তাওহীদ আদনান ইয়াকুব
প্রতিটি যুগেই কিছু মানুষ থাকেন, যারা কেবল তাঁদের জীবদ্দশায় নয়, বরং তাঁদের ইখলাস, চিন্তা ও কর্মের মাধ্যমে দীর্ঘকাল মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকেন। সময়ের স্রোতে অনেক নাম হারিয়ে যায়, কিন্তু কিছু নাম হয় মণিরত্নের মতো—অন্ধকারেও দীপ্ত। মাওলানা সুলতান যওক নদভী রহ. সেই বিরল শ্রেণির একজন।
তাঁকে প্রথম যেদিন দূর থেকে দেখেছিলাম দারুল মাআরিফের আঙ্গিনায় পড়ন্ত বিকেলের স্নিগ্ধ আলোয়, তখন মনে হয়েছিল, এ যেন একজন সাহিত্যের জ্যোতি—চোখে নীরব দীপ্তি, মুখে সংযমিত প্রশান্তি, আর চালচলনে অনাবিল আভিজাত্য। অথচ এই আভিজাত্য ছিল না বাহ্যিক পোশাকে, ছিল না উচ্চস্বরে বক্তৃতায়—তা ছিল এক অন্তর্গত সৌন্দর্য, যা কেবল মোমবাতির মতো নিজেকে জ্বালিয়ে চারপাশ আলোকিত করত।
তিনি যখন মজলিসে বসতেন, তাঁর চারপাশে সৃষ্টি হতো এক অব্যক্ত নীরবতা—না, ভয় নয়, বরং শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর এক অদ্ভুত আত্মিক আকর্ষণ। তিনি মজলিসে আসতেন কোনো উচ্চস্বরে বক্তৃতা দিতে নয়, বরং মনে করিয়ে দিতে—‘শিক্ষা মানে কেবল মুখস্থ নয়, তা আত্মার খাদ্য।’ তাঁর বলনে কেবল তথ্য থাকত না, থাকত অনুভব, উপলব্ধি এবং আত্মিক জাগরণ। আমরা তাঁর সান্নিধ্যে গিয়ে শিখেছি—ভাষা কিভাবে হৃদয়ের অনুবাদক হয়।
তাঁর প্রতিটি কথা ছিল অলংকারহীন অথচ অমলিন, প্রতিটি বাক্য ছিল চিন্তার আলোকে জ্বালানো মোমবাতি। তার লিখিত বই পুস্তক পড়ে মনে হয়, তিনি শুধু লিখেননি, যেন শব্দের মধ্য দিয়ে আল্লাহর কালামের সৌন্দর্যকে অনুভব করিয়ে দিয়েছেন। আর তাঁর সাহিত্য নিয়ে বললে—তাঁর কলম ছিল এমন, যা শব্দ দিয়ে হৃদয় স্পর্শ করে, এমনকি চোখের কোণেও জল এনে দেয়।
আমরা জানতাম, তিনি বড় মাকাতিবের একজন প্রাজ্ঞ মুহাক্কিক, কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন অদ্ভুত সরল। তিনি অনেকটা নিজের মধ্যেই হারিয়ে যাওয়া মানুষ ছিলেন—বাহ্যিক স্তুতি বা আড়ম্বরের বাইরে। কোনোদিন তাঁকে নিজের কথা বলতে শোনা যায়নি। যখন কেউ তাঁর প্রশংসা করত, তিনি অস্বস্তিতে পড়ে যেতেন। বলতেন, “এত কিছু বলো না ভাই, এগুলো আমলের খাতা ভারী করে না।”
একবার এক ছাত্র তাঁকে রাতে তাঁর কক্ষে বসে কাঁদতে দেখেছিল। পরদিন সেই ছাত্র প্রশ্ন করায় তিনি মাথা নিচু করে বলেছিলেন, “এই বয়সেও মনে হয়—আজও আমি কোনো কিছু শিখিনি... আমার রবের সামনে কী নিয়ে দাঁড়াব?” এ ছিল তাঁর ইলম ও ইখলাসের প্রতিচ্ছবি—যিনি নিজের জানাকে ‘অপর্যাপ্ত’ মনে করতেন, অথচ তিনিই আমাদের কত কিছুই না শিখিয়ে গেছেন।
আজ তিনি নেই। তাঁর কক্ষ, তাঁর চেয়ার এখন শূন্য। তবু মনে হয়, হাওয়া যেন তাঁর কণ্ঠস্বরে ফিসফিস করে। বারান্দার প্রতিটি ইট যেন তাঁর পায়ের শব্দ মনে রেখেছে। বইয়ের পাতায় তাঁর স্পর্শ, তাঁর দোআ, তাঁর চোখের পানি যেন মিশে আছে।
মাওলানা সুলতান যওক নদভী রহ. ছিলেন এমন একজন, যাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় আমাদের জন্য এক একটি পাঠশালা। যিনি নিঃশব্দে শিখিয়ে গেছেন—জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন হচ্ছে বিনয়, ইলমের পরিপূর্ণতা হচ্ছে ইখলাস, আর সাহিত্যের উৎকর্ষ হচ্ছে আত্মার জাগরণ।
তিনি চলে গেছেন, ঠিকই। কিন্তু রেখে গেছেন এমন এক গন্ধ, যা সময়ের ধুলোকণাতেও মলিন হয় না। তাঁর নাম, তাঁর স্মৃতি, তাঁর আদর্শ— আমাদের হৃদয়ের গভীরে অম্লান থাকবে, আজীবন।
اللهم اجعل قبره روضة من رياض الجنة، وارفع درجاته في عليين، وارزقنا حسن الاقتداء به. آمين.
এনএইচ/