায়ী তিনি গওহরডাঙ্গা আসলে আব্বা ও চাচারা গিয়ে দেখা করলেন, কথা বললেন। আব্বার তো তোমাদের হুজুরকে অনেক আগ থেকেই পছন্দ ছিল। আমার পরিবারের অন্যদেরও আগ্রহ তৈরি হলো।

তার বয়স তখন একটু বেশি ছিল। কিন্তু এ কারণে আমি যাতে এই বিবাহে দ্বিমত না করি সে জন্য আব্বা আমাকে বুঝালেন। আব্বা একটা শের পড়েছিলেন, ‘এক জামানা সুহবাতে বা আউলিয়া, বেহতের আজ সদ সালা তাআত বেরিয়া।’ আল্লাহর অলির কিছু সময়ের সুহবত, অনেক ইবাদত থেকেও উত্তম। এসব বলে আব্বা আমাকে বুঝিয়েছিলেন। তাছাড়া তখন আমি সৌভাগ্যের ঈঙ্গিতবাহী একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম, সেটাও আমাদের সবার আগ্রহের কারণ হয়েছিল।

এহসানুল হক : স্বপ্নটা কী ছিল?

শাইখুল হাদীসের সহধর্মীনী : যখন আমার বিবাহের আলোচনা চলছে, তখন আমি একদিন স্বপ্নে দেখি আমি আমাদের বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে আছি, এমন সময় আকাশ থেকে একটা আলো এসে পড়ছে, আব্বা আর আমার দুলাভাই হাফেজ জামিল সাহেব সেটা আমার হাতে তুলে দিচ্ছেন, আমি সেটা গ্রহণ করছি। এই স্বপ্নের কথা শোনার পর সবার আগ্রহ আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল।

এহসানুল হক : বিবাহের পর প্রথম জীবনে কোথায় কেটেছে?

শাইখুল হাদীসের সহধর্মীনী: প্রথম সময়টা আমি বাড়িতে ছিলাম। বিবাহের আগেই তিনি আব্বাকে বলে রেখেছিলেন, আমাকে দীর্ঘসময় বাড়িতে রাখবেন। ঢাকায় আসলাম প্রায় ৭/৮ মাস পর। একমাস থেকেই আবার চলে গেলাম বাড়িতে। আবারও ৫/৬ মাস থাকলাম। শুরুতে আমার মন ঢাকায় টিকতোই না। বাড়িতেই বেশি থাকতাম। কিন্তু এভাবে বেশি দিন আর চলেনি। কিছুদিন পর ঢাকায়ই স্থায়ী হতে হলো। আমাদের বাসা ছিল তখন চকবাজার। শুরু হলো আমার শহরের জীবন। আমি মাঝে মাঝে খোঁচা দিয়ে বলতাম, কি খবর! আপনি না আমাকে বাড়িতেই রাখবেন? তিনি হাসতেন। আমার এসব কথার সুন্দর জবাব তার কাছে রেডিই থাকতো। কথা তো তিনি কম জানতেন না!

এহসানুল হক : আপনি বাড়িতে থাকার সময়টায় শায়েখ কেমন আসতেন?

শাইখুল হাদীসের সহধর্মীনী : খুব বেশি আসতে পারতেন না। মাদরাসা ছিল। তখন তিনি লালবাগে পড়াতেন। তাছাড়া যাতায়াত ব্যবস্থা অনেক খারাপ ছিল। ঢাকা থেকে খুলনার মোল্লাহাট আসতে প্রায় দুই দিন লেগে যেত। এ জন্য তেমন আসা হতো না। দেড় মাস দুই মাস পরপর আসতেন। তবে এই সময়ে তিনি চিঠিপত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখতেন। মাঝে মধ্যে আমিও চিঠির জবাব দিতাম। সেই সময়টা খুব ভালো ছিল।

এহসানুল হক : প্রথম ঢাকায় এলে মানুষের বিভিন্ন কিছু দেখার শখ থাকে, আপনারও ছিল? শায়েখের সাথে কখনো ঘুরতে গেছেন?

