বিবাহ মানব সভ্যতার সূচনা থেকেই স্বীকৃত একটি বৈধ ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। এটি মানব জীবনে প্রশান্তি ও নিরাপত্তা আনার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। ইসলাম বিবাহকে একটি ইবাদত হিসেবে গণ্য করে এবং জীবনকে শৃঙ্খলাপূর্ণ ও নিরাপদ রাখার মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করে।
ইসলামে বিবাহের জন্য নির্দিষ্ট কোনো বয়সসীমা নির্ধারিত নেই। তবে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে মেয়েদের জন্য সর্বনিম্ন ১৮ এবং ছেলেদের জন্য ২১ বছর বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে। এর ব্যত্যয়ে কেউ বিবাহ করলে, তাকে “বাল্যবিবাহ” হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় এবং কখনো কখনো তা জোরপূর্বক বাতিলও করে দেওয়া হয়।
কুরআন, হাদীস ও বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে বিবাহের বয়স নির্ধারণ বিষয়টি কতটা যুক্তিসঙ্গত তা ভেবে দেখা গুরুত্বপূর্ণ।
কুরআনের দৃষ্টিতে বিবাহ
যখন মানুষ প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে যায় তখন তার মধ্যে বিবাহের আগ্রহ সৃষ্টি হতে থাকে। তার অন্তরে অস্থিরতা ও ব্যাকুলতা তৈরি হয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:
وَ مِنۡ اٰیٰتِہٖۤ اَنۡ خَلَقَ لَکُمۡ مِّنۡ اَنۡفُسِکُمۡ اَزۡوَاجًا لِّتَسۡکُنُوۡۤا اِلَیۡہَا وَ جَعَلَ بَیۡنَکُمۡ مَّوَدَّۃً وَّ رَحۡمَۃً ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیٰتٍ لِّقَوۡمٍ یَّتَفَکَّرُوۡنَ
অর্থাৎ, “তাঁর নিদর্শনসমূহের মধ্যে একটি নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকেই সঙ্গিনী সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের নিকট প্রশান্তি লাভ করো, আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়ার বন্ধন সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা রূম, আয়াত: ২১)
এই আয়াত আমাদের বুঝিয়ে দেয়—প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির স্বাভাবিক চাহিদা পূরণের অন্যতম মাধ্যম হলো বিবাহ। তা না হলে মানুষ অস্থির হয়ে পড়ে এবং বিকল্প অবৈধ পথে ধাবিত হয় এবং প্রচলিত সমাজে হচ্ছে। বরং অবৈধ পথে ধাবিত হওয়ার প্রবণতা বলা যায় মহামারি আকার ধারণ করেছে।
হাদীসের আলোকে বিবাহের উপযোগী সময়
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: يَا مَعْشَرَ الشَّبَابِ مَنِ اسْتَطَاعَ مِنْكُمُ الْبَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ فَإِنَّهُ أَغَضُّ لِلْبَصَرِ وَأَحْصَنُ لِلْفَرْجِ وَمَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَعَلَيْهِ بِالصَّوْمِ فَإِنَّهُ لَهُ وِجَاءٌ
অর্থাৎ “হে যুবসমাজ! তোমাদের মধ্যে যার সামর্থ্য আছে, সে যেন বিবাহ করে। কারণ, এটি দৃষ্টিকে অবনমিত রাখে ও লজ্জাস্থানকে হিফাযত করে। আর যার সামর্থ্য নেই, সে রোযা রাখুক, কারণ রোযা তার জন্য ঢালস্বরূপ।” (সহিহ বুখারী, হাদীস: ৫০৬৬)
এই হাদীস থেকে বোঝা যায়—
- নবীজি যুবকদের বিবাহ করতে উৎসাহ দিয়েছেন, শিশুবিবাহ নয়।
- বিবাহের জন্য শারীরিক ও আর্থিক সক্ষমতা জরুরি।
- বিবাহ অবৈধ কাজ থেকে রক্ষা করে।
- যার সামর্থ্য নেই, তার জন্য রোযা একটি বিকল্প উপায়।
বিবাহের সক্ষমতা বলতে কী বোঝায়?
