শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫


নবিজির শানে অমুসলিম কবিদের উর্দু শের

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

ওমর আলফারুক♦ কোন কবি সাহিত্যিক যখন নবিজির প্রেম সাগরে ডুব দিয়ে হৃদয়ের গহীন ভেতরের অপার্থিব অনুভূতির অনুবাদ কবিতায় বিমূর্ত করে তোলেন, আক্ষরিক অর্থে তখনই তা হয়ে ওঠে রাসুল প্রশস্তি৷

নাতে রাসুল বা রাসুল প্রশস্তি শুরু মূলত ইসলামে একবারে প্রাথমির যুগ থেকেই | হাসসান বিন সাবিত, আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা সহ প্রখ্যাত সাবাহা ছিলেন নাতে রাসুলে সিদ্ধহস্ত৷

এরপর ইসলাম ছড়িয়ে পড়ার সাথে নাতে রাসুলও ছড়িয়ে পড়ল পৃথিবীর দিরে দিকে৷ এভাবেই আরবি থেকে ফারসি, ফারসি থেকে উর্দু সাহিত্যে প্রবেশ ররে নাতে রাসুলের কনসেপ্ট৷

উর্দ সাহিত্যের অন্যান্য অঙ্গনের মতো রাসুল প্রশস্তিও অত্যন্ত সুপ্রাচীন ও সমৃদ্ধ৷ উর্দু সাহিত্যের একদম সূচনালগ্ন থেকে রাসুল প্রশস্তির উল্লেখ্যধারা হাজির ছিলো৷ উর্দু সাহিত্যে এমন কবি খুঁজে পাওয়া মুশকিল, যিনি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসালাল্লামের শানে কিছুই লেখেন নি৷ এমনকি অমুসলিম অনেক কবিও রাসুল প্রশস্তি করেছেন৷ তাদের মধ্যে মহারাজা কৃষ্ণ প্রসাদ, সুরুর জাহানাবাদি, জগন্নাথ আজাদ, ফিরাক গুরখপুরি, মুনশি শঙ্করলাল সাকি, হরি চন্দ্র আখতার, কুনর মহন্দর সিং বিদি, আরশ মুলসিয়ানি প্রমুখ অন্যতম৷

১. মুনশি শঙ্কর লাল সাকি

গালিবের সমসাময়িক বাহাদুর শাহ জাফরের সভাকবি মুনশি শঙ্কর লাল সাকি ১৮৮০ সালে সিকান্দাবাদে জন্ম গ্রহণ করেন৷ গালিব শিষ্য এই কবি উর্দু-ফার্সিতে সমান পারদর্শি ছিলেন৷

তিনি লিখেন…
মেরাজ রজনীতে আকাশের সারা গায় ছিলো জোৎস্না
জোৎস্নায় ছিলো প্রিয় নবিজির ঔজ্জ্বল্য

আকাশের কোত্থাও ছিলো না চাঁদের লেশ
নবিজির শুভ্রতা ছিলো চাঁদের স্থলাভিষিক্ত

মহাবিশ্বের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিলো মেশক-আম্বর
সৃষ্টি ছিলো আপ্লুত পেয়ে প্রেমের পয়গাম্বর

কি আর বলব সাল্লি আলা সাল্লি আলা
গ্যালাক্সিও বিস্মিত হয়ে গেলো দেখে সে প্রেমের জ্যোতি

অন্যত্র তিনি লিখেছেন…
জীবন শেষ হয়ে এলো, তবু দেখা হলো না সোনার মদিনা,
রুহ বেহেশতে গেলেও থেকে যাবে আক্ষেপ৷

আমার নাম রবে কিনা জানি না তাঁর কবিদের কাফেলায়
তবু নাত লিখে পাই হৃদয়ে প্রশান্তির প্রলেপ…