শাইখুল হাদীসের সহধর্মীনী : হ্যাঁ, গিয়েছি। তিনি অনেক ব্যস্ত থাকলেও পরিবারকে অনেক সময় দিতেন। প্রথম বার ঢাকায় আসার পর আমাকে তিনি অনেক জায়গায় ঘুরতে নিয়ে গেছেন। তখন এত ঘুরার জায়গা ছিল না। সব ধরনের শখ পূর্ণ করার চেষ্টা তিনি করতেন। কেমন চেষ্টা করতেন, একটা ঘটনা শুনলেই বুঝবে।

আমাদের বাসার পাশেই ছিল চকবাজার মসজিদ। উঁচু মিনার দেখে আমার শখ হলো, চকবাজার মসজিদের মিনারে উঠবো। তোমাদের হুজুরের কাছে একবার আমি বলে বসলাম, আমাকে চকবাজার মসজিদের মিনারের উপরে উঠিয়ে ঢাকা শহর দেখাতে হবে। তখন তো এতো উঁচু দালান কোঠা ছিল না। চকবাজারের মিনারের উপর থেকে প্রায় ঢাকা শহরই দেখা যেত।

আমি কথাটা রশিকতা করেই বলেছিলাম। কিন্তু একদিন ঠিকই আমাকে চকবাজার শাহি মসজিদের মিনারে উঠিয়ে আমাকে ঢাকা শহর দেখিয়ে ছিলেন। শুধু তাই না, এত উঁচু সিড়ি বেয়ে উঠতে আমার যেন সুবিধা হয় সে জন্য সুবিধাজনক কাপড়ও আমাকে পরিয়ে নিয়েছিলেন। আমি কল্পনাও করিনি তিনি বাস্তবেই নিয়ে যাবেন। ব্যাপারটা কত অদ্ভুত ছিল। পরে মনে হলে আমার নিজেরও হাসি আসতো। আমি ছাড়া আর কোন মেয়ে মানুষ হয়তো ঐ মিনারের উপরে উঠে নাই।

শুধু এটাই না। সব সময়ই তিনি ঘরের মানুষদের অনেক গুরুত্ব দিতেন। তাদের সুবিধা-অসুবিধার দিকে লক্ষ্য করতেন। খুশি করার চেষ্টা করতেন। নিজেও অনেক শখওয়ালা মানুষ ছিলেন, ঘরের মানুষদের শখও পুরা করার চেষ্টা করতেন।

এহসানুল হক : শুনেছি, বাসায় কাজের লোক রেখে দেয়ার জন্য ইবাদত বেশি করার শর্ত করেছিলেন?

শাইখুল হাদীসের সহধর্মীনী : প্রথম যখন তিনি বাসায় কাজের লোক রেখে দেন, তখন তিনি বলেছিলেন, কাজের লোক রেখে দিলাম, তুমি আর বেশি কাজ করবা না। ইবাদত বন্দেগি করবা। তিলাওয়াত করবা। আমি বাসায় এসে যেন তোমাকে ইবাদতে মশগুল দেখতে পাই। ইবাদত যাতে বেশি করতে পারি, এ জন্যই তিনি বাসায় কাজের লোক ঠিক করেছিলেন।

এহসানুল হক : শায়েখের দৈনন্দিন জীবনে আমলের কথা জানতে চাই।

শাইখুল হাদীসের সহধর্মীনী : তিনি রাতে খুব দ্রুত ঘুমিয়ে পড়তেন। দশটা সাড়ে দশটার মধ্যে শুয়ে পড়তেন। এরপর ৩/৪ টার দিকে তাহাজ্জুদ পড়তে উঠতেন। প্রথম সময় থেকেই আমি তাহাজ্জুদ পড়তে দেখেছি। তখন আমরা দুইজন জামাতে তাহাজ্জুদ পড়তাম। তাহাজ্জুতের জামাতে তিনি খুব বেশি লম্বা কেরাত পড়তেন না। আমার যাতে কষ্ট না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতেন।

