শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫


‘কেনো ভাঙছে পরিবার, কোন দোহাইয়ে বৃদ্ধাশ্রমে বাবা-মা’

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

পরিবার! সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। কয়েকটি পরিবার নিয়ে গঠিত হয় একটি সমাজ। সামাজিক বন্ধনের চেয়েও বেশি জরুরি পারিবারিক বন্ধন।

কিন্তু আজ আমাদের সমাজে দেখা যায়, সামাজিক বন্ধন রক্ষা করতে গিয়ে অনেকেই পারিবারিক বন্ধন ছিঁড়ে ফেলছে। দুনিয়ার সবচেয়ে সংবেদনশীল শব্দটির নাম মা; সে মাকে অনেকেই বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসছে।

প্রশ্ন করা হলে, এলিট শ্রেণির কেউ কেউ জবাব দেয়- "মা বুড়ো হয়ে গেছে, এখন সমাজের সবকিছু অতটা বুঝে না"। অথচ একসময় সন্তানের জন্য সবচেয়ে প্রিয়স্থান ছিলো মায়ের কোল। মাকে ছাড়া এক মুহূর্তও সন্তান থাকতে পারতো না। সে মাকে কিনা সামাজিক বন্ধন রক্ষার দোহাই দিয়ে ছুঁড়ে ফেলছে বৃদ্ধাশ্রমে। ছিঁড়ে ফেলছে পারিবারিক বন্ধন! এর কারণ কী? জানতে চেয়েছিলাম বিশিষ্ট লেখক ও মুহাদ্দিস মাওলানা মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন এর কাছে। কথা বলেছেন আওয়ার ইসলামের নিউজরুম এডিটর মোস্তফা ওয়াদুদ।

আওয়ার ইসলাম: পরিবার একটি বড় শক্তি! কথাটির ব্যাখ্যা মানুষ নানাভাবে ব্যাক্ত করে। আপনি যদি এ বিষয়ে কিছু বলতেন।

মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন: কথাটির ব্যাখ্যা খুবই সহজ। যেমন ধরুন আমরা যদি একটি শক্তিমান ভবন তৈরি করতে চাই। ভবন নির্মাণ উপাদান রড, সিমেন্ট, ইট। এ সবগুলো উপাদানই আলাদা আলাদা। এই আলাদা জিনিসগুলো একত্রিত হয়ে একটা ভবন হয়। এখন আলাদা জিনিসগুলোর যদি শক্তিমান না হয় তাহলে ভবনটি কিন্তু শক্তিমান হবে না। বরং ভেঙে যাবে।

ঠিক একইভাবে পরিবারগুলো নিয়েই একটি কমপ্লিট সমাজ। সুতরাং পরিবারের জায়গাটি যদি মজবুত হয়, একটি বড় শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে একটি সমাজ মজবুত হতে পারবে।

আওয়ার ইসলাম: আদিকাল থেকে দেখে আসছি, বাবা-মা, দাদা-দাদি এমনকি পরদাদা বেঁচে থাকলেও সবাই একই পরিবারে থাকতেন? বর্তমানে এ পারস্পারিক ও পারিবারিক বন্ধন টিকে না কেন?

মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন: এর কারণ অনেক হতে পারে। তবে সবচেয়ে প্রধান কারণ যেটা সেটা হলো, রাসূল সা. হলেন আমাদের আইডল বা আদর্শ। তিনি আমাদের প্রত্যেকটা কাজের ব্যাপারে আমাদের কী কর্তব্য বা দায়িত্ব সেটা বলে দিয়েছেন।

আমরা আমাদের সমাজকে আধুনিকায়ন করতে গিয়ে এ চিরন্তন পদ্ধতি থেকে সরে গিয়েছি। আমাদের কর্তব্য ভুলে গিয়েছি। দায়িত্বের ব্যাপারে সচেতন থাকছি না। আরেকটা দিক হলো অধিকার। এটা নিয়ে মানুষ খুব হইচই করে। নিজের অধিকারে কেউ ছাড় দিতে রাজি হই না। তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, এখানে দিক দুটো। একটি কর্তব্য অন্যটি অধিকার।

মানুষ যখন শুধু তার অধিকার নিয়ে কথা বলবে। নিজের কর্তব্য ভুলে যাবে। তখন যে কোনো পরিবার বা শিল্প প্রতিষ্ঠান কিংবা যে কোনো হাউজ হোক না কেনো সেটা টিকবে না। সেখানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবেই। মোটকথা পরিবার না টিকার প্রধান কারণ হচ্ছে কর্তব্য ভুলে অধিকার নিয়ে লড়াই করা।

আওয়ার ইসলাম: সামাজিক বন্ধন মানুষকে অনেকদূর নিয়ে যায়। প্রশ্ন হলো একটি পরিবারের উপর সামাজিক প্রভাব কতটা স্থান করে নেয়?

মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন: এটাতো খুবই স্বাভাবিক। কারণ বেশি ঠাণ্ডা পানির প্রভাব অল্প গরম পানির উপর পড়ে। অর্থাৎ গরম পানি কম হওয়ায় এক সময় তা ঠাণ্ডা হয়ে যায়।

তেমনি সমাজ পরিবার থেকে অনেক বড় পরিসরের নাম। সুতরাং সমাজের বিশাল পরিসরের যে কৃষ্টি-কালচার তার দ্বারা পরিবার প্রভাবিত হবেই।

তবে এখানে একটি প্রশ্নের সৃষ্টি হবে যে, সমাজকে বদলাতে হলে আমরা কী করবো?

এর জবাব হবে সমাজকে বদলাতে হলে শুরুটা পরিবার থেকেই করতে হবে। একটি পরিবার ঠিক হলে তার দেখাদেখি আরেকটি পরিবার ঠিক হবে। এভাবে একদিন পুরো সমাজই চেঞ্জ হয়ে যেতে পারে।

যদি কোনো দেশ শক্তিশালী শৃঙ্খলার সাথে অগ্রগতির পথে অগ্রসর হতে চায় তাহলে গোড়া থেকেই তাকে পরিবর্তন আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের অনেক বড় কর্তব্য। রাষ্ট্র চাইলে এ জায়গায় কাজ করতে পারে। অর্থাৎ সামাজিক প্রভাবকে সুন্দর করার জন্য পরিবারকেই প্রথমে কাজ শুরু করতে হবে।

আওয়ার ইসলাম: এখন প্রায় সব পরিবারেই ভাঙনের সুর শোনা যায়। বিচ্ছেদের তিক্ততা সবাই উপভোগ করে। এ ভাঙনরোধে অথবা পারিবারিক বন্ধন রক্ষায় সমাজ কী ভূমিকা রাখতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন: প্রথমে আমাদের বিশ্ব সমাজ নয়। বরং বাংলাদেশের সমাজকে দেখতে হবে। বাংলাদেশ একটা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ হওয়া সত্ত্বেও এখানে একটা বড় গ্যাপ রয়েছে। সেটা হলো আমরা আমাদের সমাজকে পূর্ণাঙ্গ মুসলিম সমাজ বলতে পারছি না।

একটু লক্ষ করলে দেখবেন, আমাদের সমাজে সামাজিক যে ভাঙ্গণের সৃষ্টি হচ্ছে, তার অধিকাংই শিক্ষিত ও সচেতন পরিবার থেকে হচ্ছে। যদি অন্তত একশোটি ভাঙনের ঘটনা নিয়ে গবেষণা করা হয়। তাহলে দেখা যাবে এর প্রায় ৮০-৯০ টিই এমন যে, তারা শিক্ষিত ও সচেতন পরিবার। এলিট শ্রেণির মানুষ।

আর যারা ধর্ম অনুসরণ করছে তাদের সংসার ভাঙ্গছে এমন রেকর্ড সমাজে নেই বা থাকলেও অনেক কম। এর দ্বারা যে তথ্য পাচ্ছি সেটা হলো আমাদের ধর্মবিমুখতা। যেটা কোনো ভাবেই আমাদের বামপন্থি মিডিয়া আলোচনায় আনার সাহস পাচ্ছে না। সুতরাং সমাজের বড় ভূমিকা হবে মুসলমান দেশের সমাজকে মুসলিম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা।

আওয়ার ইসলাম: পারিবারিক ভাঙনে অবিশ্বাস একটা বড় ভূমিকা রাখে। এ অবিশ্বাসকে কিভাবে জয় করা যেতে পারে?

মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন: পারিবারিক ক্ষেত্রে অবিশ্বাস শব্দটার উৎপত্তি আমাদের দেশের পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে হয়েছে। আর এ অবিশ্বাস তৈরির প্রধান বা ৯৮% কারণ হলো শরীয়তের বিধান পর্দা না থাকা। পর্দাহীন পরিবারগুলোর মাঝেই যত রকমের অবিশ্বাস দেখা যায়।

যাদের জীবনের কোনো সীমানা নাই। পরিবারের সবাই যেদিকে খুশি সেদিকে চলতে চায়। তখন কারও প্রতি কারো বিশ্বাস করার পরিবেশ থাকে না। এজন্য মুসলমান হিসেবে আমাদের সমাজে যদি পর্দা প্রথা বলিষ্ঠভাবে প্রচলিত হয়। তাহলে অধিকাংশ পরিবার বা স্বামী-স্ত্রীর ক্ষেত্রে অবিশ্বাসের জায়গাটি থাকবে না। অর্থাৎ অবিশ্বাসকে জয় করার অন্যতম মাধ্যম হলো পর্দাকে রক্ষা করা।

