জুমার খুতবা নিয়ে নারীবাদীদের আপত্তি, কী বলছেন ইমাম-খতিবরা?
প্রকাশ: ১৯ মে, ২০২৫, ০৫:০৮ বিকাল
নিউজ ডেস্ক

জুমার খুতবায় অনেক সময় নারীদের নিয়ে অসম্মানজনক ও কটু মন্তব্য করা হয়- সম্প্রতি এমন অভিযোগ উঠেছে নারীবাদীদের পক্ষ থেকে। তাদের দাবি, কিছু ইমাম ও খতিব ইসলামের মূল শিক্ষা থেকে বিচ্যুত হয়ে নারীদের উদ্দেশে অপমানজনক ভাষা ব্যবহার করেন, যা ইসলামের মানবিক মূল্যবোধ ও নারীর মর্যাদার পরিপন্থী। অথচ ইসলাম ধর্মই নারীদের দিয়েছে সম্মান, মর্যাদা ও সুস্পষ্ট অধিকার। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা. ছিলেন নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার পথিকৃৎ।

জুমার খুতবায় নারীদের প্রসঙ্গে ইমাম ও খতিবদের ভাষা ও দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হওয়া উচিত? কীভাবে ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে নারীর মর্যাদা উপস্থাপন করা যায়, যাতে তা হয় যথাযথ, শালীন ও গঠনমূলক। এসব বিষয়ে মতামত জানতে আওয়ার ইসলাম কথা বলেছে দেশের তিনজন খ্যাতিমান আলেম ও খতিবের সঙ্গে। প্রতিবেদন করেছেন: শাব্বির আহমাদ খান

‘খতিবরা নারীদের সম্মানজনক অবস্থান নিয়েই কথা বলেন’

বিশিষ্ট আলোচক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব মাওলানা মুহাম্মদ গাজী সানাউল্লাহ রাহমানী বলেন, ইসলামই একমাত্র ধর্ম, যা নারীদের সম্মান, মর্যাদা এবং অধিকারের পূর্ণ নিশ্চয়তা দিয়েছে। ইসলামে নারীদের যে অবস্থানে উন্নীত করা হয়েছে, তা অন্য কোনো ধর্মে বিরল।

তাঁর মতে, মসজিদের মিম্বর থেকে নিয়মিতভাবে সমাজকে নারীদের সম্মান ও অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা হচ্ছে। তাই কেউ যদি দাবি করেন, মসজিদের খুতবায় নারীদের প্রতি বিষোদগার করা হচ্ছে, তাহলে তারা হয় বাস্তবতা অস্বীকার করছেন, নয়তো অজ্ঞতার অন্ধকারে অবস্থান করছেন। ইসলামের সৌন্দর্য ও মানবিক চেতনা উপলব্ধি করতে হলে আগে ইসলামবিরোধিতার চোখ-রাঙানি থেকে মুক্ত হতে হবে।

গাজী মুহাম্মদ সানাউল্লাহ বলেন, ইসলাম নারীদের দিয়েছে মাতৃত্বের মর্যাদা, সমাজে দিয়েছে শ্রেষ্ঠ সম্মান। অথচ পশ্চিমা সভ্যতা নারীকে পণ্যের মতো ব্যবহার করে তাকে অবমাননার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আমাদের দেশে ইমাম-খতিবরা নিয়মিতভাবে নারীদের সম্মানজনক অবস্থানে পৌঁছানোর করণীয় নিয়েই কথা বলে থাকেন।

‘খতিবদের উচিত আরও দায়িত্বশীল ও সংযত হওয়া’

সম্প্রতি জুমার খুতবায় নারীদের নিয়ে কিছু মন্তব্যকে কেন্দ্র করে যে আলোচনা চলছে, তা একেবারে ভিত্তিহীন নয় বলে মনে করেন বগুড়ার একটি মসজিদের খতিব মুফতি মনোয়ার হোসেন। তাঁর মতে, আমাদের সমাজে ইসলামের দেওয়া নারী-অধিকার সম্পর্কে আরও গভীর অধ্যয়ন ও সচেতনতা জরুরি। অনেক সময় ইমাম ও খতিবরা পর্যাপ্ত গবেষণা ছাড়াই বক্তব্য দেন, যার ফলে ইসলামের মর্যাদাসম্পন্ন বার্তাটি যথাযথভাবে উপস্থাপিত হয় না।

