মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫ ।। ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ ।। ২২ জিলকদ ১৪৪৬


আমরা ভারতকে দেখিয়ে দিয়েছি- পাকিস্তান ও গাজা এক নয়

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

হামিদ মীর

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ১০ মে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিয়ে দক্ষিণ এশিয়াকে পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা থেকে রক্ষা করেছেন। পাকিস্তান এই যুদ্ধবিরতিকে স্বাগত জানালেও ভারত এটিকে নিজেদের সাফল্য হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছে এবং দাবি করেছে যে, এই যুদ্ধবিরতি ট্রাম্পের মাধ্যমে নয়, বরং পাকিস্তানের অনুরোধে হয়েছে। ট্রাম্প বারবার যুদ্ধবিরতিতে আমেরিকার ভূমিকা এবং কাশ্মীর সমস্যার সমাধানের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে ভারতের নেতৃত্বের দ্বিচারিতা প্রকাশ করছেন। তবে অনেক পাকিস্তানি ট্রাম্পকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করেন না, কারণ তিনি ইসরায়েলের মিত্র হিসেবে পরিচিত এবং ইসরায়েল সাম্প্রতিক পাক-ভারত সংঘর্ষে ভারতের পক্ষে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়েছে।

এই তিন দিনের যুদ্ধে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি ড্রোন ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছে। বিশ্বস্ত সূত্র অনুযায়ী, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের যুদ্ধ পরিকল্পনায় ইসরায়েলি বিশেষজ্ঞদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল এবং তারা সরাসরি ভারতে উপস্থিত ছিলেন। কিছু পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকের মতে, এই যুদ্ধে পাকিস্তানের প্রকৃত প্রতিপক্ষ ছিল না ভারত, বরং ইসরায়েলের যুদ্ধ পরিকল্পনাকারীরা। ভারত ইসরায়েলের কৌশল অনুসরণ করে পাকিস্তানকে গাজা অঞ্চলের মতো ধ্বংস করতে চায়।

পাকিস্তানিরা এখনো প্রশ্ন করছে- ট্রাম্প যুদ্ধবিরতি করালেও এটি কতদিন স্থায়ী হবে? ভারত কি আবার পাকিস্তানে আক্রমণ করবে? ২২ এপ্রিলের পেহেলগাম হামলার পর ভারতের কৌশল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর পথ অনুসরণ করছেন। নেতানিয়াহু আমেরিকার মিত্র এবং ট্রাম্পের বন্ধু হলেও তিনি জাতিসংঘ ও আমেরিকার অনুরোধ উপেক্ষা করে ফিলিস্তিনি শিশু ও নারীদের হত্যা বন্ধ করেননি। পাকিস্তান পেহেলগাম হামলার নিরপেক্ষ তদন্তের প্রস্তাব দিলেও ভারত তা প্রত্যাখ্যান করেছে। ভারত যেকোনো মূল্যে পাকিস্তানে আক্রমণ করতে চেয়েছিল এবং সেই আক্রমণ করে নিজের অপমান ডেকে এনেছে।

ভারতের জন্য এখন একদিকে পাকিস্তানের হাতে অপমান, অন্যদিকে অতিরিক্ত আত্মগরিমা। ইসরায়েলের মতো, ভারতও আন্তর্জাতিক সমালোচনার তোয়াক্কা না করে নিজের শ্রেষ্ঠত্বের মোহে পাকিস্তানকে গাজা বানাতে চায়। ইসরায়েলও পাকিস্তানের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে, কারণ পাকিস্তান ইসরায়েলের ড্রোন প্রযুক্তিকে ব্যর্থ করেছে এবং অতীতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কিছু পুরোনো হিসাব রয়েছে।

১৯৪৮ সালে ইসরায়েল পাকিস্তানের কাছে স্বীকৃতি চেয়েছিল, কিন্তু পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তা প্রত্যাখ্যান করেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে পাকিস্তান বিমান বাহিনী ইসরায়েলি বিমান বাহিনীকে পরাজিত করে। এই যুদ্ধে পাকিস্তানি পাইলটরা ইসরায়েলি পাইলটদের বার্তা শুনতে গিয়ে লক্ষ্য করেন যে, তারা মাঝে মাঝে পাঞ্জাবি ভাষায় কথা বলেন, যা থেকে সন্দেহ হয় যে, তারা ভারতীয় বিমান বাহিনীর নীরব সহায়তা পাচ্ছে। ১৯ এপ্রিল ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানি পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আবদুস সাত্তার (পরবর্তীতে এয়ার কমোডোর) দুই ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানের সঙ্গে ডগফাইটে লিপ্ত হন।

