শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫


শিক্ষকতা এখনও আমাকে টানে

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

[সম্প্রতি বিশিষ্ট লেখক শরীফ মুহাম্মদের একটি দীর্ঘ আত্মজৈবনিক সাক্ষাৎকার নেন জহির উদ্দিন বাবর। সেই সাক্ষাৎকারটির অংশবিশেষ প্রকাশিত হয়েছে লেখা ও লেখকের কথা নিয়ে প্রকাশিত লেখকপত্রের তৃতীয় সংখ্যায়। আওয়ার ইসলামে পুরো সাক্ষাৎকারটি পর্যায়ক্রমে গদ্য আকারে প্রকাশিত হচ্ছে। আজ প্রকাশিত হলো চতুর্থ পর্ব]


দাওরায়ে হাদিস ফারেগ হয়েছি সম্ভবত ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এর পরপর আমি মতিঝিল (ওয়াপদা) মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হই। মতিঝিলে ঢোকার প্রেক্ষাপটটা হলো, আমার ফারেগ হওয়ার পনের দিন আগে আম্মা ইন্তেকাল করেন। এটা আমার জীবনের অনেক লক্ষ্য বা গতিপ্রবাহকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়। রমজানের আগেই আমার পাসপোর্ট করা ছিল। আম্মা জানতেন, আব্বা জানতেন আমি দেওবন্দ বা পাকিস্তান পড়তে যাবো। বা আরব বিশ্বের কোথাও। বিষয়টা যে খুব পরিকল্পিত ছিল এমন না। তবে আমি চেষ্টাগুলো করবো এমন একটা পরিকল্পনা ছিল। আমার বয়স তখন ২১ বছর। পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার বয়স ছিল, ইচ্ছাও ছিল। আম্মা যখন মারা গেলেন, আমি ভাইবোনদের সবার বড়, আমার পরে ১১ জন ভাইবোন। এর মধ্যে চারজন থেকে পাঁচজন একদম ছোট। আব্বার ব্যবসার অবস্থা তখন খুব খারাপ।

ওই সময় আমার পাসপোর্টটার দিকে শুধু তাকিয়ে থাকতাম। কিন্তু আমার কাছে মনে হতো এই ছোট ভাইবোনদের রেখে এক-দুই বছরের জন্য দূরে কোথাও যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আব্বা এটা নিয়ে আমার সঙ্গে অনেক রাগারাগিও করেছেন। আমি কেন পড়তে বিদেশে যাইনি এটা নিয়ে মন খারাপ করেছেন। কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত তখনই ঘুরিয়ে ফেললাম, আমাকে কিছু একটা করতে হবে আর যেকোনো মূল্যে পরিবারের সঙ্গে আমার যোগাযোগ থাকতে হবে।

আমি মতিঝিল মাদরাসায় শিক্ষক ছিলাম ঠিকই, কিন্তু বৃহস্পতি-শুক্রবারটা আমার ময়মনসিংহের জন্য বাঁধা ছিল। অনেক সময় শনিবারটাও। মাদরাসায় আসতে দেরিও করতাম। আমি কিছুই করতে পারিনি হয়তো, কিন্তু বড় হওয়া পর্যন্ত ভাইবোনের সঙ্গে সঙ্গে থাকা, এই অস্থিরতাটা আমি আম্মা মারা যাওয়ার পাঁচ-সাত বছর পর্যন্ত মন থেকে দূর করতে পারিনি। ফলে আমি অন্য কোথাও যেতেও পারিনি।

মতিঝিল মাদরাসায় নিয়োগের ব্যাপারটা ছিল এমন, সেখানে আমার একজন আত্মীয় ছিলেন আগে থেকে। আর ওই মাদরাসার যিনি মুহতামিম ছিলেন, মারা গেছেন, মাওলানা ইসহাক সাহেব; ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় বাড়ি; খুব বুজুর্গ মানুষ ছিলেন। মকতব থেকে দাওরা পর্যন্ত পড়েছেন ভারতের সাহারানপুরে। তিনি পারিবারিকভাবে আমার দাদাকে, আমার নানাকে চিনতেন। পরিবারগতভাবে আমাদেরকে খুব মহব্বত করতেন।

মতিঝিল মাদরাসাটি কমিটি প্রভাবিত মাদরাসা, আগেই তিনি কমিটির লোকজনকে বলে রেখেছিলেন, অনেক তরুণ আলেমকেই তো আমি এখানে এনেছি, একটা ভালো খান্দানের ছেলে আলেম হয়েছে, আমি তাকে এখানে আনতে চাই, আপনারা আমাকে সুযোগ দেবেন। এটা ছিল উনার ভাষা। তিনি এভাবে আমাকে মতিঝিল মাদরাসায় নিয়োগ করলেন। আমি এভাবেই দরসের খেদমতে যুক্ত হলাম।

