শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


মুকুটহীন বাদশার ঈর্ষণীয় বিদায়

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

জহির উদ্দিন বাবর ।।

জীবনের নিয়তিই চলে যাওয়া। পৃথিবীর শুরু থেকে এই চলে যাওয়ার মিছিল অব্যাহত আছে। তবে কিছু কিছু চলে যাওয়া দাগ কেটে যায় সবার অন্তরে। সৃষ্টি করে গভীর এক শূন্যতা যা কোনোভাবেই পূরণ হওয়ার নয়। গত ২৯ জানুয়ারি ২০২০ এমনই একজনের চলে যাওয়া আমরা দেখলাম যে চলে যাওয়া ক্ষত সৃষ্টি করেছে কোটি হৃদয়ে। অশ্রু ঝরিয়েছে অগণিত চোখে। নীরব কান্নায় ভাসিয়েছে আপন-পর সবাইকে।

হ্যাঁ, বলছিলাম হজরতুল আল্লামা আযহার আলী আনোয়ার শাহ রহ.-এর কথা। তিনি মানুষের কতটা প্রিয় ছিলেন সেটা জীবদ্দশায় তেমন টের না পেলেও চলে যাওয়ার পর পুরোপুরিই টের পাওয়া গেছে। মুকুটহীন এই বাদশার ঈর্ষণীয় বিদায় দেখে অগণিত হৃদয়ে সুপ্ত তামান্না জেগেছে, আহ! আমার বিদায়টিও যদি এমন হতো!

সবার প্রিয় শাহ সাহেব হুজুরের বিদায়ী দৃশ্যটি কেমন ছিল সেটা শোকাহত সেই মিছিলে যারা শরিক হয়েছিলেন তারা ভালো বলতে পারবেন। আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে দেশ-বিদেশের অনেকেই সেই দৃশ্য কিছুটা হলেও দেখেছেন। ছোট্ট শহর কিশোরগঞ্জ সেদিন ভারী শোকে কাতর হয়ে পড়েছিল। ইতঃপূর্বে কখনও কিশোরগঞ্জ এতোটা শোকাহত হয়েছে বলে মনে পড়ে না। দেশের নানা প্রান্ত থেকে সেদিন ছুটে এসেছিলেন লাখো জনতা তাদের প্রিয় মানুষটিকে শেষ বিদায় জানাতে।

গভীর রাতে তাঁর লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সটি যখন প্রিয় অঙ্গন জামিয়া ইমদাদিয়ার গেইট দিয়ে ঢুকছিল তখন সেখানকার কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে আকাশ-বাতাস। কনকনে শীত উপেক্ষা করে শহরের হাজারও মানুষ ভিড় করেন শেষবারের মতো প্রিয় শাহ সাহেব হুজুরকে একবার দেখতে। আর মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের হৃদয়ভাঙা আকুতি কেমন ছিল সেটা প্রকাশ করার মতো ভাষা নেই।

ঐতিহাসিক শোলাকিয়ার ময়দানে লাখ লাখ জনতার শোক ও কান্নার মিছিল ছিল সবচেয়ে বেদনার দৃশ্য। কারও বিদায়ী যাত্রায় এতো মানুষের সমাগম এর আগে কিশোরগঞ্জবাসী দেখেনি। দেশের ইতিহাসে এতো বড় জানাজা খুব কমই হয়েছে।

শোলাকিয়ায় ঈদের জামাতে যত লোক হয় এর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি ছিল সেদিনের উপস্থিতি। শেষ পর্যন্ত জানাজায় কাতারের মাঝখানে কোনো জায়গা ফাঁকা না রেখে চাপাচাপি করে দাঁড়াতে হয় সবাইকে। এরপরও ইমামের সামনে হাজার হাজার লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। এই ভিড় সামাল দিতে স্থানীয় প্রশাসনকে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়েছে।

দেশের শীর্ষ পর্যায়ের আলেম-উলামার সিংহভাগ সেদিন ছুটে গিয়েছিলেন ঐতিহাসিক শোলাকিয়া মাঠে। সবার চোখে-মুখে ছিল অতি আপনজন হারানোর অভিব্যক্তি। জানাজাপূর্ব সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে সেটা অনুভব করা গেছে। শাহ সাহেব হুজুর দেশের আলেম-উলামা, বিশেষ করে কিশোরগঞ্জবাসীর জন্য কত বড় নেয়ামত ছিলেন সবার বক্তব্যে উঠে আসে সেই অভিব্যক্তি। তাঁর শূন্যতা পূরণ হওয়ার মতো নয় এমনটাই ছিল সবার বক্তব্যের সারসংক্ষেপ। রত্নতুল্য এই মানুষটিকে হারানোর আক্ষেপ ছিল সবার কণ্ঠে।

দুই.