কখনো চার রাকাত, কখনো ছয় রাকাত পড়তেন। এরপর কতক্ষণ জিকির করে তারপর দোয়া করতেন। এটা নিয়মিত আমল ছিল। কখনোই মিস করতে না। ফজরের নামাজ পড়ে আর ঘুমাতেন না, মাদরাসায় চলে যেতেন। এরপর আবার বাসায় এসে নাস্তা করতেন। নাস্তা করে যেতেন বাজার করতে। নিজ হাতেই বাজার করতেন। নিজের কাজ সময় নিজেই করতে পছন্দ করতেন। কোন তরকারি কিভাবে রান্না করতে হবে, তা বলে দিতেন। শুধু তাই না, তিনি নিজেও রান্না করতে পারতেন।

এহসানুল হক : রমজানের আমল সম্পর্কে জানতে চাই...

শাইখুল হাদীসের সহধর্মীনী : রমজানেও দিনের বেলা খুব বেশি ঘুমাতেন না। ৮ টার দিকে উঠে ইশরাক নামাজ পড়তেন। এরপর কিতাব নিয়ে বসতেন। আমার কখনো ঘুম থেকে উঠতে দেরি হলে বলতেন, ইশরাক পড়। যত দেরি হোক সমস্যা নাই। নামাজ পড়ে তার পর কুরআন শরিফ নিয়ে বসতাম। দিনে কখনো বাইরে যেতেন। ইফতার বেশির ভাগ বাসায়ই করতেন।

কখনো ইফতার মাহফিল থাকলে সেখানে যেতেন। মাগরিবের পর বাসায় এসে একটু বিশ্রাম নিতেন। আবার কখনো সেই সুযোগ হয়ে উঠতো না। তারাবিতে যাওয়ার আগে সামান্য খাবার গ্রহণ করতেন। খুব গুরুত্বের সাথে তারাবির নামাজ আদায় করতেন। বাসার ছোট ছেলে মেয়েদের দিয়ে নামাজের ইমামতি করাতেন। কখনো কখনো তিনি নিজেও ঘরে তারাবিহ পড়তেন।

রমজানে তিনি সবচেয়ে বেশি পরিমাণ নফল নামাজের ইহতেমাম করতেন। যখন বেশি ব্যস্ত হয়ে গেলেন তখনও ইতিকাফ ছাড়তেন না। মাদরাসার কাজে কখনও বাধ্য হয়ে বের হলে আবার মসজিদেই ফিরে যেতেন। তারপরও ইতিকাফ ছাড়তেন না। এক সময় তিনি লালবাগ কেল্লার মসজিদে জুমা পড়াতেন। ওই মসজিদেই তিনি সবচেয়ে বেশি ইতিকাফ করেছেন। এছাড়াও লালবাগ শাহি মসজিদে দীর্ঘদিন বসেছেন।

এহসানুল হক : সন্তানদের তরবিয়তের ব্যাপারে তিনি কতটা কঠোর ছিলেন?

শাইখুল হাদীসের সহধর্মীনী : সন্তানদের তরবিয়তের ব্যাপারে তিনি অনেক কঠোর ছিলেন। কেমন কঠোর ছিলেন, একটা ঘটনা শুনাই। হজরত হাফেজ্জী হুজুর যখন প্রসিডেন্ট নির্বাচন করলেন, সেই সময়ের কথা। তোমাদের হুজুরও নিবার্চনের জন্য কত কষ্ট করছেন, কত জায়গায় সফর করছেন। নির্বাচনের ফল জানার জন্য স্বাভাবিকভাবে সবার মধ্যেই অধীর আগ্রহ ছিল। আমার ছেলেদের মধ্যে কেউ একজন রেডিও ছেড়ে নিবার্চনের ফলাফল শুনছিল, আমিও শুনছিলাম।