ইসরায়েলি যুদ্ধ বিমানগুলো পাকিস্তানি পাইলটের রেডিও সিস্টেম জ্যাম করে দেয়, কিন্তু পাকিস্তানি পাইলট পিছু হটেননি; বরং তারা প্রতিরোধ করে এবং দামেস্ক আকাশে একটি ইসরায়েলি বিমান ভূপাতিত করেন। এই কৃতিত্বের জন্য এয়ার কমোডোর আবদুস সাত্তারকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর সরকার 'সেতারায়ে জুররাত' (সাহসিকতার পদক) প্রদান করেন।

পরবর্তী সময়ে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের নায়ক এম এম আলম সিরিয়ায় প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এম এম আলমের প্রকৃত নাম মোহাম্মদ মাহমুদ আলম ছিল এবং তার পিতার নাম মোহাম্মদ মাসুদ আলম, যিনি তাকে মহম্মদ গজনভীর নামে নামকরণ করেছিলেন।

স্কোয়ার্ডন লিডার জাহিদ ইয়াকুব আমিরের বই 'এয়ার কমোডোর এম এম আলম' থেকে জানা যায়, ২০২৫ সালে পাকিস্তান এয়ার ফোর্স একই ইতিহাস পুনরাবৃত্তি করেছে, যা ১৯৬৫ সালে এম এম আলম করেছিলেন। তবে পার্থক্য ছিল, এম এম আলম একটি মিনিটে পাঁচটি ভারতীয় বিমান ভূপাতিত করেছিলেন আর ২০২৫ সালে পাকিস্তানি পাইলটরা চীনা তৈরি বিমান দিয়ে বিশ্বের আধুনিক ফরাসি রাফাল যুদ্ধবিমানের রেডিও ও রাডার সিস্টেম জ্যাম করে তাদের গৌরব ধ্বংস করে দেন।

লাহোরের এম এম আলম রোড এবং মিয়ানওয়ালি শহরের পিএএফ এম এম আলম বেস আমাদের সেই নায়কের স্মৃতি স্মরণ করিয়ে দেয়, যিনি ১৯৬৫ সালে আদমপুর এয়ার বেস ধ্বংস করেছিলেন। ২০২৫ সালে পাকিস্তান এয়ার ফোর্স ও সেনাবাহিনী যৌথভাবে আবার আদমপুর এয়ার বেসে স্থাপিত এস-৪০০ রাশিয়ান এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ধ্বংস করেছে।

১৯৬৫ সালে পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের প্রধান এয়ার মার্শাল নূর খান নিজেই পাকিস্তানের আকাশসীমা রক্ষা করতে তার বিমান চালিয়েছিলেন এবং ২০২৫ সালে এয়ার চিফ মার্শাল জাহির আহমেদ বাবর সিধু নিজেও যুদ্ধবিমান চালিয়ে গেছেন।

আমাদের কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয় যে, ভারত আসলে ইসরায়েলের কৌশল অনুসরণ করছে। ইসরায়েল আরবদের বিরুদ্ধে আগ্রাসনে পানি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পটভূমিতেও আপনি দেখতে পাবেন যে, জর্ডান নদী ও হুলে হ্রদের পানির জন্য বিরোধ ছিল এবং ২০২৩ সালে হামাসের ইসরায়েলে হামলার পেছনে ইসরায়েলের বারবার ফিলিস্তিনিদের পানির সিস্টেমে আক্রমণ ছিল। ২০২২ সালে ইসরায়েল গাজা ও জর্ডান নদীর পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের পিপাসায় মারা দিতে তাদের কূপে বিষ মেশায় এবং পানির পাইপলাইন ধ্বংস করে।

পানি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার কৌশল ভারত ইসরায়েল থেকে শিখেছে। সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করা এবং পাকিস্তানি নদীর পানি বন্ধ করা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা। তাহলে আমার মতে, যুদ্ধবিরতি শুধু পাকিস্তান করেছে, ভারত করেনি। পাকিস্তানে ভারতের আক্রমণ অব্যাহত রয়েছে।

পাকিস্তানকে কূটনৈতিকভাবে ভারতের পানি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জেগে উঠতে হবে। পাকিস্তান এখনো শুধু আত্মরক্ষা করেছে, কোনো আগ্রাসন করেনি। যদি ভারত চেনাব ও জেহলম নদীর পানি বন্ধ করার প্রচেষ্টা বন্ধ না করে, তবে ওই নদীগুলোর ওপর নির্মিত ভারতীয় বাঁধ ধ্বংস করা আন্তর্জাতিক আইনের সম্পূর্ণ অধিকার। আমরা আগেও ভারতকে দেখিয়ে দিয়েছি যে, পাকিস্তান ও গাজা এক নয়। ভবিষ্যতেও তা দেখাতে ও প্রমাণ করতে হবে।

[হামিদ মীর পাকিস্তানের বিখ্যাত সাংবাদিক। উর্দু দৈনিক জং থেকে লেখাটি অনুবাদ করেছেন: সাইমুম রিদা]

এনএইচ/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