শাহ সাহেব হুজুর ছিলেন তাঁর ছাত্রদের কাছে স্বপ্নপুরুষ, সবচেয়ে বড় হিরো। ছোটবেলা থেকে বড় আলেম বলতে আমরা তাঁকেই দেখে এসেছি। বড় হয়ে তাঁর মতো হবো-এমন একটা সুপ্ত বাসনা প্রতিটি ছাত্রের মধ্যে কাজ করতো। এজন্য শাহ সাহেবের কথাবার্তা, চলন-বলন, অঙ্গভঙ্গি সবকিছুই তাঁর ছাত্ররা অনুসরণ-অনুকরণ করার চেষ্টা করতো।

তিনি ছিলেন একজন কেতাদুরস্ত সৌখিন মানুষ। মাড় দেয়া সুতি কাপড়ের সাদা পাঞ্জাবি পরতেন। সামান্য কুচকে যাওয়া পাঞ্জাবি তাঁর গায়ে কোনোদিন দেখিনি। লুঙ্গি পরে বাসা থেকে বেরিয়েছেন এমন দৃশ্য দেখেছি বলে মনে পড়ে না। মেহেদিযুক্ত চুল-দাড়ি ছিল বেশ আকর্ষণীয়। তাঁর পান খাওয়ার দৃশ্যটাও ছিল বেশ চমৎকার। এতোটা আর্ট করে কথা বলতে খুব মানুষকে দেখেছি। তাঁর হাঁটার ভঙ্গিতেই ছিল একটা শাহি ভাব।

নিজের গাড়ি ছিল, তবে বেশির ভাগ সময়ই শহরের রথকলার বাসা থেকে জামিয়া ইমদাদিয়া কিংবা শহীদি মসজিদে আসতেন রিকশায় করে। ছোট্ট শহরের ব্যস্ততম এলাকা দিয়ে রিকশায় করে যখন তিনি আসা-যাওয়া করতেন তখন মানুষ শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে তাঁকেই দেখত। হাজারো মানুষের মধ্যে তাঁকে মনে হতো ব্যতিক্রমী কেউ। ব্যক্তিত্বে ভরা নূরানি চেহারাটি সবার দৃষ্টি কাড়ত।

যারা জীবনে কোনোদিন তাঁকে দেখেনি, তাঁকে চিনেন না তারাও ভক্তিতে গদগদ হয়ে তাঁর প্রতি সালাম বর্ষণ করতো। তাঁর আসা-যাওয়ার দৃশ্যটি যারা দেখেছেন তারা জানেন, মনে হতো কোনো রাজা-বাদশা কিশোরগঞ্জ শহর পেরোচ্ছেন। আর সবাই মুগ্ধ হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। এমন শানদার ও ঈর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী আলেম আমাদের সমাজে সচরাচর চোখে পড়ে না।

জামিয়া ইমদাদিয়ার গেইট দিয়ে তিনি ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে পুরো ক্যাম্পাসের দৃশ্যপট পাল্টে যেত। তিনি কাউকে ধমক দিতেন না, শাসাতেন না, তবুও তাঁর উপস্থিতিটাই সবকিছু পাল্টে দিতো। ছাত্র-শিক্ষক সবাই নিজ নিজ কর্তব্যে মনোযোগী হতে যেতেন।

তাঁর মধ্যে রু’ব বা শ্রদ্ধামিশ্রিত এমন একটা ভয় ছিল যা সবাইকে সমানভাবে ছুঁয়ে যেতো। দরস চলাকালে তিনি মাঝে মাঝে পরিদর্শনে বের হতেন। বিশাল বিল্ডিংয়ের এক প্রান্ত দিয়ে তিনি হাঁটা শুরু করলে সব ক্লাসে খবর হয়ে যেতো শাহ সাহেব হুজুর আসছেন। সত্যিকারের একজন মুহতামিম বা প্রিন্সিপাল ছিলেন তিনি। তাঁর মতো এতোটা প্রভাবশালী কোনো মুহতামিম আমার চোখে পড়েনি।

অত্যন্ত রুচিশীল একজন মানুষ ছিলেন। তাঁর সবকিছুতেই রুচির একটা ছাপ ছিল। ব্যক্তিগতভাবে যেমন একজন রুচিবান, সুশৃঙ্খল, পরিপাটি মানুষ ছিলেন চাইতেন সবখানেই যেন এটা ফুটে ওঠে। এজন্য তাঁর পরিচালনাধীন জামিয়া ইমদাদিয়া ও শহীদি মসজিদসহ সব প্রতিষ্ঠানে যে কেউ একটা রুচি-বৈচিত্র্যের ছাপ অনুভব করবেন।