এমন সময় তিনি বাহির থেকে ঘরে আসেন। এসে দেখেন আমরা সবাই রেডিও শুনছি। এটা দেখে তিনি এত রাগান্নিত হন যে, আমাকেসহ সবাইকে ঘর থেকে বের করে দেন। আর বলছিলেন, আজকে ওরা রেডি শুনছে, এতে অভ্যস্থ হলে কয়দিন পর দেখা যাবে ওরা গান-বাজনা শুনছে। এমন কাজ আমার বাসায় চলবে না। তোমরা সবাই আমার ঘর থেকে বের হয়ে যাও। এটা বলে সবাইকে ঘর থেকে বের করে দেন।

তখন মাহবুব একটু বড়। মাহফুজ-মামুন অনেক ছোট। আমরা বাসার নিচে গিয়ে বসে থাকলাম। অনেক রাত হলে তিনি যখন ঘুমালেন, তখন আমরা ঘরে ঢুকতে পেরেছিলাম। দীনি বিষয়ে তিনি এতটাই কঠোর ছিলেন। শরিয়তের ব্যাপারে তিনি নূন্যতম ছাড় দিতেন না। সুন্নতের খেলাফ করলেও রাগ হতেন।

এহসানুল হক : সন্তানদের পড়াশোনার ব্যাপারে শায়েখের তরিকা কী ছিল?

শাইখুল হাদীসের সহধর্মীনী : সন্তানদের প্রাথমিক পড়াশোনা তিনি নিজেই করাতেন। প্রায় সবাইকেই তিনি কায়দা পড়িয়েছেন। খাবার খেতে বসলে এ সময়টাতে ওদেরকে পড়াতেন। কায়দা পড়া শেষ হলে মাদরাসায় নিয়ে যাওয়া শুরু করতেন। শুধু ছেলেদের না, প্রথম যুগের মেয়েদেরও মাদরাসায় নিয়ে যেতেন। ছেলে-মেয়েদের সবক সূচনা বা খতম করার সময় বড় হুজুরদের বাসায় দাওয়াত করে নিয়ে আসতেন।

এই পরিবারের প্রথম হাফেজা সাঈদার শেষ সবক শোনার জন্য হাফেজ্জী হুজুর বাসায় এসেছিলেন। এ ছাড়াও আরেকবার যখন মাহফুজ ও ওর বোনসহ কয়েকজন নাতি-নাতিন একসাথে হাফেজ হলো, তখন তিনি লালবাগ মাদরাসার উস্তাদদেরকে দাওয়াত করেছিলেন।

এহসানুল হক : আওলাদদের বিবাহের ক্ষেত্রে শায়েখের দৃষ্টিভঙ্গি কী ছিল?

শাইখু ল হাদীসের সহধর্মীনী : বিবাহের ক্ষেত্রে তিনি দীনদারিকেই সব চেয়ে বেশি প্রাধান্য দিতেন। আর মেয়ে বা নাতিন বিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে শর্ত একটাই করতেন, সন্তানদের যেন দ্বীনি শিক্ষা দেয়া হয়। যতদিন তিনি সুস্থ ছিলেন, যতদিন তিনি বিবাহ-শাদিতে ভূমিকা রাখতে পেরেছেন, ততোদিন তিনি এই কথাটা বলতেন।

এহসানুল হক : হজ সফরের স্মৃতি শুনতে চাই। প্রথম কবে গেলেন, কয়বার গেলেন?