২. মহরাজা কৃষ্ণ প্রাসাদ শাদ

মহারাজা কৃষ্ণ প্রসাদ শাদ ১৮৬৪ সালে হায়দারাবাদে জন্মগ্রহণ করেন৷ তিনি উর্দু সাহিত্যে রাসুল প্রশস্তিতে যারা বিখ্যাত, তাদের একজন৷ নবিজির শানে তিনি অজস্র কবিতা লিখেছেন৷ তিনি আরবি, ফারসি, উর্দু, ইংরেজিতে দক্ষ ছিলেন৷ তার নাত সমগ্র হাদিয়ায়ে শাদ নামে প্রকাশিত হয়েছে৷

তিনি লিখেন…
আরব আকাশে উদিত হয়েছিলো যে ইশকের রজ্জু
প্রেমের কুরবানিতে সে হলো ইতিহাসের অনিবার্য অংশ

মাথায় সবুজ পাগরি, কাধে কালো কমলি
যাবতীয় কর্তৃত্ব নিজের নিলেন প্রিয়দের প্রিয়৷

আমি কাফির না মুমিন, তা হয়তো রব জানেন
কিন্তু আমি জানি যে আমি সুলতানে মদিনার বন্দা

বেহেশত দিয়ে কী করব? আমি তো আশিক
অনাদি কাল থেকে মদিনার প্রেমেই শুধু মত্ত

৩. সরওয়ার

দরগা সাহাই সরওয়ার ১৮৭৩ জাহানাবাদে জন্ম গ্রহণ করেন৷ প্রথমে তিনি ওহশত নামে লিখতেন, পরে সরওয়ার নাম ধারণ করেন৷ তিনি হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রবক্তা ছিলেন৷ ইসলামি সংস্কৃতিতে তিনি বেশ গভীর জ্ঞান সম্পন্ন ছিলেন, তাই তার রচনায় এর প্রভাব লক্ষ করা যায়৷

তিনি লিখেন…
অস্থির হৃদয়কে আলিঙ্গন করো
বেসমাল এ প্রেমি’কে সামলাও প্রিয়!

আমার বিষণ্নতার সমব্যথী তুমি
স্বপ্নে এসে একবার দেখা দাও প্রিয়

অনাদি প্রদীপের অনিবার্য অংশ তুমি
তোমার আলোর কাছে চাঁদ সর্বদাই ঋণী

৪. ফিরাক গোখপুরি

ফিরাক গোখপুরির আসল নাম রঘুপতি সাহাই৷ ১৮৯৬ সালে গোখপুরে জন্ম গ্রহণ করেন৷ তার পিতা মুনশি গোখপুরিও কবি ছিলেন৷ তার নাতের সংখ্যা খুব বেশি না হলেও তার রচনাগুলো ছিলো কালজয়ী৷

তিনি বলেন…
জগতে প্রদীপ অগনিত যার সীমা নাই৷
রহমতের পথ অগনিত যার সীমা নাই৷

জানো তোমরা কি মুহাম্মদের পরিচয়?
তিনি সকলের, কেবল ইসলামের নয়!

৫. হরি চন্দ্র আকতার

হরি চন্দ্র আকতার ১৯০১ সালে পাঞ্জাবে জন্ম গ্রহণ করেন৷ পনেরো বছর বয়সে কাব্য নেশায় মত্ত হয়ে হাফিজ জালান্দারির শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন৷ নবিজির শানে তার ‘এক আরব’ এবং ‘সবুজ গম্বুজ’ দুটি বিখ্যাত কবিতা৷

তিনি লিখেন…
কে পরমাণুকে করেছেন সাহারা
কে বিন্দুকে বানালেন দরিয়া

কার নামে মৃতেরা পেতো নব জন্ম
কে মৃতদের করেছেন পরশ পাথর

উদ্ধতের রাজত্ব করেছেন তছনছ
কিসরা-কায়সার কে করেছেন পদানত

কার প্রজ্ঞায় এতিমের আকাশ হলো রঙিন
কার বদৌলতে গোলাম হলো মওলা

সবুজ গুম্বুজের আকর্ষণে পরাজিত আমরা
তাই এসে গেছি আপনার দরবারে হে মুহাম্মদ

আপনরা জন্য হৃদয় গহীনে বে-ইন্তেহা পেয়ার
আপনার নামে লেখি গো নবিজি প্রেমের পঙতিমালা