১৯৯২ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত আমি মতিঝিলে ছিলাম। পরবর্তী সময়ে মতিঝিল থেকে ইস্তফা দিয়ে চলে যাই। আমার ময়মনসিংহ আসা-যাওয়া, মাদরাসায় সময় দেওয়া, এগুলো নিয়ে একটু সমস্যা হচ্ছিল। পরে আমি নিজে থেকেই সরে যাই। মতিঝিলে তখন বেশির ভাগ শিক্ষকই ছিলেন তরুণ। খুব উচ্ছ্বলতা ছিল। ছাত্ররা আমাকে এতোটা ভালোবাসতো, শিক্ষকরাও আমাকে ক্ষমা করতো বলব।

আমি আসলে মাদরাসায় সময় কম দিতাম। সাহিত্যের কারণেও বাইরে যেতাম। আবার ইসলামি আন্দোলন বা রাজনীতির প্রতি একটা মনস্কতাও আমার মধ্যে ছিল। ক্লাসের পরে বিভিন্ন মিটিং-মিছিলে চলে যেতাম। আবাসিক শিক্ষক হিসেবে খুবই আনফিট একজন মানুষ ছিলাম, শুধু সবকগুলোতে হাজির থাকতাম। কিন্তু শিক্ষকরা এতোটুকুতেই সন্তুষ্ট থাকতেন। আর ছাত্রদের অনেক ভালোবাসা পেতাম।

যখন যে সবকটা দেয়া হতো, কোনো রকম মুতালায়া করে ক্লাসে গিয়ে হাজির হতাম। কিন্তু ছাত্রদের ভালোবাসার কথা, শিক্ষকদের সঙ্গে বসে গল্প করার কথা আজও ভুলতে পারি না। তখন মাদরাসার পরিধিটা আরও ছোট ছিল। শহরের প্রাণকেন্দ্রে মাদরাসা। মতিঝিলে থাকার কারণে বিরানব্বইয়ের পর থেকে ইনকিলাব অফিস, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, অগ্রপথিক, ওই একটা দশক, পুরো নব্বইয়ের দশকটা আমি ঢাকা শহরের হৃদপিণ্ডে বসবাস করার কারণে অনেক জায়গায় যাতায়াতের সুযোগ পেয়েছি। এটা আমার জীবনের একটা বড় অধ্যায়।

একজন মুহাক্কিক ও মনোযোগী মুদাররিস যাকে বলা হয় সেই অর্থে আমি ততটা যোগ্য ছিলাম না। আমি নিজেকে কখনোই সেটা মনে করিনি। আমাকে যখন যেটা পড়াতে দেয়া হতো আমি মুতালায়া করে সেটাই গুছিয়ে ছেলেদের সামনে বলার চেষ্টা করতাম। এ কারণে ছেলেদের বিস্তর ভালোবাসা পেয়েছি। পরবর্তী সময়ে ২০০৩ সালের শুরুতে আমি যখন আবার ঢাকায় এসেছি তখন আসলে লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে বেছে নিই। হজরত হাফেজ্জী হুজুর রহ.-এর স্মারকগ্রন্থের কাজে যুক্ত হই। পরবর্তী সময়ে দৈনিক আমার দেশের সঙ্গে যুক্ত হই। ফলে এই পেশাটাই আমার মুখ্য হয়ে ওঠে। আমি শিক্ষকতার দিকে ফেরার সুযোগ পাইনি।

ইদানীংকালে, গত আট দশ বছরে আমি শারীরিকভাবে ওই সক্ষমতা বোধ করা যে, লেখালেখি, পত্রপত্রিকার কাজ, এগুলোর সঙ্গেও সময় দেব আবার খুব নিয়মিতভাবে প্রতিদিন ছাত্রদেরকে তিনটা-চারটা ক্লাস নেব এই জায়গাটিতে আমার নিজেকে একটু দুর্বল মনে হয়। মন থেকে শখ বা টানটা অবশ্য আমি এখনও ছাড়িনি। আমার খুব স্নেহভাজন একজনকে কয়েক দিন আগেই বলেছি, এখনও মনে চায় আল্লাহ যদি তাওফিক দেন অন্য অনেক কাজের ব্যস্ততা থাকলেও হাদিসের দরস পারব কি না জানি না, কুরআন শরিফের তরজমা, কুরআন বা হাদিসের কোনো সবক বা দরসে নেজামির নেসাবের কোনো কিতাবের সবক ছাত্রদেরকে নিয়মিত বসে পড়ানোর যদি সুযোগ পাই, যত মেহনত হোক পড়ানোর চেষ্টা করব। মনের সেই তামান্নাটা এখনও আমার ভেতরে আছে।

-এএ


সম্পর্কিত খবর