শাইখুল হাদীসের সহধর্মীনী : হজ তো একসাথে অনেক বার করেছি। প্রথম হজ সফরের কথা মনে পড়ে। ১৯৮০ সনের কথা। সেই সফরে হজরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর সফরসঙ্গী ছিলাম আমরা। মক্কা ও মদিনা শরিফে আমরা এক বাসাতেই ছিলাম। খাবারের যে ব্যবস্থা ছিল সেগুলো হাফেজ্জী হুজুর রহ. খেতে পারতেন না। সেজন্য আমিই রান্না করতাম। মনে পড়ে, একদিন উটের গোশত রান্না করেছিলাম, হাফেজ্জী হুজুর খুব পছন্দ করেছিলেন।

তখন আমি মক্কা-মদিনায় নতুন ছিলাম। কিছুই চিনতাম না। তিনিই আমাকে হজের সব কাজ করিয়েছেন। আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগের কথা। তখন মক্কা মদিনার অবস্থা অন্য রকম ছিল। রাস্তা-ঘাট তেমন পাকাও ছিল না। হারাম শরিফের আশ পাশে এখনকার মতো এতো উঁচু দালান ছিল না।

সেই সফরের বিশেষ ঘটনা ছিল, সেখানেই আমি হজরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর কাছে বাইআত হয়েছিলাম। তোমাদের হুজুর হাফেজ্জী হুজুর এর পাগড়ির একটা অংশ আমাকে ধরিয়ে দেন। আরেকটা অংশ ছিল হাফেজ্জী হুজুরের হাতে। এভাবে হুজুর আমাকে প্রথমে তাওবা করান, এরপর সবক প্রদানের মাধ্যমে বাইআত করান। তিনি ঘরের মাস্তুরাতের জন্য এসলাহি সম্পর্ক রাখার প্রয়োজন বোধ করতেন। শুধু আমিই না, আমাদের মেয়েরাও হাফেজ্জী হুজুরের হাতে বাইআত হয়েছিল।

এহসানুল হক : শায়েখ রহ. তো রাজনীতিবিদও ছিলেন। বিভিন্ন সময় কঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তিনি কারাগারেও গিয়েছেন, এই সময়গুলো কেমন কাটতো?

শাইখুল হাদীসের সহধর্মীনী : খুব বেশি কথা মনে নাই। তিনি তো অনেক বার কারাগারে গিয়েছেন। কারাগারে থাকতে দেখাও করতে যেতাম। সর্বশেষ আওয়ামী লীগের আমলে যখন কারাগারে ছিলেন, তখন যে দেখা করতে গিয়েছিলাম সেদিনের কথা মনে আছে।

তিনি আমাকে মানসিক শক্তি অর্জনের জন্য নসিহত করতেন, বলতেন দুনিয়া থাকার জায়গা নয়। আমাদের সবাইকেই চলে যেতে হবে। যত দিন বেঁচে আছি, দীনের কাজ করতে হবে। আমাদের আকাবের উলামারা কি পরিমান কষ্ট করছেন, সেগুলো আমাদের শুনাতেন। আমাকে সব বলতেন, সব অবস্থায় নিজেকে মানায় নিতে।

এহসানুল হক : শায়েখের অর্বতমানে পরিবার কিভাবে চলবে, এ ধরনের কথা কখনো বলতেন?

শাইখুল হাদীসের সহধর্মীনী : মৃত্যুর চিন্তা সব সময়ই মাথায় থাকতো। তিনি বলতেন, আমি তো তোমার আগে দুনিয়া থেকে চলে যাবো, তুমি সবাইকে দেখে রাখবা। আমি তখন বলতাম, আপনি কি জানেন যে, আপনিই আগে যাবেন? তিনি বলতেন, না জানি না। তবে, আমি যেহেতু তোমার থেকে অনেক বড় তাই এটাই স্বাভাবিক যে, আমিই আগে যাবো। এরপর তুমি সবাইকে দেখে রাখবা। আমি দুনিয়াতে না থাকলে তুমিই সবাইকে দ্বীনের ওপর ধরে রাখবা। কেউ যাতে অন্য পথে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখবা।

আরএম/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