বিশৃঙ্খলা তিনি একদম পছন্দ করতেন না। ছাত্রদের উদ্দেশে নসিহতকালে শৃঙ্খলাবোধের প্রতি বেশি জোর দিতেন। দেশ-বিদেশে যেখানে যেতেন ভালো কিছু দেখলে সেটা নিজের প্রতিষ্ঠানেও কার্যকর করার একটা চেষ্টা থাকত। থানভি সিলসিলার একজন বুজুর্গ হিসেবে শৃঙ্খলাবোধটা তাঁর মধ্যে গভীরভাবে লক্ষ্য করা যেতো।

তিন.

মুজাহিদে মিল্লাত মাওলানা আতহার আলী রহ.-এর সুযোগ্য সন্তান ছিলেন শাহ সাহেব রহ.। বড় হয়েছেন একজন জাতীয় নেতা, মন্ত্রী ও এমপির সন্তান হিসেবে। সে হিসেবে তাঁর স্বভাবে, চলনে-বলনে একটা খান্দানি ভাব লক্ষ্য করা যেতো। দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অনেক প্রশস্ত। চিন্তার পরিসীমাও ছিল বিস্তৃত। ভাবতেন অনেকের চেয়ে ভিন্ন করে, ধারণ করতেন সময়কে। এজন্য আলেম-উলামার মজলিসে যখন কথা বলতেন সবার চেয়ে আলাদা হতো তাঁর বক্তব্য।

ইলমি গভীরতা, বর্ণাঢ্য জীবনের অভিজ্ঞতা ও তীক্ষ্ম বুদ্ধিমত্তার কারণে তিনি সবার দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হতেন। এজন্য গত প্রায় চার দশক ধরে তিনি জাতীয় পর্যায়ের আলেমদের মধ্যে অনন্য অবস্থানে ছিলেন। শীর্ষ আলেমদের যেকোনো উদ্যোগে তাঁর উপস্থিতি ছিল অনিবার্য। কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত না হওয়ার কারণে তিনি ছিলেন সবার চোখের মণি। সব দল-মত ও বলয়ে তিনি সমান গুরুত্ব পেতেন।

জাতীয় প্রতিষ্ঠান বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া যাদের শ্রম-ঘাম আর মেধায় আজকের পর্যায়ে তাদের অন্যতম ছিলেন শাহ সাহেব হুজুর রহ.। তিনি ছিলেন বেফাকের সহসভাপতি। প্রতিটি মিটিং প্রাণবন্ত ও কার্যকরী করার মূল কারিগর ছিলেন তিনি। যেসব মিটিংয়ে শাহ সাহেব উপস্থিত থাকতেন না সেগুলো ততটা প্রাণবন্ত ও কার্যকরী হতো না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

বেফাককে একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠানে উন্নীত করার পেছনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কওমি মাদরাসা সনদের স্বীকৃতির যে প্রক্রিয়া সেখানেও তাঁর বিশেষ ভূমিকা ছিল। অনেক টেকনিক্যাল বিষয় তিনি যতটা বুঝতেন ততটা বোঝার মতো লোক খুব কমই আছে। এজন্য সবার কাছে তাঁর বিশেষ গুরুত্ব ছিল। তাঁর যেকোনো মতকে সবাই শ্রদ্ধা করতেন, গুরুত্ব দিতেন।

জাতীয় পর্যায়ে আলেম-উলামার যেকোনো সম্মিলিত কাজে তাঁকে সামনের সারিতে দেখা যেতো। বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলন-সংগ্রামেও তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে। বাবরি মসজিদ লংমার্চ, তসলিমা নাসরিনবিরোধী আন্দোলন, ফতোয়াবিরোধী রায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন, নারীনীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন, নাস্তিক ব্লগারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন সবখানেই তিনি সরব ভূমিকা পালন করেন। সবশেষ তাবলিগ জামাত নিয়ে যে সংকটের সৃষ্টি হয় সেখানেও আলেম-উলামার পক্ষে তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। শহীদি মসজিদের খুতবায় তিনি এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করেন।
লেখক: হজরত আযহার আলী আনোয়ার শাহ রহ.-এর গুণমুগ্ধ ছাত্র

লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম

[দ্বিতীয় পর্বে পড়ুন: যে রত্ন হারিয়ে ব্যাকুল সবাই]


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