শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৭ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১১ শাওয়াল ১৪৪৫


প্রসঙ্গ মিল্ক ব্যাংক, শারিয়াহ কী বলে

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতি ইউসুফ সুলতান ।।

বাংলাদেশের ঢাকা জেলার মাতুয়াইলের শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের (আইসিএমএইচ) এর উদ্যোগে সম্প্রতি মাতৃদুগ্ধ সংরক্ষণের জন্য ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। বিষয়টা নিয়ে জনমনে সংশয় তৈরি হয়েছে।

মূলত প্রিম্যাচিউর শিশু, বা জন্মের সময় যার ওজন কম ছিল বা শিশুর মা পর্যাপ্ত দুধ পাচ্ছেন না, সেক্ষেত্রে অন্য মায়ের দুধ শিশুর জন্য সহজপ্রাপ্য করাই এর মৌলিক উদ্দেশ্য। অনেক শিশু জন্মের সময় মা মারা যান, অনেক শিশুর বাবা/মা তাদের ফেলে রেখে যায় – তাদের জন্য মাতৃদুগ্ধের ব্যবস্থা করা কঠিন। অপর দিকে অনেকের শিশুকে দেয়া দুধ অতিরিক্ত হয়, যা নষ্ট হয়ে থাকে। এই উভয় পক্ষের মাঝে মধ্যস্থতা করতেই মিল্কব্যাংকের জন্ম।

গত শতাব্দীর মাঝামাঝি বিভিন্ন কৃত্রিম ফরমুলা দুধকে মাতৃদুগ্ধের বিকল্প মনে করা হলেও গবেষণা ও অভিজ্ঞতা বলছে, মাতৃদুগ্ধের কোনো বিকল্প আসলে নেই। শিশুর দৈহিক ও মানসিক গড়নে মাতৃদুগ্ধ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

২০০৫ সালে ওয়াশিংটনে একটি ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেসে ‘ইন্টারন্যাশনাল মিল্ক ব্যাংকিং ইনিশিয়েটিভ’ বা IMBI যাত্রা শুরু করে। IMBI হলো আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মিল্ক ব্যাংকের এসোসিয়েশন। IMBI -র তথ্য মতে ব্রাজিলে সবচেয়ে বেশি – ২১৭টি – মিল্ক ব্যাংক রয়েছে। এবং ১৯৮৫ এ তারা মিল্ক ব্যাংক চালুর পর থেকে শিশু মৃত্যুর হার কমেছে ৭৩%।

দুই.

নিজের শিশুকে দুধ পান করানোর পাশাপাশি অন্যের শিশুকে দুধ পান করানোকে ইসলাম সম্মানজনক দৃষ্টিতে দেখে। রাসূল স. এর জন্মের সময় আরবদের সংস্কৃতি ছিল দুগ্ধপানের জন্য দূরে কোথাও পাঠিয়ে দেয়। সে হিসেবেই হালিম সা’দিয়া রা. তায়েফ থেকে এসে রাসূল স. কে পান এবং তাঁর দুধমাতা হওয়ার সম্মান লাভ করেন।

এই দুধমাতার সম্পর্ককে ইসলাম এতটাই সম্মান দিয়েছে যে, পর্দা ও বিবাহের বিধানের ক্ষেত্রে দুধমাতাকে মায়ের আসনে রেখে দুধমায়ের স্বামী, সন্তান, নাতি-নাতনীকে আপন পরিবারের মর্যাদা দিয়েছে এবং তাদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক হারাম করেছে।

মিল্ক ব্যাংক যা করে তা হলো, বিভিন্ন মায়ের দুধকে একসঙ্গে করে বিভিন্ন প্রসেস করে সংরক্ষণ করে, যেন যাদের প্রয়োজন, তারা সহজেই তাদের শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় দুধ পেয়ে যান। পুরো ব্যাপারটাই ডোনেশন বা অনুদান মডেলের, এতে ক্রয়-বিক্রয়ের বিষয় নেই।

শারিয়াহর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এতে মোটা দাগে দুটো সমস্যা- 

১. দুধমাতা নির্ধারিত না হওয়ায় একজন শিশুর সঙ্গে অনেক মায়ের পারিবারিক সম্পর্ক স্থাপিত হতে পারে। এবং ভবিষ্যতে ওই মায়েদের সন্তানাদি/ভাই-বোন শিশুর জন্য বিবাহ হারাম হয়ে যাবে। যেহেতু সুনির্দিষ্টভাবে কোন কোন মায়ের দুধ আছে তা জানা নেই, কাজেই একটি বড় অংশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন হারাম হয়ে যাবে। ভবিষ্যতে না জেনে বিবাহ করে নিলে হারাম সম্পর্ক হতে পারে, নাউযুবিল্লাহ।

২. শুরুতে ডোনেশনভিত্তিক হলেও নিকট ভবিষ্যতে মাতৃদুগ্ধের বাণিজ্যিকীকরণের সম্ভাবনা রয়েছে। রক্ত, কিডনি, চোখ ইত্যাদির ক্ষেত্রে যা আমরা বর্তমানে দেখতে পারছি। ইতোমধ্যে লন্ডনে একবার মাতৃদুগ্ধের প্রোডাক্ট বাজারে এনে একটি প্রতিষ্ঠান নানা বিতর্কের সূচনা করেছে।

