বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ ।। ১৪ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৮ রমজান ১৪৪৫


হেলিকপ্টার হুজুরদের রমরমা ব্যবসা; অবহেলিত মাদরাসা শিক্ষকরা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাওলানা সুফিয়ান ফারাবী
লেখক ও সিনিয়র মুদাররিস-জামিয়া মাহমুদিয়া সাভার

সেদিন আমাদের মাদরাসার মাহফিলের জন্য আলোচিত কোন এক বক্তাকে নিমন্ত্রণ জানাতে গেলাম। তিনি আমাদের বেশ ভালো মেহমানদারী করালেন। নাস্তার টেবিলে বসে গল্প জমিয়ে ফেললেন। একের পর এক ভ্রমণ-কিচ্ছা শোনালেন। তার আতিথিয়তায় ও আন্তরিকতায় আমি ও আমার মাদরাসার মুহতামিম মুগ্ধ হলাম।

নাস্তার টেবিল থেকে উঠে বৈঠকখানায় মাহফিল বিষয়ক আলোচনা তুললাম। ‘মাদরাসা কোন জামাত পর্যন্ত, গতবছর মাহফিলে কোন বক্তা এসেছিলেন, মাহফিলে জনসমাগম কেমন হয়, মাহফিল করতে এ যাবত কোন বাধার সম্মুখীন হয়েছি কিনা...?’ আমাকে এসব প্রশ্ন করলেন তিনি।

তার এসব প্রশ্নের জবাবে বললাম, ‘আমাদের মাদরাসা মেশকাত জামাত পর্যন্ত, গতবছর এসেছিলেন মাওলানা আব্দুল খালেক শরিয়তপুরী, এর আগে মাহফিল করতে কোনরকম বাধার আসেনি। আলহামদুলিল্লাহ! জনসমাগমও বেশ ভালোই হয়, বিশাল বড় মাঠের পুরো অংশ পূর্ণ হয়ে যায় কানায় কানায়।’

বক্তা সাহেব খুশি হলেন। আর বললেন, ‘দেখুন, মাফ করবেন। এ বছর আমার ডায়েরি খালি নেই। আপনারা ছ'মাস আগে যোগাযোগ করলে কিছু একটা করতে পারতাম। তবে আগামী ১৬ ডিসেম্বর আমার একটা প্রোগ্রাম ক্যানসেল হয়েছে। আপনারা চাইলে সেদিন করতে পারেন। আর রাস্তার খরচের বিষয়ে আমার খাদেমের সঙ্গে কথা বলবেন।’

আমি বললাম, ‘আলহামদুলিল্লাহ! আশা করছি ১৬ ডিসেম্বর আমরা মাহফিল করতে পারব। সাভারের মাটিতে সবচেয়ে বেশি জনসমাগম হবে’।

তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে। আমি ডায়েরিতে লিখে রাখছি। আপনারা খাদেমের সাথে বলে যাবেন।’

বক্তা সাহেবের কামরা থেকে বের হয়ে আমরা দু'জন খাদেমের কাছে গেলাম। বললাম, ‘ভাইজান হুজুরের সঙ্গে কথা হয়েছে। ১৬ ডিসেম্বর তিনি তারিখ দিয়েছেন। আপনার সঙ্গে কথা বলে ফাইনাল করতে বলেছেন।’

খাদেম সাহেব বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি কনফার্ম করছি। তো, এডভান্স কত দিতে চাচ্ছেন?’

আমি মিনতি করলাম, আসলে আমাদের মাদরাসা আর্থিকভাবে দুর্বল। অ্যাডভান্স খুব বেশি দিতে পারব না। এই বলে পকেট থেকে ৫ হাজার টাকা বের করে খাদেমের হাতে দিলাম। ‌তিনি বিরস মুখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ!

তারপর বললেন, ‘সাধারণত হুজুর হেলিকপ্টার ছাড়া প্রোগ্রামে যান না। প্রতিদিন দুই-তিনটা মাহফিল করেন। প্রতিটা মাহফিল কর্তৃপক্ষ হেলিকপ্টার পাঠিয়ে দেন। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর মাহফিল একটা। তাই হেলিকপ্টার প্রয়োজন নেই। এই অতিরিক্ত ভাড়ার টাকা কিন্তু আপনাদের গুনতে হচ্ছে না। হুজুরকে ৫ হাজার টাকা এডভান্স দেওয়া অপমান করার মতই। ৬০-৭০ হাজার টাকা এডভান্স দিয়েও হুজুরের প্রোগ্রাম পান না অনেকে। অথচ আপনারা ৫০০০ টাকা দিতে চাচ্ছেন!’

