মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫ ।। ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ ।। ২২ জিলকদ ১৪৪৬


কওমি শিক্ষা সনদের বাস্তবায়ন কেন জরুরি?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

|| মোহাম্মাদ হুজাইফা ||

উপমহাদেশে দেড়শ বছরেরও বেশি সময় ধরে ধর্মীয় শিক্ষার প্রধান মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত কওমি মাদরাসা। প্রতি বছর এসব মাদরাসা থেকে অসংখ্য হাফেজ, আলেম, মুফতি ও ধর্মীয় গবেষক বের হচ্ছেন, যারা জাতির ধর্মীয় সংকট ও জিজ্ঞাসার সুস্পষ্ট সমাধান দিতে সক্ষম।

তবে কওমিপড়ুয়া আলেমরা যথাযথ যোগ্যতা অর্জন করার পরও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির অভাবে সামাজিকভাবে অবমূল্যায়নের শিকার হন। আর সরকার স্বীকৃত নয় বলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও কওমি মাদরাসার সনদ গ্রহণযোগ্য নয়। 

২০১৮ সালে সরকার কওমি মাদরাসার সর্বোচ্চ জামাত দাওরায়ে হাদিসকে ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি বিষয়ের মাস্টার্স ডিগ্রির সমমানের স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু বাস্তবে এ স্বীকৃতি আজও কার্যকর হয়নি। ফলে কওমি শিক্ষার্থীদের মনে প্রশ্ন জেগেছে—সরকার স্বীকৃতি দিলেও আমরা কেন এখনও বঞ্চিত?

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ও সিনিয়র সাংবাদিক মাওলানা লিয়াকত আলী বলেন, ‘শুধু স্বীকৃতি দিলেই হবে না, এর বাস্তবায়ন জরুরি। কারণ, সামাজিক স্বীকৃতি তো আমাদের পূর্ব থেকেই ছিল। মানুষ মাওলানা/মুফতি হিসেবে কওমিদেরকেই জানে। এখন দরকার সরকারি স্বীকৃতির পূর্ণ বাস্তবায়ন।’

অনেকের ধারণা, কওমি শিক্ষার্থীরা ইংরেজি বা গণিতে দুর্বল। এর জবাবে তিনি বলেন, ‘আলিয়া ও কওমি মাদরাসার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য খুব বেশি নেই। আলিয়াতে হানাফি মাজহাবই পড়ানো হয়। পার্থক্য একটাই—আলিয়া সনদ সরকারি স্বীকৃত ও কার্যকর, কিন্তু কওমির ক্ষেত্রে তা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।’

এই শিক্ষাবিদ বলেন, ‘যেখানে আলিয়া শিক্ষার্থীরা কলেজ-ভার্সিটিতে ভর্তি ও চাকরির সুযোগ পাচ্ছে, সেখানে কওমি শিক্ষার্থীদেরও সেই সুযোগ দিতে হবে। যদি কওমিরা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারে, তাহলে তাদের বঞ্চিত করা বৈষম্য ছাড়া কিছু নয়।’

এ বিষয়ে জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়ার শিক্ষক ও লেখক মুফতি আবু নাঈম ফয়জুল্লাহ বলেন, ‘আধুনিক পৃথিবীতে শিক্ষার একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে উঠেছে। সেই কাঠামোতে সরকারিভাবে স্বীকৃতি পেলেই কেউ শিক্ষিত হিসেবে গণ্য হয়। অথচ বাংলাদেশের প্রধান ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থা কওমি মাদরাসা—স্বীকৃতি পেলেও তার বাস্তব প্রয়োগ নেই।’

এই শিক্ষক বলেন, ‘সমাজে যেসব ক্ষেত্র গবেষণা, নিয়োগ কিংবা কাজের জন্য সরকারি স্বীকৃত শিক্ষিতকে গ্রহণ করে, সেখানে কওমি শিক্ষিতরা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির অভাবে পিছিয়ে পড়েন। এটি একটি কাঠামোগত বৈষম্য।’

মুফতি আবু নাঈম বলেন, ‘বর্তমান ইন্ডাস্ট্রিয়াল যুগে ক্যারিয়ার গঠনের সবচেয়ে নিরাপদ ও স্থিতিশীল পথ হলো চাকরি। আর এই চাকরি অর্জনের জন্য সরকারি স্বীকৃতি ও বাস্তবায়ন অপরিহার্য। কেননা, সরকারি সনদ শুধু সামাজিক মর্যাদা নয়, বরং অর্থনৈতিক উন্নতির দ্বারও খুলে দেয়।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজের শিক্ষার্থী মাওলানা আবদুল্লাহ মাহমুদ বলেন, ‘এককথায় বলতে গেলে, করুণার দৃষ্টি নয়—বরং মর্যাদার সঙ্গে সমাজের মূলস্রোতে ফিরে আসাই আমাদের লক্ষ্য। কওমি শিক্ষার্থীদের জীবনমান উন্নয়নে এই সনদের স্বীকৃতি একান্ত জরুরি।’

