ওমর আলফারুক।।
ভারত কর্তৃক কাশ্মীর অবরোধ কেবল মাত্র অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ইস্যু নয়। এ অবরোধের মধ্য দিয়ে তছনছ হয়ে গেছে গোটা কাশ্মীরের জনগণের প্রাত্যহিক জীবন। অসংখ্য পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম মানুষটিও খুব অসহায়ভাবে বেকার হয়ে বসে আছেন।
মুনিবুল ইসলামও তেমনই একজন। পেশায় তিনি ছিলেন ফটো সাংবাদিক। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। অবরোধের কারণে তার কার্যক্রম পরিচালনার সব রাস্তাই বন্ধ হয়ে যায়।
কী করবেন ভেবে না পেয়ে একটি দোকানে স্যালস ম্যানের কাজ শরু করেন। অবরোধের মুখে সেটিও আলোর মুখ দেখেনি। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের কাছে ধার-কর্জ কারার মতো অবস্থাও আর বাকী নেই।
পরিবারের প্রাত্যহিক খরচ জোগাড় করাই অসম্ভব হয়ে ওঠছে। তার ওপর তার স্ত্রী গর্ভবতী। তার চিকিৎসা বাবদ অনেক টাকার প্রয়োজন। এলাকায় কাজও নাই তেমন।
তাই পরিবারের কাউকে না জানিয়ে জীবিকার সন্ধানে অনন্তনাগ জেলায় চলে যান মুনিব। সেখানে তিনি একটি নির্মাণাধীন ভবনে ইট বহনের কাজ শরু করেন। সেখানে বেশকিছু দিন কাজ করে উপার্জিত অর্থ দিয়ে তার স্ত্রীর চিকিৎসা করান।
কিছু দিন পর তার ফটো দিয়ে একটি স্থানীয় ম্যাগাজিন প্রচ্ছদ করে। যেখানে তাকে একটি বিল্ডিংয়ে ইট বহনের কাজ করতে দেখা যায়। মুনিবের মতো একজন হাইপ্রোফাইল ফটো জার্নালিস্টের ‘লেবারের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ’র মতো করুণ কভার স্টোরি আর কী হতে পারে? গেল চার বছর যাবত তিনি দক্ষিণ কাশ্মীরে ফটো সাংবাদিকতার দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়ে আসছেন। ভারতীয় সৈন্য এবং স্বাধীনতাকামী কাশ্মীরিদের ডজনোর্ধ্ব বন্দুক যুদ্ধের ডকুমেন্টারি করেছেন তিনি। তার কাজ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে।
কিন্তু ভারতীয় আগ্রাসন অগণিত মুনিবের স্বপ্নের দুনিয়া -যাকে বলে- একেবারেই তছনছ করে দিয়েছে। অবরোধ, অর্থনৈতিক মান্দা, অধিকার হরণ, মানবতা বিরোধী আগ্রাসনসহ সীমাহীন অত্যচারে জর্জরিত কাশ্মীরের আজাদি প্রিয় মানুষ। এমনকি ইন্টারনেট এবং মোবাইল সেবা পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সাংবাদকিদের এক্টিভিটিজ। সঙ্গত কারণে কর্মহীন হয়ে পড়েছে মুনিবদের মতো বিপুল সম্ভাবনাময় তরুণ।
অবরোধ পরবর্তী সময়ে মুনিব কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ইন্টারনেট না থাকায় বহু মানুষের জীবকিা নির্বাহ ব্যাহত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হয়েছেন সাংবাদিকগণ।
মুনিবের এক বন্ধু গত সাত বছর যাবত দিল্লি ভিত্তিক একটি দৈনিকে নিয়মিত লিখে আসছিলেন। ইন্টরনেটহীন এই দিনগুলোতে তাকেও করতে হয়েছে লেবারের কাজ। ভাগ্য ভালো তখন ছিলো আপেলের মৌসুম। তার মামা তাকে আপেল বাক্সবন্দি করতে বললে গত্যান্তর না দেখে কাজে লেগে পড়েন এই সাংবাদিক।
মুনিবের আরেক প্রতিবেশী দিল্লির একটি প্রকাশনা সংস্থার কাশ্মীর অঞ্চলের দায়িত্বে ছিলেন গেলো পাঁচ বছর। ইন্টারনেট না থাকায় তিনি কোন স্টোরি পাঠাতে পারেননি। উপায়ান্তর না দেখে তিনি একটি ছোট প্রিন্টের দোকান খোলে বসেন। কিন্তু এতেও তেমন লাভ হয়নি তার। মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে না পারা মানুষদের পক্ষে এসব প্রিন্ট-ট্রিন্ট অযাচিত বিলাসিতাই।
অন্যান্য ফটোসাংবাদিকদের মধ্য থেকে কেউ কাজ করেছেন ফার্মিসিতে, কেউ করেছেন নিজের ভায়ের ব্যবসায় সহযোগিতা।
মোটের ওপর এই দুর্বিষহ সময়ে সকল সাংবাদিকই নিজেদের পেশার বিকল্প খোঁজতে বাধ্য হয়েছে। ইন্টারনেট ফিরে না এলে সবাই সাধের এই পেশা চিরতরেই খুয়ে বসত।
মুনিব কখনোই সাংবাদিকতা ছাড়তে চাননি। বহু সাধনার বিপরীতে এ অঙ্গনে নিজের একটা অবস্থান তৈরি করেছেন তিনি। কাশ্মীরের মিডিয়াতেও তিনি পরিচিত হয়ে ওঠছিলেন ধীরে ধীরে। কিন্তু এ কঠিন সময়ের পর তাকেও বিকল্প কিছু ভাবতে হচ্ছে।
খুব সীমিত পরিসরে কাশ্মীরে ইন্টারনেট সেবা চালু হয়েছে। মোবাইল ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়া এখনও মোটাদাগে বন্ধই আছে। মুনিব এবং তার মতোদের ক্যারিয়ার সঙ্গত কারণেই এখনও হুমকির মুখে।
সূত্র: টিআরটি ওয়ার্ল্ড থেকে ওমর আলফারুকের অনুবাদ
-এটি