আচ্ছা হুজুর যখন তারিখ দিয়েই ফেলেছেন, আমি আর না করি কিভাবে? আপনারা একটা কাজ করেন, আপাতত অ্যাডভান্স পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে যান। আর ৫০ হাজার টাকা দিবেন স্টেজে ওঠার আগে।

আমি ও আমার প্রিন্সিপাল মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। বলে কী এই লোক! এক লক্ষ টাকা দিতে হবে একজন বক্তাকে! সরকারি ফাস্ট ক্লাস কর্মকর্তাও তো এক লক্ষ টাকা স্যালারি পান না। অথচ তার এক রাতের চাহিদা এক লক্ষ টাকা!

আমার প্রিন্সিপাল বললেন, সুফিয়ান ভাই, চলেন মাদরাসায় ফিরে যাই। আমার দ্বারা এক লক্ষ টাকা দিয়ে বক্তা নেয়া সম্ভব না। এই বলে তিনি তৎক্ষনাৎ বেরিয়ে পড়লেন। আমিও তার পেছনে পেছনে বেরিয়ে গেলাম।

মাদরাসায় এসে রাতে শোবার সময় ভাবলাম, হায়রে দুনিয়া! ওয়াজ মাহফিল করে একজন বক্তা হেলিকপ্টারে চড়ে এক রাতে এক লক্ষ টাকা ইনকাম করেন। এক থেকে দেড় ঘন্টা ওয়াজ করে তার মাসিক ইনকাম প্রায় ৩০ লক্ষ টাকা।

অথচ আমি মাদরাসায় হিদায়া, নুরুল আনওয়ার, মাকামাতে হারীরীসহ আরো চারটি ক্লাস নেই। নিয়মিত সকাল আটটা থেকে দুপুর বারোটা পর্যন্ত মাদরাসায় সময় দেই, অথচ আমাদের বেতন মাত্র ছয় হাজার টাকা। তাও আবার ছয় মাসের মধ্যে পাঁচ মাসের বেতন বাকি পড়ে আছে!

হঠাৎ এ সম্পর্কিত একটি আরবি কবিতা মনে পড়ল। উচ্চমাধ্যমিকের প্রথম বছর পড়েছিলাম। কবিতাটি হল-

كم عاقل عاقل أعيت مذاهبه: وجاهل جاهل تلقاه مرزوقا
هذا الذي ترك الأوهام حائرة: وصير العالم النحرير زنديقا

কবিতাটির বাংলা অনুবাদ এরকম দাঁড়ায়-

'অনেক বড় বড় বিচক্ষণ ব্যাক্তি আছেন, যাদেরকে তাদের জীবিকা উপার্জনের উপায় পরিশ্রান্ত ও অস্থির করে তোলে। আর কত গণ্ড-মূর্খ আছে; যারা অত্যন্ত সুখে রিজিক (জীবিকা) উপভোগ করে।'

'এ বিষয়টি জ্ঞান বুদ্ধি বা চিন্তাশক্তিকে হয়রান করে ফেলেছে। এবং অনেক বিজ্ঞ আলেমকে বে-দিন বানিয়ে ফেলছে।'

ওয়াজ মাহফিলের গুরুত্ব কম নয়। তবে নিঃসন্দেহে এরচেয়ে শতভাগ গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় কাজ হচ্ছে দরস ও তাদরীস। অর্থাৎ ধর্মীয় জ্ঞান শিক্ষাদান। শিক্ষকদের মাধ্যমে আগামী দিনে শত শত আলেম তৈরি হচ্ছে। দিনের দাঈ তৈরি হচ্ছে। অথচ মানবেতর জীবন যাপন করছি আমরা। এক কথায় বলতে গেলে মানবেতর জীবন-যাপনের পাশাপাশি অবহেলিত দেশের কওমি মাদরাসার শিক্ষকবৃন্দ।

কওমি মাদরাসার শীর্ষ মুরব্বিদের পাশাপাশি বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট আকুল আবেদন থাকবে- দয়া করে আপনারা মাদরাসা শিক্ষকদের সঠিক মূল্যায়ন করুন। সরকারিভাবে বা শীর্ষ ওলামায়ে কেরামের মাধ্যমে কওমি মাদরাসার শিক্ষকদের নির্ধারিত বেতন ধার্য করুন।

আরএম/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