ঢাবি শিক্ষার্থী আরও বলেন, ‘প্রথমত, জনবিচ্ছিন্ন হয়ে শিক্ষার্জন আশানুরূপ ফায়দাজনক নয়। সমাজের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে, বাস্তব জীবনে সেই শিক্ষা প্রয়োগ করতেই তার প্রকৃত সফলতা। দ্বিতীয়ত, দেশের সিভিল সার্ভিস বা বিসিএসসহ যেকোনো সরকারি চাকরিতে কওমি শিক্ষার্থীদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এটি বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে তাদের সাংবিধানিক অধিকার এবং এই অধিকার কেবল সনদের বাস্তবায়নের মাধ্যমেই অর্জন সম্ভব। কেন আমরা এসব মর্যাদাসম্পন্ন পেশা থেকে পিছিয়ে থাকবো? তৃতীয়ত, উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে—বিশেষ করে পিএইচডি পর্যায়ে—দেশে ও দেশের বাইরে কওমি শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে এই সনদের স্বীকৃতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এবং সর্বশেষে, সরকারি স্বীকৃতির সঙ্গে অর্থনৈতিক দিকটাও জড়িত।’

মাওলানা আবদুল্লাহ মাহমুদ বলেন, ‘কওমি শিক্ষার্থীদের নিম্নবিত্ত অবস্থা থেকে মধ্যবিত্ত বা উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে উত্তরণের জন্য এই সনদের বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। সুতরাং, এটি কোনো করুণার বিষয় নয়—এটি ন্যায্যতা, অধিকার এবং জাতীয় উন্নয়নের অপরিহার্য একটি ধাপ।’

তবে একটি প্রশ্ন প্রায়ই উঠে আসে—কওমি মাদরাসার সিলেবাস কি সত্যিই মাস্টার্সের সমমানের স্বীকৃতির উপযোগী?
এ বিষয়ে মুফতি আবু নাঈম বলেন, ‘যোগ্যতার দিক দিয়ে কওমি শিক্ষার্থীরা অনেক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বা আরবি বিভাগের শিক্ষার্থীদের চেয়েও এগিয়ে। তবে পাঠ্যক্রমের কিছু দুর্বলতা রয়েছে। তাই সিলেবাসকে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার ধারায় সুসংগঠিতভাবে পুনর্বিন্যাস করতে হবে।’

সনদ বাস্তবায়নের ফলে কওমি মাদরাসার স্বকীয়তা বিলুপ্ত হবে কিংবা আলিয়া মাদরাসার মতো পরিণতির শিকার হতে পারে—এমন আশঙ্কায় অনেকেই উদ্বিগ্ন। এ প্রসঙ্গে মাওলানা লিয়াকত আলী মন্তব্য করেন, ‘কওমি ধারার স্বকীয়তা ও নৈতিকতা রক্ষা করার পূর্ণ দায়িত্ব কওমি মাদরাসার শিক্ষকদের।’

এই শিক্ষাবিদ বলেন, ‘যদি আমরা আলিয়া মাদরাসার বাস্তবতা পর্যালোচনা করি, দেখতে পাই, সেখানে অনেক শিক্ষক সরকারি বেতন পাওয়ার কারণে প্রতিষ্ঠান ও ছাত্রদের প্রতি দায়িত্বশীলতায় ঘাটতি রাখেন। ফলে শিক্ষার মান ও নৈতিক বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়ে।’

তিনি সতর্ক করেন, ‘কওমি মাদরাসার শিক্ষকরা যদি এই বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করেন এবং আন্তরিকতা ও দায়িত্ববোধ নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করেন, তবে স্বকীয়তা ও নীতি বজায় থাকবে ইনশাআল্লাহ।’

সার্বিকভাবে কওমি শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই সরকারি সনদের বাস্তবায়ন চান—তবে স্বকীয়তা বজায় রেখে। কিন্তু বাস্তবায়নের পদ্ধতি, কাঠামো ও ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা এখনো অনেকের কাছেই অস্পষ্ট।

এই প্রেক্ষাপটে, কওমি ধারার শিক্ষাবিদ, দায়িত্বশীল ও নীতিনির্ধারকদের প্রতি সবার আবেদন হলো—দাওরায়ে হাদিস সনদের বাস্তবায়ন নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হোক, একটি সুস্পষ্ট ও গ্রহণযোগ্য রূপরেখা জাতির সামনে উপস্থাপন করা হোক, যাতে সংশয় দূর হয় এবং কওমি শিক্ষার ভবিষ্যৎ পথ স্পষ্ট হয়।

এমএইচ/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