মুফতি মনোয়ার বলেন, বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে নারীর অধিকার ও সামাজিক অবস্থান নিয়ে নতুন নতুন প্রশ্ন ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এই বিষয়ে যুগোপযোগী জ্ঞান ও দৃষ্টিভঙ্গির অভাবে কেউ কেউ হতাশা বা বিভ্রান্তি থেকে নারীদের নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করে বসেন, যা ইসলামের নীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীদের সর্বোচ্চ সম্মান দিয়েছেন—এই উদাহরণ তুলে ধরে তিনি বলেন, ইসলামের দেওয়া অধিকার ও মর্যাদা যথাযথভাবে তুলে ধরা ইমাম-খতিবদের দায়িত্ব। নারীবাদী বা প্রগতিশীল ধারা অনেক সময় ইসলামের বিরোধিতায় যেতে পারে কিংবা তাদের কিছু আচরণ অনুচিত হতে পারে—তবে সেখান থেকে সামগ্রিক নারী সমাজকে মূল্যায়ন করা উচিত নয়। সমাজে সবসময় কিছু ব্যতিক্রম ব্যক্তি থাকে, কিন্তু তাদের আচরণকে কেন্দ্র করে গোটা নারী সমাজকে উদ্দেশ্য করে বক্তব্য দেওয়া অনুচিত।

মুফতি মনোয়ার হোসেন আরও বলেন, ইমাম-খতিবদের উচিত আরও দায়িত্বশীল ও সংযতভাবে কথা বলা। আলেম সমাজ জাতির পথপ্রদর্শক—তাদের ভাষা, ভঙ্গি ও দৃষ্টিভঙ্গিতে শালীনতা, সুবিবেচনা এবং ভারসাম্য থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন। নারী-অধিকার বিষয়ে আলেমদের আরও সচেতনতা ও ইতিবাচক মনোভাব ইসলামের সৌন্দর্য সমাজে তুলে ধরতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

‘অধিকাংশ খতিব দায়িত্বশীলতার সঙ্গে বক্তব্য দেন’

খতিব মুফতি মাজেদুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের প্রায় সাড়ে তিন লাখ মসজিদে প্রতি সপ্তাহে জুমার নামাজে অংশ নেন দেশের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। এ উপলক্ষে দেওয়া খুতবা কেবল ধর্মীয় বার্তাই নয়, বরং সামাজিক সচেতনতা গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমও।

এই খতিব বলেন, খতিবরা কুরআন-সুন্নাহর আলোকে সমাজের সমস্যা, করণীয় ও মূল্যবোধের দিকগুলো তুলে ধরেন। সহনশীলতা, ইনসাফ এবং পারিবারিক শৃঙ্খলার প্রতি মানুষকে আহ্বান জানান।

নারীদের বিষয়ে খতিবদের কিছু মন্তব্যকে ঘিরে যে অভিযোগ উঠেছে, তা তাঁর মতে একপাক্ষিক এবং অনেক ক্ষেত্রে অতিরঞ্জিত। তিনি বলেন, অধিকাংশ খতিব দায়িত্বশীলতার সঙ্গে বক্তব্য দেন এবং ইসলামের ইতিবাচক বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেন।

তবে আলোচনার ক্ষেত্রেও ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরি বলে মনে করেন তিনি। তাঁর মতে, ইমাম-খতিবদের প্রতি অযাচিত সন্দেহ ছড়ানো নয়, বরং গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে ভুল বোঝাবুঝির অবসান সম্ভব।

ইমাম ও খতিবরা মনে করেন, ইসলামে নারীর মর্যাদা অত্যন্ত সুস্পষ্ট। সেই মর্যাদা সমাজে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ইমাম-খতিবদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের বক্তব্য যেমন সমাজকে প্রভাবিত করে, তেমনি তা হতে পারে সত্য, সহনশীলতা ও ন্যায়বিচারের দিকনির্দেশক। সমালোচনাও হওয়া উচিত তথ্যনির্ভর, ভারসাম্যপূর্ণ এবং গঠনমূলক—যাতে মুসলিম সমাজের আস্থা অটুট থাকে এবং ইসলামের মূল আদর্শের প্রচার ব্যাহত না হয়।

এমএইচ/