হাদিস বিশারদ মোল্লা আলী কারী রহ.বলেন,
“বিয়ের সক্ষমতা হলো, শারীরিক ক্ষমতা থাকা, আর্থিক সক্ষমতা থাকা অর্থাৎ মোহর, ভরণপোষণ ও বসবাসের জায়গা ইত্যাদি দেওয়ার ক্ষমতা থাকা।” (মীরকাতুল মাফাতীহ, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ২৩৮)
রাষ্ট্রীয় আইন বনাম ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গি
বর্তমানে বাংলাদেশসহ অনেক দেশে ১৮ বছর পূর্ণ না হলে বিয়েকে ‘বাল্যবিবাহ’ বলে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। অথচ ইসলামের দৃষ্টিতে প্রাপ্তবয়স্ক বলতে বোঝায় যৌবনে পদার্পণকারী, যার মধ্যে চাহিদা ও দায়িত্বশীলতা তৈরি হয়েছে।
মানবদেহের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ নির্দিষ্ট বয়সে ঘটে না। কেউ ১৫ বছরেই প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে যায়, আবার কেউ ২০ বছরেও পরিপক্বতা অর্জন করতে পারে না। এ কারণেই ইসলাম বয়স নির্ধারণ করেনি; বরং যৌবন, সামর্থ্য ও অভিভাবকের সম্মতিকেই বিবাহের শর্ত হিসেবে বিবেচনা করেছে।
বিবাহের প্রয়োজনীয়তা
বিবাহের চাহিদা ক্ষুধার মতো। ক্ষুধা লাগলে যেমন মানুষ খাবারের জন্য ছুটে, বিবাহের আকাঙ্খা জাগলে তেমনি শান্তির খোঁজে ছুটে। বৈধ পথ না পেলে সে অবৈধ পথে ঝুঁকে পড়ার ঝুঁকি থাকে।
বাল্যবিবাহ সম্পর্কে প্রচলিত আপত্তিগুলোর পর্যালোচনা
বাল্যবিবাহ রোধের পক্ষের যুক্তিগুলো হলো—
- অল্প বয়সে বিয়ে করলে মা ও সন্তান উভয়ের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ে।
- পড়ালেখা ও উন্নয়নের ব্যাঘাত ঘটে।
- পারিবারিক সমস্যা ও দুঃখ-কষ্ট বাড়ে।
অথচ একটু চিন্তা করলে বোঝা যাবে, এই আপত্তিগুলো অনেকটাই আপেক্ষিক এবং সাধারণীকরণ। যথাযথ প্রস্তুতি ও দায়িত্বশীল অভিভাবকত্ব থাকলে অল্প বয়সের বিবাহেও সুখী দাম্পত্য জীবন গড়া সম্ভব। ইসলামের নির্দেশ অনুযায়ী, যদি ছেলে-মেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হয় এবং অভিভাবকরা সম্মত হয়, তাহলে সেই বিবাহকে ‘বাল্যবিবাহ’ বলে বাতিল করা অনুচিত।
আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ
উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, ১৮ শতকের পূর্বে কোনো রাষ্ট্রেই বিবাহের নির্দিষ্ট বয়স ছিল না। অনেক দেশ আজও বয়স নির্ধারণ করেনি, যেমন—সৌদি আরব, ইয়েমেন, আফগানিস্তান।
ত্রিনিদাদ ও টোবাগোতে মুসলিম মেয়েদের বিবাহযোগ্য বয়স ১২ বছর এবং ছেলেদের ১৬ বছর।
বাল্যবিবাহ রোধ নয়, বরং যিনা রোধ জরুরি
আজকের সমাজে বিয়ের বয়স নির্ধারণের নামে যিনা-ব্যভিচারকে পরোক্ষভাবে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। কারণ— যিনার শাস্তি নাই, বরং গোপনে অনাচার করলেও সমাজ চুপ। কিন্তু ১৮ বছরের কম বয়সে বিয়ে করলে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। এভাবে বিবাহকে অপরাধ আর ব্যভিচারকে স্বাধীনতা হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে।
আজকাল বলা হয়—“উভয়ের সম্মতিতে হলে তা ধর্ষণ নয়।” কিন্তু ইসলাম বলে— বিবাহ ছাড়া কোনো শারীরিক সম্পর্কই বৈধ নয়। সম্মতি থাকলেও তা ব্যভিচার।
বিবাহের বয়স নির্ধারণ ধর্মীয় ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। এটি ইসলাম ও মানবতার পরিপন্থী। বরং ইসলাম শিক্ষা দেয়—যৌবনে পদার্পণ ও সামর্থ্য অনুযায়ী বিবাহ হওয়া উচিত।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন— ما ظهَرَ في قَومٍ الرِّبا والزِّنا، إلَّا أحَلُّوا بأنفُسِهم عِقابَ اللهِ عزَّ وجلَّ
অর্থাৎ, “যে জাতির মধ্যে সুদ ও ব্যভিচার বিস্তার লাভ করে, তারা আল্লাহর শাস্তিকে ডেকে আনে।” (মুসনাদে আহমাদ: ৩৮০৯) এছাড়াও আরো বহু ক্ষতি রয়েছে। যা শুধু মুসলমানদের নয় বরং মানব জাতির ইহকাল ও পরকালকে ধ্বংস করে ফেলছে।
সুতরাং কুরআন ও হাদিসের আহ্বান— সমস্ত মুসলমান যেন এই বিভ্রান্তিমূলক ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসে, আর ইসলামের প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গিতে সমাজকে সাজায়। সময়মতো বিবাহ করাই যিনা-ব্যভিচার, ধর্ষণ ও অশ্লীলতা থেকে বাঁচার উত্তম পথ।
এমএইচ/