ভাবুন তো একবার—একটা দেশ, যেখানে নেই Facebook, নেই Google, নেই YouTube, নেই WhatsApp। কিন্তু তারপরও তারা পিছিয়ে নেই একটুও। বরং প্রযুক্তির দুনিয়ায় তারাই এখন নেতৃত্ব দিচ্ছে।
আজকের বিশ্বে Google ছাড়া কিছু খোঁজার কথা ভাবা যায় না, Facebook ছাড়া অনেকের দিন শুরুই হয় না, আর YouTube ছাড়া যেন এক ঘণ্টাও চলে না। এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে, এমন একটি দেশ—যে এসব জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্মকে একরকম অবজ্ঞা করে নিজের ডিজিটাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে—তার নাম চীন।
চীনের এই প্রযুক্তিগত উত্থান আসলে শুধুই উন্নয়নের গল্প নয়, বরং এটি তথ্যযুদ্ধে একটি নীরব বিপ্লব। আধুনিক দুনিয়ায় যুদ্ধ আর শুধু বুলেট আর বোমার নয়—এখনকার লড়াই তথ্য দখলের, মগজ দখলের। আর এই যুদ্ধে চীন বাজি রেখেছে নিজের পক্ষেই।
চীন অনেক আগেই বুঝে গেছে, যে জাতি নিজের নাগরিকদের তথ্য অন্য দেশের কোম্পানির হাতে তুলে দেয়, তারা একদিন সবকিছু হারায়। সেই উপলব্ধি থেকেই তারা বন্ধ করে দিয়েছে Google, Facebook, YouTube, WhatsApp, Instagram এমনকি Microsoft-এর Bing সার্চ ইঞ্জিনও।
তবে তারা শুধু নিষেধাজ্ঞার পথ নেয়নি, বরং নিজেরাই গড়ে তুলেছে বিকল্প প্রযুক্তি অবকাঠামো।
Google-এর বদলে তারা ব্যবহার করে Baidu
WhatsApp-এর পরিবর্তে WeChat
YouTube-এর জায়গায় Youku
Google Pay-এর বদলে Alipay
Facebook-এর বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করে Renren বা অন্যান্য দেশীয় সোশ্যাল মিডিয়া
এইভাবে তারা নিজেদের তথ্য নিজেদের কাছেই রাখছে। চীনা জনগণের রাজনৈতিক মত, ব্যক্তিগত আলাপচারিতা, খাদ্যাভ্যাস, দৈনন্দিন জীবনচর্চা—সবই রক্ষা পাচ্ছে বাইরের চোখ থেকে।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, চীন তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়তেও নিচ্ছে সচেতন পরিকল্পনা।
TikTok-এর চাইনিজ ভার্সন Douyin-এ ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য রয়েছে সময়সীমা।
রাত ১০টার পর অ্যাপ বন্ধ হয়ে যায়।
কনটেন্ট হিসেবে দেখানো হয় বিজ্ঞান, ইতিহাস, দেশপ্রেমমূলক বিষয়বস্তু।
বিপরীতে, আমাদের দেশের শিশুরা YouTube খুললেই পায় এডাল্ট বিজ্ঞাপন, অশালীন গানের ভিডিও, ফালতু কনটেন্ট।
চীনের স্কুলগুলোতে শেখানো হয় রোবটিক্স, কোডিং, গণিত ও বাস্তবমুখী প্রযুক্তি শিক্ষা। আর আমাদের তরুণরা ব্যস্ত থাকে ফিল্টার দিয়ে ছবি তোলায়, রিল বানানোয়, নাচ-গানে—তথ্যের গভীরে নয়, বরং তার পৃষ্ঠদেশে ভেসে বেড়ায়।
চীন জানে, ভবিষ্যৎ প্রযুক্তির হাতেই। এবং সেই প্রযুক্তি যদি কারো নিয়ন্ত্রণে থাকে, তাহলে তথ্যের মাধ্যমেই তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
Google, YouTube, ChatGPT—এদের অ্যালগরিদম তৈরি হয় আমাদের পোস্ট, কমেন্ট, সার্চ হিস্ট্রি এমনকি আমাদের ব্যক্তিগত অনুভূতি বিশ্লেষণ করে। আমরা নিজেরাই নিজেদের তথ্য তুলে দিচ্ছি তাদের হাতে, বিনিময়ে পাচ্ছি বিনোদন, কিন্তু হারাচ্ছি নিয়ন্ত্রণ।
চীন সেই ভুল করেনি। ওরা নিজেদের ডেটা নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ করে। বাইরের কেউ তাদের চিন্তা-চেতনায় প্রভাব ফেলতে পারে না।
তাই আজ চীন প্রযুক্তির সুপার পাওয়ার। তারা খেলছে নিজেদের তৈরি নিয়মে। আর আমরা? আমরা এখনো ডিজিটাল উপনিবেশে বাস করছি—নিজেদের ঘরে বসে বিদেশীদের হাতে তুলে দিচ্ছি সব কথা, সব তথ্য।
Google জানে আপনি কখন ঘুমান। Apple জানে আপনি কার সঙ্গে কথা বলেন। Facebook জানে আপনি কাকে ভালোবাসেন।
আমরাও কি চীনের মতো নিজেদের তথ্য নিজেরা রক্ষা করতে পারব? নাকি তথ্যমুক্তির নামে তথ্য-দাসত্বই হবে আমাদের ভবিষ্যৎ?
এনএইচ/