বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১১ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫


কারি সিদ্দিক আল মিনশাবি: বেঁচে আছেন লক্ষ হাফেজের হৃদয়ে

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

বেলায়েত হুসাইন ।।

কারি সিদ্দিক আল-মিনশাবি। তেলাওয়াতের মাধ্যমে লক্ষ মানুষের অন্তরে স্থান করে নেওয়া কুরআনের এক মহান খাদেম তিনি। আজ থেকে প্রায় একশ’ বছর আগে ১৯১৯ মতান্তরে ১৯২০ সালের ২০ জানুয়ারি মহান এই মনীষী মিসরের রাজধানী কায়রোর দক্ষিণ দিকে অবস্থিত সাওহাজ জেলার অন্তর্গত মিনশাহ এলাকার বাওয়ারেক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ৮ বছর বয়সেই পবিতহ্র কুরআনুল কারীমের হিফজ সম্পন্ন করেন।

হিফজ সমাপ্ত করে উলুমুল কুরআন বিষয়ে পারদর্শিতা অর্জনের জন্য কারি মিনশাবি কায়রোর আল-আজহারে গমন করেন। ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিলো বলে তৎকালীন জগদ্বিখ্যাত দুই আলেম- শায়েখ মুহাম্মদ আবুল আলা এবং শায়েখ মুহাম্মদ সায়ুদীকে উস্তাদ হিসেবে পেয়ে যান এবং উভয়ের সান্নিধ্যে থেকে উলুমুল কোরআনে পান্ডিত্য অর্জন করেন।

অল্পদিনেই কারি সিদ্দিক আল-মিনশাবির সুনাম-সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর সর্বত্র। যদিও নাম-যশ-খ্যাতির কোন লোভ ছিলো না ক্বারী সাহেবের বরং নিভৃতে কোরআনের খেদমত করে জীবন পার করে দেয়াই ছিলো তার আমৃত্যু ভাবনা।

লৌকিকতা বিবর্জিত অতি সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। একবারের ঘটনা-তৎকালীন মিসরের প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দুন নাসিরের নিকট তার শুহরত পৌঁছলে সরকারী এক অনুষ্ঠানে তেলাওয়াত করার জন্য তিনি ক্বারী মিনশাবীকেই পছন্দ করলেন এবং ভাবলেন জোরজবরদস্তি করে হলেও ক্বারী সাহেবকে তার চাই-ই চাই। এজন্য এক মন্ত্রীকে পাঠালেন ক্বারী সাহেবের কাছে।

মন্ত্রী এসে বললেন, অনেক বড় মর্যাদা আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। সুযোগ এসেছে প্রেসিডেন্টের সামনে কুরআনুল কারীম তেলাওয়াত করার।

এ কথা শোনামাত্র তিনি রাগতস্বরে জবাব দিলেন, এটা কি খোদ প্রেসিডেন্ট আব্দুন নাসিরের জন্য সৌভাগ্য নয় যে, সে ক্বারী সিদ্দিক আল-মিনশাবীর কণ্ঠে কুরআন তেলাওয়াত শুনবেন?

সিদ্দিক আল-মিনশাবীর জীবনের মূল দর্শন ছিলো- ‘ক্বারীয়ুল কুরআন লা ইয়ুহানু’ অর্থাৎ কুরআনুল কারীমের কারি কখনো অপদস্ত হবে না।

আরেকবার মিসরের রাষ্ট্রীয় রেডিও তাকে একটি ইন্টার্ভিউ এর জন্য স্টুডিওতে আমন্ত্রণ জানায়। সেখানে যেতেও তিনি অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, আমি রেডিওতে পড়তে চাই না। যশ-খ্যাতির কোন লোভ নেই আমার। আমি চাই না, শুধু আমার জন্য রেডিও কর্তৃপক্ষ কোন প্রোগ্রামের আয়োজন করুক।

এভাবেই কারি সিদ্দিক আল-মিনশাবি রহ. আত্মমর্যাদাকে বলি না দিয়ে মৃত্যু অবধি নিজ আদর্শের উপর অবিচল থাকেন।

এ ঘটনার বেশ কিছুদিন পর মিসরের জাতীয় বেতার ভবন কারি সিদ্দিক আল-মিনশাবির ৩০ পারা কুরআন তেলাওয়াত রেকর্ড করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বেতারের মহাপরিচালক তার নিকট দূত মারফত একটি অনুরোধপত্র প্রেরণ করেন।

