|| মুফতি জুবায়ের বিন আব্দুল কুদ্দুস ||
জিলহজ মাসের ৯ তারিখকে ইয়াওমে আরাফা বলা হয়। এই দিনের রোজার ফজিলত অসাধারণ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
صِيَامُ يَوْمِ عَرَفَةَ إِنِّي أَحْتَسِبُ عَلَى اللَّهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِي قَبْلَهُ، وَالسَّنَةَ الَّتِي بَعْدَهُ
অর্থ: "আরাফার দিনের রোজা সম্পর্কে আমি আল্লাহর কাছে আশা রাখি যে, তিনি এর মাধ্যমে আগের এক বছর এবং পরের এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন।" (তিরমিযী, হাদীস: ৭৪৯)
তবে বাংলাদেশে ঠিক কোন দিন রোজা রাখতে হবে তা নিয়ে অনেকের মধ্যে বিভ্রান্তি দেখা যায়। কারণ, টিভি ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে আমরা যখন সৌদি আরবে হজ্বের আরাফার মাঠে হাজীদের অবস্থান দেখি, তখন অনেকেই মনে করেন, ‘আজই তো আরাফা, সুতরাং আজই রোজা রাখা উচিত।’
কিন্তু বাস্তবতা হলো, সৌদি আরব ও বাংলাদেশের মধ্যে সময় এবং চাঁদের তারিখে পার্থক্য থাকার কারণে আমরা সেদিন রোজা রাখতে পারি না। তাই এ বিষয়ে বিভ্রান্তি দূর করতে নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা হলো:
১. আরাফার রোজা চাঁদের তারিখের সাথে সম্পৃক্ত
আরাফার রোজা কোনও সৌর মাস (যেমন জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি) বা নির্দিষ্ট বার (শনিবার, রবিবার) অনুযায়ী নয়; বরং এটি হিজরি চন্দ্র মাসের ৯ জিলহজের সাথে সংশ্লিষ্ট।
২. পৃথিবীর যেখানে ৯ জিলহজ হবে, সেখানেই আরাফার রোজা
যে দেশে যেদিন ৯ জিলহজ হবে, সেই দেশেই সেই দিন আরাফার রোজা রাখা হবে। এটি হজের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নয়, বরং ৯ জিলহজের দিনের সাওয়াবের জন্য।
৩. ইবাদতের সময় পূর্ব থেকে পশ্চিমে প্রবাহিত হয়
সূর্য, চাঁদ, নামাজ, রোজা—সব ইবাদতের সময় শুরু হয় পূর্ব থেকে এবং পশ্চিমে প্রবাহিত হয়। যেমন:
- সূর্য প্রথমে বাংলাদেশে ওঠে, পরে পাকিস্তান, সৌদি আরব, মিশর ইত্যাদিতে।
- পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময়ও পূর্ব দিক থেকেই শুরু হয়।
- একইভাবে চাঁদও পূর্বে দেখা যায়, পরে পশ্চিমে।
সুতরাং বাংলাদেশের ৯ জিলহজে আরাফার রোজা রাখাটাই সঠিক পন্থা।
৪. সৌদির সময়ের সাথে বিশ্বব্যাপী মিল অসম্ভব
সৌদিতে যখন ৯ জিলহজ হয়, তখন বাংলাদেশে থাকে ৮ জিলহজ। আবার সৌদিতে আরাফা দিনের যে সময়, তা বাংলাদেশে প্রায় ৬ ঘণ্টা পার্থক্যযুক্ত। অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা বা আফ্রিকার দেশগুলোর ক্ষেত্রে এ পার্থক্য আরও বেশি হয়। অতএব, বিশ্বব্যাপী একসাথে রোজা রাখা বাস্তবসম্মত নয়।
৫. হাজীদের অবস্থানের সাথে রোজা নয়
যদি আরাফার রোজা হাজীদের অবস্থানের ওপর নির্ভর করত, তাহলে হজে অবস্থানরত ব্যক্তিদের জন্য রোজা রাখা সর্বোত্তম হতো। কিন্তু শরীয়ত বলে, হজে অবস্থানকারীদের জন্য আরাফার দিনে রোজা রাখা মাকরূহ। অতএব, রোজার ফজিলত নির্ভর করে চন্দ্র-তারিখের উপর, হাজীদের অবস্থানের উপর নয়।
৬. ইসলাম অসম্ভব কোনো আদেশ দেয় না
ইসলামের বিধান সবসময় মানুষের সাধ্যের মধ্যে থাকে। পৃথিবীর সকল অঞ্চলে সৌদির আরাফার সময় মিলিয়ে রোজা রাখা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। সুতরাং এমন একটি বিষয়কে শরিয়তের নির্দেশ হিসেবে ধরা ঠিক নয়।
শেষ কথা:
আরাফার রোজা ৯ জিলহজের রোজা। এটি চাঁদের তারিখের সাথে যুক্ত, হাজীদের অবস্থানের সাথে নয়। পৃথিবীর যে স্থানে যেদিন ৯ জিলহজ হবে, সেদিনই সেখানকার মুসলমানরা রোজা রাখবেন। বাংলাদেশে যখন ৯ জিলহজ হবে, তখনই আমাদের রোজা রাখা উচিত—এটাই শরীয়তের বিধান এবং বিজ্ঞানসম্মত বাস্তবতা।
লেখক: শিক্ষক, লালবাগ মাদ্রাসা ঢাকা
খতিব, আজিমপুর ছাপড়া মসজিদ ঢাকা
পরিচালক, দাওয়াতুস সুন্নাহ বাংলাদেশ
এমএইচ/