বুধবার, ২১ মে ২০২৫ ।। ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ ।। ২৩ জিলকদ ১৪৪৬


‘কোনো ছাত্র গিবতমুক্ত থাকলে ও অ্যান্ড্রয়েড ফোন ব্যবহার না করলেই ওলি’


নিউজ ডেস্ক

নিউজ ডেস্ক
শেয়ার
ছবি: সংগৃহীত

গতকাল সোমবার (১৯ মে) রাজধানীর জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম রামপুরা বনশ্রী মাদরাসায় তাশরিফ আনেন মুহিউস সুন্নাহ হজরতুল আল্লাম মাহমূদুল হাসান। তিনি বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সভাপতি, আল হাইয়াতুল উলিয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়ার চেয়ারম্যান, মজলিসে দাওয়াতুল হকের আমিরুল উমারা, যাত্রাবাড়ী বড় মাদরাসার মুহতামিম। এছাড়াও নানা পরিচয় তাঁর। বর্তমানে দেশের সর্বজন স্বীকৃত মুরব্বি। হজরতের উপস্থিতিতে জামিয়ার শিক্ষক-ছাত্ররা যারপর নেই খুশি হন। 

মাদরাসার মুহতামিম ও শাইখুল হাদিস মাওলানা ইয়াহইয়া মাহমুদ হজরতের আগমনে অত্যন্ত আনন্দ প্রকাশ করেন। মেহমানের পরিচয় দিয়ে মাওলানা ইয়াহইয়া মাহমুদ বলেন, আজকের মহামান্য মেহমানের পরিচয় দেওয়ার যোগ্যতা আমার নেই, তিনি নিজেই নিজের পরিচায়ক।
শায়খে যাত্রাবাড়ী ছাত্র-শিক্ষকদের উদ্দেশে প্রায় দুই ঘণ্টা নসিহত করেন এবং বুখারি শরিফের প্রথম হাদিসের দরসও দেন। শেষে মোনাজাতের মাধ্যমে মজলিসের সমাপ্তি হয়। 

হজরত তাঁর বক্তব্যের শুরুতেই কুরআন ও হাদিস শরিফ থেকে দলিল দিয়ে প্রমাণ করেন, পৃথিবীতে আল্লাহ তায়ালার সবচেয়ে বড় নেয়ামত 'ইলম'। আর সবচেয়ে মহামূল্যবান কাজ ইলম শেখা। তিনি বলেন, ইলম ছাড়া নামাজ পড়া সম্ভব নয়। আল্লাহর কোনো হুকুম মানা সম্ভব নয়। কোনো ইবাদত করাও সম্ভব নয়। এই জন্যই হাদিস শরিফে যে শিখে শেখায় তাঁকে শ্রেষ্ঠ মানুষ বলা হয়েছে। সুতরাং পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ জাতি ও শ্রেণি হলো আলেম-উলামা ও তলাবা শ্রেণি।

আল্লামা মাহমুদুল হাসান তাঁর বক্তব্যের শুরুতে বলেন, খুতবা পড়ে বয়ান-বক্তব্য দেওয়া সুন্নত। ওয়াজিব বা ফরজ নয়। অথচ এটাকে আমরা ওয়াজিব ফরজের মতো বাধ্যতামূলক করে ফেলেছি। 'যা আবশ্যক নয় তাকে আবশ্যক জ্ঞান করা জায়েজ নেই। মূলনীতি উল্লেখ করে তিনি বলেন, বয়ান-বক্তৃতার শুরুতে খুতবাকে আবশ্যক জ্ঞান করা যাবে না।

তিনি তার বক্তব্যের এক পর্যায়ে সাফ-সুতরাই ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেন। তিনি বলেন, হাদিস শরিফে এসেছে, ঈমানের সর্বনিম্ন শাখা রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরানো, রাস্তা পরিষ্কার করা। তিনি বলেন, ইসলামে যদি রাস্তা পরিষ্কারের এত গুরুত্ব হয়, তাহলে ঘরবাড়ি পরিষ্কারের কত গুরুত্ব হবে! ব্যক্তির নিজেকে পরিষ্কার রাখা কতটা গুরুত্বপূর্ণ হবে!