অনুরোধপত্রে তিনি লেখেন, এ বছর পবিত্র রমজানে ঘরে বসে আপনি যে তিলাওয়াত করবেন, আমরা তা রেকর্ড করতে চাই। অগত্যা কারি সাহেব সম্মত হলেন। মাসব্যাপী রেকর্ড করা হলো ৩০ পারা পবিত্র কুরআনুল কারীম। যার মসাধ্যমে আজ শুধু মিসর নয় বরং গোটা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে আহলুল কুরআন, কুরআনের অগণিত শিক্ষার্থী ও হাফেজগণ প্রতিনিয়ত উপকৃত হচ্ছে।

বিশেষত, বাংলাদেশে কারি সিদ্দিক আল-মিনশাবীর আলাদা কদর লক্ষ্য করা যায়। তার সুমধুর ও মনকাড়া তেলাওয়াত মুগ্ধ করে সবাইকে। ছুঁয়ে যায় হৃদয়টাকে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, তার তেলাওয়াতের মূল বৈশিষ্ট্য ছিলো- মাখরাজের পূর্ণ অনুস্মরণ, স্পষ্ট উচ্চারণ ও খোলা আওয়াজ। এই অনন্য গুণগুলোর কারণেই তিনি সর্বজনপ্রিয় ও বিশ্ববিখ্যাত হতে পেরেছিলেন।

তৎকালীন কুরআনুল কারীমের বিশিষ্ট আলেম মুহাম্মদ মুতাওয়াল্লি বলতেন, কেউ যদি খুশুখুজুর সাথে কোরআন তেলাওয়াত শুনতে চায়,সে যেন সিদ্দিক আল-মিনশাবির তেলাওয়াত শ্রবণ করে এবং মিনশাবি ও তার ৪ বন্ধু (১, মাহমুদ খলিল ২, মুস্তফা ইসমাইল ৩,আবুল বাসেত আব্দুস সামাদ ৪, মাহমুদ আলি আল-বান্না) এমন একটি কিশতীতে আরোহণ করেছেন এবং এমন মহাসমুদ্রে কিশতীর পাল তুলেছেন যার কোন কিনারা নাই। কেয়ামত পর্যন্ত এই কিশতী ভাসতে থাকবে আর মানুষ এর দ্বারা উপকৃত হতে থাকবে চিরকাল।

বহির্বিশ্ব যখন সিদ্দিক আল-মিনশাবীর বিষ্ময়কর প্রতিভার কথা জানতে পারে, তখন আর তার পক্ষে ঘরে থাকা সম্ভব হয়নি। পৃথিবীর বিভিন্নপ্রান্ত থেকে বড় বড় সেমিনারে তেলাওয়াতের আমন্ত্রণ আসতে থাকে। তিনি সেই আমন্ত্রণ কে সাদরে গ্রহণ করেন এবং পবিত্র শহর আল-কুদসের আল-আকসা, কুয়েত, লিবিয়া, আলজেরিয়া, ইরাক, সৌদি আরব এবং বৃটেনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কুরআন তেলাওয়াত করেন।

সিরিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া কারি মিনশাবিকে বিশেষ সম্মাননা স্মারক প্রদান করে। আল্লাহর মহান এ বান্দা সর্বদা সাদাসিধে জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। দুই জন স্ত্রী ও সর্বোমোট ৮ জন পুত্র ও ৪ জন কন্যা সন্তান নিয়েই ছিলো কারি মিনশাবির সুখের সংসার। ১৯৬৬ সালে তার কণ্ঠনালীতে ইসোপাজিয়াল ভাইরাস (টিউমার জাতীয় ব্যাধি) ধরা পড়ে। তবুও তিনি নিবৃত হননি কুরআনের তেলাওয়াত থেকে।

১৯৬৯ সালের ২০ এপ্রিল কুরআনের এই মহান খাদেম পার্থিব মোহ-মায়া ত্যাগ করে মহান প্রভুর সান্নিধ্যে গমন করেন। মৃত্যুর পর মিসর তাকে প্রথম শ্রেণীর জাতীয় পন্ডিত এবং শাস্ত্রকার হিসেবে ঘোষণা করে।

কারি সিদ্দীক আল-মিনশাবি মৃত্যুবরণ করলেও তার অনিন্দ্য সুন্দর তেলাওয়াত আজও বাজে পৃথিবীর দিকে দিকে। অসংখ্য কোরআন-প্রেমিকের তেলাওয়াতের মাধ্যমে তিনি বেঁচে আছেন কোটি কোটি হাফেজের হৃদয়ে।

সূত্রঃ আল-জাজিরা

আরএম/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