মিল্ক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার বিষয়টি শারিয়াহ স্কলারদের কাছে উত্থাপিত হয়েছে বেশ কিছুদিন আগে। ১৯৮৫ তে আন্তর্জাতিক ইসলামিক ফিকহ একাডেমী এ বিষয়ে বিষদ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, মিল্ক ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা এবং এর থেকে শিশুর জন্য দুধ নেয়া জায়েজ নেই। তবে একই আলোচনায় ড. ইউসুফ কারাদাভীসহ কিছু স্কলার এটাকে জায়েজ বলেন, এবং অন্য কিছু স্কলার একে শর্তসাপেক্ষে জায়েজ বলেন।

মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে কেবল কুয়েতে মিল্ক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার কথা IMBI উল্লেখ করলেও এর প্রমাণ খুঁজে পাইনি। মালয়েশিয়াতে এটা আলোচনা হয়েছে, তবে ধর্মীয় বোর্ডগুলোর আপত্তির মুখে তা করা যায় নি। যেটা আছে তা হলো কিছু ফেইসবুক গ্রুপ, যেখানে ব্লাড ডোনারের মতো হিউম্যান মিল্ক ডোনারদের তালিকা রয়েছে। যাদের প্রয়োজন তারা গ্রুপের মাধ্যমে তাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারেন।

তিন.

মিল্ক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পেছনে প্রয়োজনটি একটি স্বীকৃত প্রয়োজন, তবে পদ্ধতিটি বিপদজনক, এতে ভবিষ্যতের লাখো সন্তান হারামে পতিত হতে পারেন। এক্ষেত্রে গবেষণার পর যে পদ্ধতিটির পরামর্শ দেবো, তা হলো:

১. ব্লকচেইন বা আধুনিক টেকনোলজির অ্যাপের মাধ্যমে মিল্ক ডোনারদের রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা করা। কেউ ডোনেট করতে চাইলে রেজিস্ট্রেশন করতে পারবেন এবং তার প্রাইভেসির সর্বোচ্চ সুরক্ষা দেয়া হবে। এতে তার বেসিক তথ্য সংগৃহীত থাকবে, যা জাতীয় পরিচয়পত্রের ডাটাবেইজের সাথে লিংক থাকবে।

২. যারা শিশুর জন্য দুধ নিতে চান এবং অন্য সকল উপায় চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন, তারা এই একই অ্যাপের মাধ্যমে রিকোয়েস্ট পাঠাতে পারবেন।

৩. মিল্ক ব্যাংক প্রতিষ্ঠান উভয়ের মধ্যে ম্যাচ করে দুধ সংগ্রহ, প্রসেসিং ও পৌঁছানোর ব্যবস্থা করবে।

৪. দুধ সংগ্রহ ও প্রসেসিংয়ের ক্ষেত্রে একজনের দুধকে অপরজনের দুধের সাথে মেশানো হবে না। এবং প্রত্যেক বোতলে নম্বর থাকবে, যা দিয়ে ডোনারকে ট্রেস করা যাবে।

৫. দুধ পৌঁছানোর পর ডোনার ও শিশু উভয়ের পরিবারকে সার্টিফিকেট দেয়া হবে, যাতে উভয়ের পরিচয় ও বংশ থাকবে। এটা ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।

৬. উল্লিখিত তথ্য ও ডাটাবেইজ জাতীয় পরিচয়পত্রের ডাটাবেইজের সাথে লিংক করা থাকবে। একই তথ্য কাজী অফিসের কাছেও থাকবে, যা কাজী সাহেব বিয়ের রেজিস্ট্রির সময় ভেরিফাই করবেন।

আমরা বিশ্বাস করি, টেকনোলজির মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। অন্যের শিশুকে দুগ্ধদান একটি মহত কাজ, তবে এই মিল্কব্যাংকের প্রক্রিয়াটি সমস্যাসংকুল, যার সমাধান টেকনোলজি করতে পারে।

এই পদ্ধতি বা টেকনোলজির নির্মাণ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা এবং এ বিষয়ে সুস্পষ্ট নীতিমালা বা আইন প্রণয়নের আগ পর্যন্ত মা’দেরকে নিজ পরিবার ও আত্মীয়-স্বজন থেকে দুধ খোঁজার আহ্বান জানাতে হবে। বা ব্লাড গ্রুপের মতো বিভিন্ন মিল্ক ডোনার গ্রুপও করা যেতে পারে, যদিও সেক্ষেত্রে ডোনারদের প্রাইভেসি নিয়ে আমরা শঙ্কিত।

বর্তমান অবস্থায় সকলের বা একাধিক মায়ের দুধ একসঙ্গে মিশিয়ে প্রক্রিয়া ও বোতলজাত করার এ পদ্ধতি কোনোভাবে জায়েজ নেই। এবং আমাদেরকে এ থেকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে।

লেখক : পিএইচডি গবেষক, মালয়েশিয়া।

আরএম/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