তিনি আমাদের আকাবির ও আসলাফ কতটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতেন তার বিবরণও তুলে ধরেন। প্রসঙ্গত তিনি আরও বলেন, নিজেকে কেবল ময়লা আবর্জনা থেকে পরিষ্কার রাখলেই চলবে না, গুনাহের ময়লা থেকেও সর্বোতভাবে পরিষ্কার রাখতে হবে।

তিনি একটি উদাহরণ দিয়ে বলেন, আমাদের চোখে যদি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর একটি বালুর কণা পড়ে যায়, তাহলে চোখ ডলতে ডলতে আমরা অস্থির হয়ে যাই, পুরো শরীর অস্থির হয়ে যায়। হাঁটতে থাকলে হাঁটা বন্ধ করে দিই, খেতে থাকলে খাওয়া বন্ধ করে দিই, লিখতে থাকলে লেখা বন্ধ করে দিই, যে কাজই করতে থাকি তা বন্ধ করে দিই; ছোট্ট একটা বালু কণা যদি আমাদেরকে এতটা অস্থির ও পেরেশান করে তুলতে পারে, তাহলে সামান্য ছোট গোনাহও তো অন্তত আলেম-উলামাদেরকে বালু কণার চেয়ে বেশি অস্থির ও পেরেশান করার কথা! আল্লাহ আমাদেরকে সব ধরনের গুনাহ থেকে হেফাজত করুন!

তিনি বর্তমানে এন্ড্রোয়েড মোবাইলের ভয়াবহতা ও গুনাহ সম্পর্কে অবহিত করিয়ে ওয়াদা করান, কোনো ছাত্র কোনো অবস্থাতেই এন্ড্রয়েড মোবাইল হাতে নেবে না, চালাবে না। তিনি এটাও বলেন, বর্তমানে কোনো ছাত্র যদি গিবত না করে আর অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল না চালায় তবে সেই ওলি!

শায়েখে যাত্রাবাড়ী আরও বলেন, বাংলাদেশে আমরা কেউ ইলম শিখি না। ইলম চর্চা করি না। আমরা সবাই মালুমাত শিখি। মালুমাত চর্চা করি। তিনি বলেন, ইলম আর মালুমাত এক না। ইলমের মূল্য আছে। মালুমাতের কোনো মূল্য নেই। 

তিনি আফসোস করে বলেন, বর্তমানে আলেমরা শ্লোগান দেয় 'আল কুরআনের আলো ঘরে ঘরে জ্বালো'। তিনি বলেন, এই শ্লোগান তো তথাকথিত 'আহলে কুরআনে'র, যারা হাদিস শরিফের অস্বীকার, যারা হাদিস মানে না তাদের শ্লোগান। অথচ এই শ্লোগান আলেমরা দেয়। এই শ্লোগান তো কোনো মুসলমানের পক্ষে দেওয়াও সম্ভব না। আমাদের ইলম নেই বলেই আমরা এমন শ্লোগান দিয়ে থাকি, দিতে পারি। আমাদের ইলম আমাদেরকে এমন শ্লোগান দিতে বাধা দেয় না, কারণ আমাদের ইলম নেই। আমরা মালুমাত নিয়ে আছি, ইলমের চর্চা আমরা করলে এমন শ্লোগান দিতে আমাদের ইলম আমাদেরকে বাধা দিত।

হজরত বলেন, আমরা শ্লোগান দিই- 'সংবিধান মোদের আল কুরআন'। এটিই একটি ভুল শ্লোগান। কারণ, পৃথিবীর সবাই একমত সংবিধান পরিবর্তন ও পরিবর্ধনযোগ্য। অথচ কুরআনুল কারিম পরিবর্তনযোগ্য নয়। সুতরাং কেউ যদি বলে, 'সংবিধান মোদের আল কুরআন' সে যেন প্রকারান্তরে কুরআনকে পরিবর্তন করতে চায়। এভাবে আরও অনেক শ্লোগান রয়েছে, যা শুনতে খুব সুন্দর মনে হলেও গভীরভাবে চিন্তা করলে ভুল প্রমাণিত হয়। এগুলো আমাদের ইলম দৈন্যতার কারণে আমরা বুঝতে পারি না, ধরতে পারি না।

হজরত তাঁর বয়ানে আরও বলেন, আল্লাহ কুরআনে বলেছেন, আলিফ লাম মীম। জা-লিকাল কিতাবু লা রাইবা ফী-হ, হুদার লিল মুত্তাকীন। এই আয়াতগুলোর অর্থ আমরা সবাই জানি কিন্তু এর নির্দেশনা কী আমরা জানি না।

তিনি বলেন, কুরআন ও হাদিসে যত জায়গায় সংবাদ এসেছে, তার অধীনে নির্দেশ রয়েছে। সুতরাং উক্ত আয়াতের নির্দেশনা হলো, এই কুরআন মহান কিতাব, একে পড়লে আঁকড়ে ধরলে তুমিও মহান হতে পারবে সুতরাং তুমি এই কিতাব পড় ও আঁকড়ে ধর। অনুরূপভাবে 'এই কিতাবে কোনো সন্দেহ নাই, এই কিতাব যদি তুমি আঁকড়ে ধর তাহলে তোমার মুক্তি সফলতা ও উন্নতির ব্যাপারেও কোনো সন্দেহ থাকবে না। 