আওয়ার ইসলাম: কোনো পরিবারে ভাঙ্গণের কোনো আলামাত দেখলে প্রতিবেশি কী ভূমিকা রাখতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন: মানুষ হিসেবে অবশ্যই এ বিষয়টির দায়িত্ব প্রতিবেশির রয়েছে। কেননা হাদিসে আছে, রাসূল সা. বলেছেন, এক মোমিন অপর মোমিনের আয়না। আয়নার মধ্যে অপরের যে অসুন্দর আছে তা ধরা পড়ে।

কেননা রাসূল সা. বলেছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো মোমিন পূর্ণাঙ্গ মোমিন হতে পারবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত সে অপরের কল্যাণ কামনা সেভাবে না করবে যেভাবে নিজের কল্যাণ কামনা করে।

এই হিসেবে তাকে বুঝানো। উপকারী বিষয়ে তাকে সহযোগিতা করা। সমাজের যারা প্রতিবেশি বা ঘরের যারা আপনজন তাদের কাছে এটা তার হক।

কিন্তু এখন যে সঙ্কটটি দাঁড়িয়েছে। সেটা হচ্ছে সমাজ থেকে প্রতিবেশি প্রথাটাও আমরা ভেঙে ফেলেছি। স্বার্থটাকে গুটিয়ে এমন এক জীবনব্যবস্থায় সমাজ আমাদের দার করিয়েছে। যেখানে আন্তরিক প্রীতিবোধটি হারিয়ে ফেলেছি। ফলে সমাজের আপন ভাইও আর আপন থাকছে না। এ জায়গায় এসে অনেকেই প্রতিবেশির ভূমিকা রাখার সুযোগ পাচ্ছে না।

এই যে পার্থিব বিষয়ে মানুষের চেতনার সীমাবদ্ধতা; এটা যদি ভাঙ্গা না যায় তাহলে কিংবা ব্যাপক মানবিক কল্যাণের উপর সমাজ প্রতিষ্ঠিত না হয় তাহলে একজন আরেকজনের কল্যাণকামী হয়ে পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবে না।

এখানে একটি প্রসঙ্গ আমি তুলে ধরতে চাচ্ছি সেটি হলো, আমাদের সমাজে অনেক এনজিও প্রতিষ্ঠান আছে। এরা অন্যের উপকারে বা কল্যাণে কাজ করছে। কিন্তু নিজের ভাইয়ের পাশে দাঁড়াচ্ছে না। এই যে একটা সঙ্কট। এটা সমাজে অনেক জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আওয়ার ইসলাম: আজকে প্রাশ্চত্যের অনেক দেশেই ঘরে কুকুর রেখে মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসছে। সম্প্রতি বাংলাদেশেও অনেকগুলো বৃদ্ধাশ্রম গড়ে ওঠছে। এ বৃদ্ধাশ্রম রীতি বন্ধে পরিবার, সমাজ কিংবা রাষ্ট্র কী কী ভূমিকা রাখতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন: শুরুতে যে কথা বললাম সে জায়গায় ফিরে আসা ছাড়া আমাদের কোনো উপায় নেই। আমাদের সমাজ যদি রাসূল সা. এর মদীনা সংবিধানমুখী সমাজ হয়। তাহলে মা-বাবার যে সম্মান ছিলো সে সম্মান তারা ফিরে পাবে। আর যদি প্রাশ্চাত্যমুখী সমাজ হয় তাহলে ঘরে কুকুর থাকবে আর মা-বাবা বৃদ্ধাশ্রমে থাকবে এটাই স্বাভাবিক।

সর্বশেষ কথা হলো যে, আমাদের ধর্মের সৌন্দর্য বা ধর্মের বিধিবিধানের সুফল যদি আমাদের পেতে হয় তাহলে পরিবার থেকেই প্রিয় নবী সা. কে অনুসরণ করতে হবে। প্রিয় নবী সা. তাঁর মায়ের সঙ্গে, চাচার সঙ্গে, স্ত্রীর সঙ্গে, সন্তানের সঙ্গে, নাতির সঙ্গে পরিবারের লোকদের সঙ্গে কেমন আচরণ করতেন? সেগুলো ফলো করতে হবে।

রাসূলের আচরণ যদি আমরা আমাদের সমাজে কিংবা পরিবারে বাস্তবায়ন করতে পারি তাহলে আমাদের চেয়ে একটা জঘণ্য পরিবেশের মধ্যেও একটা সুন্দরতম, উৎকৃষ্ট সমাজ উপহার দেয়া সম্ভব। আমাদের সমাজকে একটা আদর্শ, সুন্দর ও সভ্য সমাজ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব বলে আমি মনে করি।

-এটি


সম্পর্কিত খবর