বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১২ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫


‘শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ. আমার জীবনের একজন শ্রেষ্ঠ উস্তাদ’

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতি রুহুল আমীন (বাবা হুজুর)।।
মুহাদ্দিস, জামেউল উলুম মাদ্রাসা, মিরপুর-১৪, ঢাকা।

বাংলায় বুখারী শরীফের আলোচনা আসলে সর্বপ্রথম যেই মহান মনীষীর কথা মনে পরে যায় তিনি হলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ.।

বাঙ্গালী মুসলমানদেরকে তিনিই সর্বপ্রথম প্রিয়তম রাসূলের হাদীসের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। মহান এই মনীষী অর্ধ শতাব্দীরও বেশিকাল যাবত বুখারী শরীফের দরস প্রদানের মাধ্যমে হাদীস শরীফের খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন। হাদীস শরীফের খেদমতে শায়খ নিজেকে এমনভাবে সপেঁ দিয়েছিলেন যে "শায়খুল হাদীস" বলতে বাংলাদেশে যাকে বুঝানো হতো তিনি হলেন-আমাদের প্রিয় "শায়খ" শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহঃ।

"শায়খুল হাদীস" এই উপাধি তার নামের সাথে এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পরেছিল যে "শায়খুল হাদীস" বললে কোনরকম চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই সকলের মনযোগ চলে যেতো শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহঃ-এর দিকে। শায়খ রহঃ শুধু উপমহাদেশের একজন বিশিষ্ট হাদীস বিশারদই ছিলেন না বরং একজন প্রাজ্ঞ রাজনীতিবীদ হিসেবে রাজনীতির ময়দানেও তার প্রভাব ছিল বেশ দাপুটে। ১৯৯২ সালে হিন্দু জংগীগোষ্টি আর এ এস ও বিজেপি কর্তৃক বাবরী মাসজিদ শহীদ করার প্রতিবাদে শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ:-এর ডাকে লক্ষ লক্ষ মানুষের অংশগ্রহনে অযোধ্যা অভিমুখে যে লংমার্চ অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেই লংমার্চই প্রমান করে রাজনীতির ময়দানে শায়খের কি পরিমান দাপুটে প্রভাব ছিল।

তাছাড়াও প্রায় নিয়মিতই শায়খ রহ: কে বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা সেমিনারসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ওয়াজ মাহফিলে অংশগ্রহন করতে হত। যার ফলে শায়খ রহঃ সবসময় ব্যস্ত সময় পার করতেন। এতদসও্বেও দরসের প্রতি শায়খ রহ: এর ছিল বিশেষ গুরুত্ব। দরসে হাদীসের প্রতি তার বিশেষ ধরনের একটি টান ছিল। ফলে যত সমস্যাই হোক না কেন এবং যত দূরেই থাকুক না কেন দরস-মিস হবে এটা ছিল তার জন্য কল্পনাতীত একটি বিষয়।

আল্লাহর শোকর যে, আল্লাহ পাক আমাকে শায়খ রহ:-এর ছাত্র হওয়ার এবং শায়খকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ করে দিয়েছেন। ফলে দরসের প্রতি শায়খের এই বিশেষ টান আমাকে বারবার আশ্চার্যান্বিত করেছে।

শায়খের নিকট দরসের এতই গুরুত্ব ছিল যে, কখনো কখনো তো এমন হয়েছে যে গাড়ী রাস্তায় যানজটের কবলে পরেছে আর তিনি দরস ছুটে যাবে এই আশংকায় গাড়ী থেকে নেমে পরেছেন এবং দীর্ঘ সাত-আট মাইল পথ পায়ে হেঁটে মাদ্রাসায় গিয়ে দরসে উপস্হিত হয়েছেন। কোন ক্লান্তি শায়খ রহ:কে দরস প্রদানে ব্যাঘাত ঘটাতে পারেনি।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মাদ্রাসাগুলো বন্ধ হয়ে যায়। ফলে শায়খের দরস দেওয়ার সুযোগও স্বাভাবিকভাবে বন্ধ হয়ে আসে, তখন শায়খ রহ: ইলমি খিদমত ও দরস দানের ধারাবাহিকতা ঠিক রাখার জন্য কাজের বুয়ার সন্তানদেরকে কায়দা, আমপাড়া ও কুরআন শরীফ পড়া শিখিয়েছেন।