এভাবে পুরো কুরআন শরিফে আমাদের জন্য নির্দেশনা রয়েছে, কুরআন শরিফের অন্তর্নিহিত এ নিগূঢ় নির্দেশনা আমরা বুঝি না, খুঁজি না। এই ইলম আমরা চর্চা করি না। ভাসা ভাসা অনুবাদ ও মালুমাতের পেছনে পড়ে থাকি, বরং জীবন পার করে দিই।

শায়েখে যাত্রাবাড়ী আরও বলেন, বাংলাদেশের আলেমগণ মুখে মুখে দেওবন্দের নাম নেন। নিজেদেরকে দেওবন্দি বলে পরিচয় দেন, কিন্তু বোধ বিশ্বাস চিন্তা চেতনা কাজ কর্ম ও স্বভাব চরিত্রে দেওবন্দি না। আকাবির ও আসলাফের অনুসারী না। 

দেওবন্দি আলেমদের স্বভাব চরিত্র ও আদর্শ উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি আকাবির ও আসলাফের নানা ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, একবার কিছু ভক্ত মুরিদিন হজরত থানভী রহ.কে প্রশ্ন করলেন, আপনার এখানে জালাল আর জালাল, শুধু শাসন আর শাসন, অথচ হজরত মাদানী রহ এর ওখানে শুধু জামাল জামাল, ছাড় আর ছাড়! এটা কেমন? তখন থানভী রহ. উত্তর দেন, আরে ভাই! আমি তো হলাম কূপ। আর তিনি তো হলেন সমুদ্র। কূপে সামান্য নাপাক পড়লেই বিগড়ে যায়, নাপাক হয়ে যায়, আর সমুদ্রে যাই পড়ুক তা না পাক হয় না।

এভাবে কিছু ভক্ত মুরিদিন হজরত মাদানী রহ.কে প্রশ্ন করলেন, আপনার এখানে জামাল আর জামাল, শুধু ছাড় আর ছাড়, অথচ হজরত থানভী রহ এর ওখানে শুধু জালাল জালাল, কেবল শাসন আর শাসন! এটা কেমন? তখন হজরত মাদানী রহ. বললেন, 'নাহনুস সায়াদিলাতু ওয়াহুমুল আতিব্বা' আরে ভাই! আমরা তো হলাম, কম্পাউন্ডার, আর তারা তো হলেন ডাক্তার। 

শায়েখে যাত্রাবাড়ী এই ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, এই ছিল আমাদের দেওবন্দি আকাবির ও আসলাফের পারস্পরিক সম্পর্ক ও মনমানসিকতা অথচ আমাদের বাংলাদেশের আলেমগণ এই স্বভাব চরিত্র ও আদর্শ থেকে কত দূরে।

শায়েখ তাঁর খাস উস্তাদ হজরত মাওলানা ইউসুফ বিননুরী রহ এর বরাত নকল করে বলেন, বাংলাদেশের আলেমগণ হিংসাপরায়ণ। পাকিস্তানের আলেমগণ অহংকারী আর ভারতের আলেমগণ অমানবিক।

শায়েখে যাত্রাবাড়ী বুখারি শরিফের প্রথম হাদিসের দিকে তাকিয়ে বলেন, ইমাম বুখারি শরিফ বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম দ্বারা শুরু করেছেন। অথচ বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম বলে কাজ শুরু করার নির্দেশ সংক্রান্ত হাদিসের ব্যাপারে তাহকিক হলো, হাদিসটি আইম্মায়ে হাদিসের মতে সহিহের নিচে গারিবের উপরে অর্থাৎ হাদীসটি হাসান পর্যায়ের। ইমাম বুখারি এই হাদিসের ওপর আমল করে কিতাবের শুরুতে বিসমিল্লাহ আনার মাধ্যমে প্রমাণিত হয় গায়রে সহিহ হাদিসও আমলযোগ্য। তবেই তিনি এই হাদিসের ওপর আমল করেছেন। 

সুতরাং ইমাম বুখারি রহ.-এর এই আমল আহলে হাদিস ভাইদের ওপর বড় থাপ্পড় ও উম্মুক্ত আঘাত। সেই সাথে জমহুর আলেমদের পক্ষে বার্তা, ফাজায়েল ও তারগিবের ক্ষেত্রে গায়ে সহিহ এমনকি যয়িফ হাদিসও হুজ্জত তথা আমলযোগ্য।

এসএকে/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