৬. আরশ মুলসিয়ানি

আরশ মুলসিয়ানির আসল নাম ছিলো বালকিন্দ এবং আরশ তাখাল্লুস, কিন্তু উর্দু সাহিত্যে তিনি আরশ মুলসিয়ানি নামেই বেশি সমাদৃত৷ তার নাত সমগ্র ‘আহঙ্গে হেজাজ’ নামে প্রকাশিত৷

তিনি বলেন…
জিবরাইল যে দরোজার গোলাম
নবুওত সে গৃহের নাম

এই মাটির পৃথিবীর একটাই সৌভাগ্য
সে পেয়েছে প্রেমের নবির দর্শন

এই আকাশ, এই বাতাশ, এ কায়েনাত
সবের রহস্য একটাই— মুহাম্মদ মুস্তফা

৭. কনুর মহন্দর সিং

কনুর মহন্দর সিং বিদি ১৯০৯ সালে জন্ম গ্রহণ করেন৷ উর্দু সাহিত্যের রাসুল-প্রশস্তিতে তার সংযোজন অনস্বীকার্য৷ তিনি নবিজির শানে বহু কালোত্তীর্ণ কবিতা রচনা করেছেন৷

তিনি লিখেন…
মারেফাতের পূর্ণ প্রতিরূপ মুহাম্মদে আরবি
ইবাদত খোদার, কিন্তু অনুসরণ শুধু তাঁর

রাসুলের স্মরণ হৃদয়ের প্রশান্তি
রাসুলের ভালোবাসা আবে-হায়াত

রাসুলের মর্যাদা ভাষা ও বোধের অতীত
তাকে প্রকৃত জানেন শুধু খোদা তাআলা

৮. জগন্নাথ আজাদ

জগন্নাথ আজাদ ১৯১৮ সালে জন্ম গ্রহণ করেন৷ তাকে উর্দু সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি হিসাবে গণ্য করা হয়৷ আল্লামা ইকবালের ভক্ত-অনুরক্ত হিসাবে খ্যাত ছিলেন৷ নবিজির শানে লেখা ‘ফখরে দাওরান’ তার উল্লেখযোগ্য রচনা৷

তিনি বলেন…
সালাম পবিত্র সত্তার প্রতি, সালাম বাদশাহে দু’জাহান
পৃথিবীততে যার অজস্র অগণিত অনুকম্পা

সালাম, মানুষের যাবতীয় বিষণ্নতা বিনাশে যার আগমন
যিনি নিঃস্বের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল, অসীম প্রেমময়

সালাম, যার প্রতিটি শব্দে আজও স্তব্দ পৃথিবী-জাহান
সালাম, যিনি মানব হৃদয়ে জ্বালিয়েছেন প্রেমের অনল

আসলে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লামের অস্তিত্ব এতো প্রাসঙ্গিক ও অনিবার্য যে,পৃথিবীর কোন মুসলিম অমুসলিম দার্শনিক-চিন্তাবিদ, কবি-সাহিত্যিকের পক্ষে তাকে এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব প্রায়৷

একজন মানুষের ওপর এতো বেশি বই-পত্র লিখা হয়েছে যে, দিব্যদৃষ্টিতে দেখলে আক্ষরিক অর্থেই একে অসম্ভব বলে ভ্রম হয়৷ এ যেন وَرَفَعْنَالَكَ ذِكْرَكَ এর অলৌলিক বাস্তবায়ন৷

পৃথিবীতে এমন কোন স্থান নেই, যেখানে তার আলোচনা পৌঁছায়নি৷ এমন কোন জাতি নেই, যেখানে তাকে নিয়ে চর্চা হয় না৷

তাঁর ব্যাপারে সংক্ষেপে শুধু এইটুকু বলা যায়—
’بعد از خدا بزرگ توئی قصہ مختصر‘

-এটি


সম্পর্কিত খবর