জামেউল উলুম মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার শুরু লঘ্ন থেকেই হুজুর আমাদের মাদ্রাসার প্রধান মুরব্বি ছিলেন। দাওরায়ে হাদীস চালু হওয়ার পর থেকে মৃত্যু অবধি হুজুর আমাদের মাদ্রাসার প্রধান মুরুব্বির দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি প্রধান শায়খুল হাদীসের দায়িত্বও পালন করেছেন। প্রতি সপ্তাহে নিয়মিত দুই দিন বোখারী শরীফের দরস দিতেন। 2001 সালের ঘটনা, রাজশাহীতে চার দলীয় জোটের মহাসমাবেশ, সেই মহা সমাবেশে বক্তব্য দিতে হুজুর রাজশাহী গিয়েছিলেন। নিয়ম হিসেবে পরদিন সকালেই আমাদের মাদ্রাসায় হুজুরের বুখারী শরীফের দরস দেওয়ার কথা, আমাদের ধারনা ছিল হুজুর হয়তো আজ বোখারী শরীফের দরস দিতে আসবেন না/আসতে পারবেন না।

সেই হিসেবে আমরা উস্তাদরা অধীর আগ্রহে মাদ্রাসার অফিস কক্ষে অপেক্ষায় রইলাম যে, কখন হকার পত্রিকা নিয়ে আসবে, আর আমরা পত্রিকার পাতায় হুজুরের বক্তব্যের খবর পড়ব। কিন্তু আমরা আশ্চর্য্য হলাম এই দেখে যে, হকার পত্রিকা নিয়ে আসার আগেই হুজুর আমাদের মাদ্রাসায় বুখারী শরীফের দরস দেওয়ার জন্য উপস্থিত। এবং কোন রকম বিশ্রাম নেয়া ছাড়াই হুজুর বোখারী শরীফের দরসে চলে গেলেন। এই সবকিছুই সম্ভব হয়েছে শায়খের খুলুছিয়্যাত ও লিল্লাহিয়্যাতের বরকতে। অন্যথায় একজন মানুষের পক্ষে বিরামহীন গতিতে এতকাজ আঞ্জাম দেওয়া কোন ভাবেই সম্ভব ছিলনা।

শায়খ রহ: এর আর একটি বড় কারামত হলো-শায়খ রহঃ দরসে কখনোই দরস সংল্শিষ্ট কথাবার্তা ছাড়া অন্যকোন কথাবার্তা বিলকুল বলতেন না। যেহেতু হুজুরের দরসে অন্যরকম একটি মুগ্ধতা থাকতো তাই ছাত্রদের পাশাপাশি আমরা উস্তাদরাও হুজুরের দরসে বসতাম। এমনকী কখনো কখনো জেনারেল শিক্ষিত ভাইয়েরাও হুজুরের দরসে বসতেন। সেদিনও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ছাত্রদের পাশপাশি আমিও হুজুরের দরসে বসে গেলাম এবং এই ভেবে আনন্দ পাচ্ছিলাম যে, হুজুর হয়তো গতকালকের সফর ও সমাবেশ সম্পর্কে দরসে কিছু বলবেন, কিন্তু না!

আমাদের ধারনা ভুল প্রমাণিত হলো। পুরো দরসে হুজুর দরস সংশ্লিষ্ট আলোচনা ব্যতিরেকে সফর ও সমাবেশ সম্পর্কে একটি কথাও বললেন না। এমনকি হুজুরের চেহারায় সফরের কোন ক্লান্তিও আমাদের কাছে পরিলক্ষিত হয়নি। মজার বিষয় হলো-যেই ব্যক্তিটি গতকাল রাতে বীরদর্পে রাজনীতির মাঠ কাপিয়ে এসেছেন। আজ একরাতের ব্যবধানে সেই ব্যক্তিই যখন দরসে হাদীসের মসনদে সমাসীন হলেন তখন তাঁকে দেখে বুঝার কোন উপায় ছিল না যে তিনি রাজনীতি বলতে কিছু জানেন। অর্থাৎ তিনি যখন দরসে বসতেন তখন তিনি শুধুই একজন শিক্ষক এবং শিক্ষকতার গুরু দায়িত্ব পূর্ণ সচেতনতার সাথে পালন/আদায় করতেন। মোট কথা একজন সফল ও মহৎপ্রাণ শিক্ষকের যে সকল বৈশিষ্ট্য থাকা প্রয়োজন তার সবগুলো বৈশিষ্ট্যই শায়খের মাঝে বিদ্যমান ছিল।

এককথায় বলতে গেলে শায়খ রহ:-এর শত-পরিচয়ের মাঝে একটি বড় পরিচয় হলো তিনি শুধু শায়খুল হাদীস এবং শুধু বিশিষ্ট রাজিনীতিবিদই নন বরং তিনি একজন শ্রেষ্ঠ শিক্ষকও বটে।

অনুলিখন- হাসান আহমদ। শিক্ষার্থী, জামেউল উলুম মাদ্রাসা।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